মমতার সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের মাস্টারস্ট্রোকেই ব্যাকফুটে মোদি

মধুছন্দা চক্রবর্তী: কবি কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ নামে বিখ্যাত কবিতার লাইনটা নিশ্চয় আমাদের মনে আছে৷ ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে৷’ রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে সেই ‘আদর্শ ছেলে’র খোঁজ পাওয়া গিয়েছে কিনা সেই উপসংহারে পৌঁছনো না গেলেও, এমন ‘আদর্শ মেয়ে’র যে খোঁজ পাওয়া গিয়েছে, সেকথা পুরোপুরি অস্বীকার করা যাবে না৷

অন্তত আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যখন ঘোষণা করেন, ‘মানুষের কাজ করাই আমাদের একমাত্র সংকল্প’ তখন তা নেহাতই কথার কথা মনে হয় না যদিও নির্বাচনের আগে মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতি দেওয়া একটা চিরন্তন প্রথা৷ সেই প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ক্ষেত্রে মোদি এবং মমতার একটা চিরন্তন যুদ্ধ রয়েছে৷

তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনেক ক্ষেত্রেই বলা যায় ‘কেউ কথা রাখেনি’৷ বিশেষ করে হিসেব বহির্ভূত টাকা উদ্ধার করে প্রত্যেক ভারতবাসীর অ্যাকাউন্টে ‘পনের লক্ষ’ টাকা দেওয়ার বিষয়টি৷ যা পরবর্তীকাল স্রেফ ‘জুমলা’ই (ভাঁওতাবাজি) হয়ে রয়ে গিয়েছে৷ বিরোধীরা বহুক্ষেত্রেই এই বিষয়টিকে আক্রমণের ইসু্য করে তোলে৷ তবে এখানেই শেষ নয়৷ মোদি সরকারের একাধিক ঘোষণা ‘ফ্লপ শো’তে পর্যবসিত হয়েছে৷ যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ডিজাস্টার হল নোটবন্দি৷ বলা হয়েছিল এই নোটবন্দির ফলে উদ্ধার হবে কালো টাকা৷ কিন্ত্ত সেসব কিছুই হয়নি৷


মোদি সরকারের একাধিক ঘোষণা কার্যত অশ্বডিম্বতে পরিণত হয়েছে৷ যেমন, ঘটা করে দেশের বেশ কয়েকটি শহরকে স্মার্ট সিটি হিসেবে ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার৷ দু হাজার পনেরো সাল থেকে দু হাজার একুশ সালের মধ্যে দেশের চৌত্রিশটি স্মার্ট সিটির জন্য যা বরাদ্দ করার কথা ছিল তা করেনি৷
কিন্ত্ত প্রতিবছর নির্বাচনী ইস্তেহারে তৃণমূল সুপ্রিমো যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার অধিকাংশই পূরণের চেষ্টা করেছেন৷ যেমন একুশের নির্বাচনের আগে তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তেহারে ছিল ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্প৷ যেখানে কিছু শর্তসাপেক্ষে ষাট বছর পর্যন্ত জেনারেল কাস্ট মহিলাদের পাঁচশো টাকা এবং তপশিলি জাতি ও উপজাতির মহিলাদের হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল৷ এবং কথা রেখেছিলেন মমতা৷ চব্বিশের অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা আরও বাড়ানো হয়েছে৷ জেনারেল কাস্টের মহিলাদের জন্য এক হাজার এবং তপশিলি জাতি-উপজাতিদের জন্য বারশো টাকা করে দেওয়া হচ্ছে৷ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মস্তিষ্কপ্রসূত এই প্রকল্পটি ভিনরাজ্যও অনুকরণ করেছে৷ এর মধ্যে রয়েছে মধ্যপ্রদেশের ‘লাডলি বহেনা’ প্রকল্প এবং কর্ণাটকের ‘গৃহ লক্ষ্মী’ প্রকল্প৷ যে প্রকল্পগুলিতে যথাক্রমে এক হাজার এবং দু হাজার টাকা করে দেওয়া হয়৷ অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বারবার আওড়ানো তত্ত্বটাই সত্যি হল — হোয়াট বেঙ্গল থিংস টুডে, দ্য হোল ইন্ডিয়া থিংস টুমরো৷

