এনআরসি আতঙ্কের চোরাস্রোত কুমোরটুলির বাঙালপট্টিতে

প্রতিকি ছবি (Photo: iStock)

আতঙ্কের চোরাস্রোত বইছে থমথমে কুমােরটুলির বাঙালপাড়ায়। ‘চলে যেতে বললেই কি চলে যাওয়া যায় নাকি?’ এনআরসি নিয়ে মন্তব্য বাঙালপাড়ার এক শিল্পীর।

তাঁদের তুলির টান জগদ্বিখ্যাত। শুধু দুর্গা, কালী, শিব নয়, শ্যামাপ্রসাদের মুর্তিও তৈরি করেন কুমােরটুলির বাঙালপট্টির মৃৎশিল্পীরা। সামনেই সরস্বতীপুজো। কাঠামাে তৈরিতে ব্যস্ত তারা, সঙ্গে জোর আলােচনা চলছে এনআরসি নিয়েও। ‘নাগরিক তো সেই কবে থেকে, খামােকা শরণার্থী তকমা চাই না’, দাবি বেশিরভাগেরই।

১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের ঠিক আগে পূৰ্বঙ্গ থেকে এপার বাংলায় এসেছিলেন বাঙালপট্টির বাসিন্দারা। এরপর বিভিন্ন উদ্বাস্তু ক্যাম্প ঘুরে ঠাই হয়েছিল বাঙালপট্টিতে। কিন্তু এনআরসি ঘােষণার পর থেকেই চাপা গুঞ্জন ওপার বাংলা থেকে আসা প্রবীণদের মধ্যে। ‘ভােটার কার্ড তাে রয়েইছে, তাহলে শরণার্থী হব কেন?’ প্রশ্ন অধিকাংশেরই।


বাঙালপট্টির বাসিন্দা শিল্পী মােহিত পাল জানান, ১৯৭০ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে এপার বাংলায় এসেছিলেন তাঁর বাবা ধনঞ্জয় রুদ্রপাল। তাঁর পড়াশােনা এই বঙ্গের স্কুলেই। তাঁর ভােটার কার্ড, আধার কার্ড সহ অন্যান্য পরিচয়পত্র রয়েছে বটে। কিন্তু তাও সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারছেন না এই শিল্পী। তাঁর কথায়, রমেশ পাল, রাখাল পাল, সনাতন রুদ্রপাল, ধনঞ্জয় রুদ্রপালের মতাে শিল্পীরা বাঙালপট্টির বাসিন্দা। এই শিল্পীদের হাত ধরেই বিশ্বদরবারে কুমােরটুলির নাম ছড়িয়েছে। এই শিল্পীরা প্রত্যেকেই পূৰ্ব্বঙ্গ থেকে এসেছিলেন বলেও জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, সংশােধিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, মুসলিম ছাড়া সমস্ত সম্প্রদায়ের উদ্বাস্তুদের শরণার্থী হিসাবে গণ্য করা হবে। অর্থাৎ তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন আশ্বস্ত হতে পারছেন না বাঙালপট্টির শিল্পীরা? এই শিল্পীদের কথায়, অসমে এনআরসির তালিকা প্রকাশ পাওয়ার পর দেখা গিয়েছিল তালিকা থেকে বাদ পড়েছিল প্রায় ১৯ লক্ষ হিন্দুর নাম। সেই বাদ পড়া হিন্দুদের বর্তমান অবস্থার কথা কাগজে পড়ে বা ইন্টারনেটে দেখে আতঙ্ক দানা বেঁধেছে অনেকেরই মনে।

কয়েকজন বাঙালপট্টির বাসিন্দাদের বক্তব্য, সংশােধিত নাগরিক আইনে হিন্দু উদ্বাস্তুদের শরণার্থী হিসাবে গণ্য করা হবে বলে বলা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ বছর যাবৎ এই দেশের নাগরিক থাকার পর ফের তাদের শরণার্থী হিসাবে চিহ্নিত করে নাগরিকত্ব দেওয়ার পদ্ধতির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন বাঙালপট্টির শিল্পীদের একাংশ।

শিল্পী অনিল পাল জানান, ৪০ বছর ধরে এই দেশে রয়েছেন তিনি। কেউ চলে যেতে বললেই চলে যাবেন না, সাফ দাবি এই শিল্পীর। বাঙালপট্টির বাসিন্দা জীবন কুণ্ডু জানান, তাদের অনেকের কাছেই উদ্বাস্তু শংসাপত্র নেই। কিন্তু অন্য সমস্ত পরিচয়পত্র রয়েছে। সংশােধিত নাগরিক বিল পাস হলেও কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে এনআরসির, তার বিন্দুবিসর্গও জানা নেই বলে দাবি জীবন কুণ্ডুর।

তাঁর কথায়, একবার ভিটেমাটি ছেড়ে এই দেশে আসতে হয়েছে। আরও একবার সেই একই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তাদের যাতে যেতে না হয়, সেজন্য সরকারের কাছে আবেদনও করেন তিনি। পাশাপাশি সহাস্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন এই শিল্পী, ‘যদি বাঙালপট্টির শিল্পীরা হাতে কাদা না মেখে, তুলি না ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে বছর পার করতে হয়, তাহলে শ্যামাপ্রসাদ থেকে শুরু করে মা দুর্গার মূর্তি তৈরি করবে কারা?’

মােটের ওপর এলাকায় কোনও অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি না হলেও এনআরসি নিয়ে চোরা আতঙ্কের স্রোত বইছে কুমারটুলির বাঙালপট্টিতেও।