খুনই, নিশ্চিত পুলিশ উত্তর খুঁজছে খুনি কে

নিজস্ব চিত্র

ট্যাংরার দে বাড়ির দুই বধূ ও কিশোরী কন্যাকে যে খুন করা হয়েছে, তা ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে পুলিশের কাছে স্পষ্ট। কিন্তু কে বা কারা ওই বাড়ির তিন সদস্যকে খুন করলেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। ওই দুই ভাই-ই কি তাঁদের খুন করেছেন? বাইরের কেউ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিনা সেই প্রশ্নও উঠছে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, সিসিটিভি ফুটেজে অন্য কাউকে দেখা যায়নি। এদিকে বাড়ির তিনতলায় পাওয়া গিয়েছে রক্তমাখা ছুরি। অথচ ওই তিনজনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে দোতলায়। তাই প্রশ্ন উঠছে, কীকরে তিনতলায় ছুরিটি গেল এবং সেখানে রক্তই বা ছড়িয়ে রয়েছে কেন? মনে করা হচ্ছে, রোমি এবং সুদেষ্ণাকে হাতের শিরা কেটে খুন করার পরেই ছুরিটি তিনতলায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাড়ির বিভিন্ন অংশে রক্ত ছড়িয়ে ছিল। রক্ত পাওয়া গিয়েছে দে ভাইদের গাড়িতেও। সেই রক্তের নমুনা পরীক্ষা করছেন তদন্তকারীরা। তবে গাড়িটি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল বলে প্রণয়, প্রসূন এবং ১৪ বছরের প্রতীপ— তিন জনই গুরুতর জখম হয়েছেন। এখন পুলিশ জানার চেষ্টা করছে, দুর্ঘটনার আগে থেকে গাড়িতে রক্ত ছিল কিনা। তবে দুর্ঘটনার ফলে গাড়িতে রক্ত থাকা অস্বাভাবিক নয়।

ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হয়েছে, তাঁদের তিন জনকেই খুন করা হয়েছে। কিশোরী প্রিয়ম্বদার মৃত্যু হয়েছে খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে। রোমি ও সুদেষ্ণার হাতের শিরা কাটা হয়েছে। কাটা হয়েছে তাঁদের গলাও। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ঘুমন্ত বা অচেতন অবস্থায় না থাকলে এত নিখুঁতভাবে শিরা কাটা সম্ভব নয়।

সূত্রের খবর, প্রথমে দুই ভাই-ই বেছে নিয়েছিলেন আত্মহননের পথ! সেই মতো স্ত্রীদের জানাতে তাঁরাও একসঙ্গে আত্মহত্যার কথা বলেন। তারপর দীর্ঘ এক সপ্তাহ ধরে চলে মানসিক প্রস্তুতি। হাসপাতালে আহতদের জেরা করে এমনই তথ্য পেলেন তদন্তকারী আধিকারিকেরা। এ দিন হাসপাতালে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় দে ভাইদের। পুলিশি জেরার মুখে আহতদের দাবি, গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঋণের বোঝা ঝেড়ে ফেলতে তাঁরা দু’জনেই আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেন। তারপর নিজেদের স্ত্রীদের জানাতে তাঁরাও একসঙ্গে আত্মহত্যা করবেন বলেই ঠিক করেন। সেই মতো দীর্ঘ একসপ্তাহ ধরে মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার পরেই চরম সিদ্ধান্ত। তবে দুই বউ এবং বাড়ির নাবালিকা কন্যাকে কে খুন করল তার উত্তর এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয় পুলিশ আধিকারিকদের কাছে।


অন্যদিকে, এ দিন ট্যাংরার ২১/সি অতুল শূর রোডের দে বাড়িতে গিয়েছিল ফরেন্সিক মেডিসিনের একটি বিশেষজ্ঞ দল। সূত্রের খবর, তাঁরাই দে বাড়ির মৃত সদস্যদের ময়নাতদন্ত করেছিলেন। বাড়িতে সংগ্রহ করা হয় একাধিক নমুনাও।

প্রসঙ্গত, ঘটনার দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার বেলার দিকে কারখানা থেকে ফিরে বাড়িতেই ছিলেন দুই ভাই। তারপর মঙ্গলবার মধ্যরাতে বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে দুই ভাইয়ের সঙ্গে বেরিয়ে যায় নাবালকও। তা ইতিমধ্যেই উঠে এসেছে এক সিসিটিভি ফুটেজে। সেই ফুটেজে আরও দেখা গিয়েছে, এক ভাইয়ের হাতে রয়েছে বোতল। যদিও সেটা কিসের বোতল তা এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি।

ট্যাংরার দে বাড়ি প্রাসাদোপম। পুরোটাই মোড়া সিসিটিভি নজরদারিতে। পুলিশ সূত্রে খবর, গোটা বাড়ি ঘিরে রয়েছে খান বিশেক সিসিটিভি ক্যামেরা। কিন্তু তার ফুটেজ নেই! বাড়ির আপাদমস্তক ২০টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দিয়ে ঘেরা থাকলেও তা বিশেষ পাসওয়ার্ড দিয়ে সংরক্ষিত। কাজেই সেই ফুটেজ এখনও পর্যন্ত দেখে উঠতে পারেননি তদন্তকারী আধিকারিকেরা। অন্যদিকে বেশ কয়েকটি ক্যামেরা খারাপ বলেও জানা গিয়েছে। তবে গোয়েন্দাদের প্রশ্ন, আদৌ কি খারাপ, নাকি পূর্বপরিকল্পনা মাফিক বন্ধ রাখা হয়েছিল সিসিটিভি ক্যামেরা। তার উত্তর এখনও পাননি লালবাজারের গোয়েন্দারা।

প্রসঙ্গত, মৃত প্রদীপকুমার দে নিজের হাতে শুরু করেছিলেন দে বাড়ির চর্ম কারখানার। তারপর বাবার মৃত্যুর পর দুই ভাই প্রসূন ও প্রণয় ধীরে ধীরে বড় করে তোলেন সেই ব্যবসা। একটা সময় কারখানার পাশাপাশি আরও ব্যবসা শুরু করেন দুই ভাই মিলে। যার কর্ণধার হিসেবে উঠে এসেছে দে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নামও। তবে ব্যবসার মন্দা দেখা দেয় করোনাকালে। কিন্তু তারপরেও নিজেদের বিলাসবহুল জীবনযাপন থেকে সরে আসেননি দে পরিবারের সদস্যরা। আর সেই শুরু। তারপর থেকে একাধিক সংস্থা থেকে কয়েক কোটি টাকা ধার করেন দে ভাইয়েরা। পাশাপাশি দেওয়া হয় বাড়ি বন্ধক। কিন্তু তারপরেও কমেনি বিলাসিতা। সূত্রের খবর, ঋণের টাকাতেই গতবছর দুইভাই স্ত্রীদের জন্য দুটি বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছেন। ঘুরতে গিয়েছেন বিদেশেও। ফলে সত্যিই সপরিবারে নিজেদের শেষ করে দেওয়ার মতো আর্থিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল কিনা দে পরিবারের, তা নিয়েও ভাবছেন তদন্তকারীরা।