বেলুড় মঠে ধর্মীয় মঞ্চে রাজনীতির বার্তা মোদির

ষাটের দশকের গােড়ায় যে অল্পবয়সী কিশাের এই বেলুড় মঠে এসেছিলেন রামকৃষ্ণ সংঘের ব্রহ্মচারী হতে, প্রায় ষাট বছর পরে তিনিই এলেন বেলুড় মঠে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।

Written by SNS Kolkata | January 14, 2020 12:13 am

বেলুড় মঠে নরেন্দ্র মোদি। (Photo: IANS/PIB)

তাঁর মাথায় ছিল না কোনও গেরুয়া উষ্ণীষ। পরনে ছিল না বিলাসবহুল কোট কিংবা জামেয়ার শাল। শুধু একখানা কারুকাজহীন শাল ঢেকে রেখেছিল তাঁর বিস্তৃত ছাতি। গলায় সরু পাড়ের উত্তরীয়। এই সাজেই রবিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে নগ্ন পায়ে এসে দাঁড়ালেন বেলুড় মঠের গর্ভগৃহে, পুস্পার্ঘ দিলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেবের উদ্দেশ্যে। ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলেন ইষ্টদেবতাকে।

রবিবার, ১২ জানুয়ারি, স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে বেলুড় মঠ সাক্ষী রইল এক ইতিহাসের। ষাটের দশকের গােড়ায় যে অল্পবয়সী কিশাের এই বেলুড় মঠে এসেছিলেন রামকৃষ্ণ সংঘের ব্রহ্মচারী হতে, প্রায় ষাট বছর পরে তিনিই এলেন বেলুড় মঠে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। ষাট বছর আগে তৎকালীন বেলুড় মঠের তৎকালীন সংঘাধ্যক্ষ মাধবানন্দ সেই কিশােরটিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে। সেই নরেন্দ্র মােদি যখন শনিবার বেলুড় মঠে রাত্রিবাস করতে চাইলেন, সেই মানুষটিকে সাদরে অতিথি হিসেবে বরণ করে নিলেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসীরা।

রাজভবনের বিলাসবহুল আয়ােজন ছেড়ে রামকৃষ্ণ মিশনের ঠাকুরের ভােগপ্রসাদ খেয়ে নৈশাহার সারলেন প্রধানমন্ত্রী। সকাল বেলা বেলুড় মঠে বিকোনন্দের ঘরে বসে ব্রহ্মচারীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ ধ্যান করলেন। সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারীদের সঙ্গে গ্রুপ ফটো, সেলফি তুললেন। গােলাপের তােড়া উপহার নিলেন সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে। বেলুড় মঠ ও মিশনের সম্পাদক স্বামী সুবীরানন্দ নরেন্দ্র মােদিকে দেশের অন্যতম সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখ্যা দিলেন। কিশােরবেলা থেকে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে সন্ন্যাস নেওয়ার যে বাসনা ছিল, সেই ইচ্ছেপূরণ না হলেও গেরুয়া রাজনীতির আদর্শকেই তিনি মনেপ্রাণে লালন করেছেন।

রবিবার বেলুড় মঠে ভক্তির ক্যানভাসে সেই গেরুয়া রাজনীতির রঙকেই ছড়িয়ে দিলেন মােদি। রামকৃষ্ণ মিশনের ধর্মীয় মঞ্চ থেকেই রাজনীতির বার্তা দিলেন নরেন্দ্র মােদি। স্বামী বিৰ্কোনন্দের জন্মদিনে উপলক্ষে এদিন বেলুড় মঠে ছিল স্থানীয় স্কুল এবং রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত স্কুলপড়ুয়াদের নিয়ে যুব দিবস পালনের আয়ােজন। সেখানে বক্তব্য রাখেন নরেন্দ্র মােদি। শুরুতে তাঁর বক্তব্য ছিল ভক্তির আবেগ। বললেন এই বেলুড় মঠ দেশবাসীর কাছে একটা তীর্থক্ষেত্রের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। কিন্তু তাঁর কাছে নিজের ঘরে ফেরা। শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীর মাতৃস্নেহের আঁচলে ভালােবাসার আশ্রয় নেওয়া। মােদি বলেন, এই বেলুড় মঠের মাটি, বাতাসের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ, তাঁর দীক্ষাগুরু স্বামী আত্মস্থানন্দের স্পর্শ মিশে রয়েছে। এখানে এলে তাঁর স্মৃতির পুরনাে পাতাগুলি খুলে যায়।

শনিবার রাতে নরেন্দ্র মােদি যখন বেলুড় মঠে পা রাখছেন, তার আগেই তিনি টুইট করেছেন। লিখেছে, সেখানে স্বামী আত্মস্থানন্দের সান্নিধ্যের অভাব তাঁকে পীড়িত করবে। রবিবার পড়ুয়াদের সামনে বলেন, তাঁর গুরুর দেখানাে পথেই তিনি চলেছেন। রাজকোটে তিনি যখন গুরুর কাছে সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলেন, তখন আত্মস্থানন্দ তাঁর হাত ধরে বলেছিলেন, ‘তােমার কাছে জনসেবাই প্রভুসেবা’। নরেন্দ্র মােদি বলেন, গুরুর আশীর্বাদ নিয়েই তিনি ১৩০ কোটি মানুষের প্রতি কর্তব্য করছেন, তাদের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন।

এদিন নরেন্দ্র মােদি বিবেকানন্দের আদর্শের কথা তুলে ধরেন উপস্থিত পড়ুয়াদের সামনে। বলেন, বিবেকানন্দ বলেছিলেন একশাে জন যুবক পেলে তিনি গােটা ভারতকে বদলে দেবেন। বিবেকানন্দের আদর্শকে সামনে রেখেই গােটা ভারতে পরিবর্তন আনতে চান মােদি। বিবেকানন্দের স্বপ্নকে সফল করতে, সরকারের ভারত নির্মাণ সংকল্পে দেশের যুবসমাজকে পাশে পেতে চান মােদি। স্বামীজির চিন্তা ও আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যুব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে বলেন।

এরপর নরেন্দ্র মােদি এদিন ভক্তির বাণীর সঙ্গে সঙ্গে শুনিয়ে দেন গত ক’বছরে তাঁর সরকারের সাফল্যের ধারাকাহিনি। বলেন বছর ছয়-সাত আগেও স্বচ্ছ ভারত হবে, এমন কথা কেউ ভাবেনি। ডিজিটাল লেনদেনের কথা কারও চিন্তায় আসেনি। কিন্তু আজ সেই স্বপ্ন সফল হয়েছে। মােদি এদিন ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেশের যুবসমাজের কাছে আহ্বান জানান। যুবসমাজের ‘জোশ’, ‘উমং’, ‘উর্জা’কে কাজে লাগাতে বলেন।

তবে প্রধানমন্ত্রীর আক্ষেপ কিছু মানুষ রাজনৈতিক কারণেই দেশের যুব সম্প্রদায়কে ভুলপথে পরিচালিত করছে। এরপরই নরেন্দ্র মােদি নাগরিকত্ব সংশােধনী আইনের প্রসঙ্গ তােলেন। বলেন, এই নাগরিকত্ব আইন নিয়ে কেউ কেউ বিভ্রান্তি যুবকদের মনে ভরে দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলাে রাজনীতির স্বার্থেই এই আইনের ভলাে দিক বুঝেও না বােঝার চেষ্টা করছে। পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের যুব সম্প্রদায়কে ভুল বােঝানাে হচ্ছে। তবে এই বিভ্রান্তি দূর করা আমার দায়িত্ব। নরেন্দ্র মােদি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, নাগরিকত্ব সংশােধনী আইন নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য নয়, নাগরিকত্ব দানের জন্য। দেশভাগের পরে পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের ওপর যে অত্যাচার হয়েছে, তাদেরকে সুরক্ষা দিতেই এই আইন আনা হয়েছে। এই আইনের জন্যই বিশ্বের কাছে পাকিস্তানের মুখােশ খুলে যাচ্ছে। এই বিষয়ে মহাত্মা গান্ধির দেখানাে পথকেই অনুসরণ করা হচ্ছে।

এরপর মােদি উপস্থিত পড়ুয়াদের সামনে প্রশ্ন রাখেন, পাকিস্তানে যেসব সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার হয়েছে, তাদের কি ফেরত পাঠানাে উচিত? নাকি সুরক্ষা দেওয়া উচিত? অন্যের ভালাে করা উচিত তাে? মােদির সঙ্গে আপনারা আছেন তাে? হাত তুলে বলুন। মােদির এই আহ্বানে বেলুড় মঠে উপস্থিত ছাত্র যুবরা তুমুল হর্ষধ্বনি করে জবাব দেন। সেই ধ্বনিতে হয়তাে বা চাপা পড়ে যায় গঙ্গার অপরপারে তৃণমূলের ধর্নামঞ্চের কাছে মােদি বিরােধী স্লোগানের শব্দ।

শনিবার কলকাতায় পা রাখার পর থেকে যে তুমুল বিক্ষোভের আঁচ পেয়েছিলেন মােদি, তা জুড়িয়ে গিয়েছিলে গঙ্গার পাড়ে বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীদের আন্তরিকতার স্পর্শে। বিরােধীদের আন্দোলনের বিড়ম্বনা উধাও হয়ে গিয়েছিল বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীদের আশীর্বাদে। এভাবেই এবারের কলকাতা সফরে ধর্ম বর্ম হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। মােদির গেরুয়া রাজনীতি আশ্রয় পেল সন্ন্যাসীর গেরুয়াবাসে।