নানারকম রাজনৈতিক উঠানপড়নের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প৷ একটা মানুষের জীবনের নানান পর্যায়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি তৈরি করা হয়েছে৷ এর মধ্যে মাতৃগর্ভ থেকে শৈশবের শিক্ষালাভ পর্যন্ত জীবনের নানা পর্যায়ে রয়েছে বিনামূল্যে মায়েদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ‘জননী সুরক্ষা যোজনা’, শিশুর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য ‘সবুজশ্রী’, প্রাক বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও পুষ্টির জন্য ‘শিশুর আলয়’, শিক্ষাশ্রী, সবুজ সাথী, কন্যাশ্রী, ঐক্যশ্রী ইত্যাদি প্রকল্প রয়েছে৷ এরপর উচ্চশিক্ষা এবং বৃত্তিশিক্ষা নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়াদের ট্যাব বিতরণের জন্য ‘তরুণের স্বপ্ন’, ‘স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড’, দুস্থ কিন্ত্ত মেধাবী পড়ুয়াদের জন্য ‘স্বামী বিবেকানন্দ স্কলারশিপ’ চালু রয়েছে৷ পরবর্তী পর্যায়ে পারিবারিক জীবনের নিশ্চয়তা ও সুরক্ষার জন্য ‘স্বাস্থ্যসাথী, ‘আবাস যোজনা’, ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’, ‘রূপশ্রী’, ‘খাদ্যসাথী’, ‘হাসির আলো’ জব কার্ড হোল্ডারদের জন্য ‘কর্মশ্রী’, ‘পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ প্রকল্প’, ‘কৃষকবন্ধু’, ‘সমুদ্রসাথী’, ‘চা সুন্দরী’, ‘লোকপ্রসার’, ‘আনন্দধারা’ ইত্যাদি একাধিক প্রকল্প৷ এরপর জীবনে যখন বেলাশেষের দিকে ঢলে পড়ে সেই সময়ের জন্যও তৃণমূল সরকারের একাধিক প্রকল্প রয়েছে ‘চোখের আলো’, ‘বার্ধক্য ভাতা’, ‘বিধবা ভাতা’, ‘মানবিক’, ‘বার্ধক্য ভাতা’, ‘সমব্যথী’ ইত্যাদি নামে৷ অর্থাৎ জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন মানুষের সামাজিক সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে বাংলার তৃণমূল সরকার৷ যার ফলে বিভিন্ন বয়সের মানুষের কাছেই বাংলার শাসক সরকারের সামাজিক পরিষেবা পৌঁছে যাচ্ছে৷ ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধে প্রাপ্তিই এই রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের ভিতকে মজবুত করে তুলেছে ক্রমশ৷ বিভিন্ন ইসু্যতে রাজনৈতিক আক্রমণের পরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়িয়ে তুলেছে৷ দুর্নীতির অভিযোগ, রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতি ইত্যাদি ইসু্য নিয়ে তৃণমূল সরকারকে যে যতই আক্রমণ করুক না কেন, ব্যক্তিগত মুষ্টিলাভই ভোটারদের আঙুলকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তৃণমূলের ভোটবাক্সের দিকে৷ আর তার জন্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনায়াসে বলতে পারেন, ‘আমার ভাণ্ডার আছে তোমা সবাকার ঘরে ভরে’৷

আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে সর্বস্তরের মানুষের কাছে মমতা সরকারের এই সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিই তাঁর মাস্টারস্ট্রোক৷ যা অন্তত এই বাংলায় পেছন ফেলে দেবে নরেন্দ্র মোদির দলকে৷ আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে বাংলায় প্রচারে এসে আয়ুষ্মান ভারত, প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনা ইত্যাদি নানান প্রকল্প নিয়ে প্রচার করলেও তা রাজ্যের তুলনায় সংখ্যার দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে৷ তার ওপর সেইসব প্রকল্পের বাস্তবমুখিতা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে৷ সেই সূত্রে শুধু কথা দেওয়াই নয়, কথা রাখার জন্যও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এগিয়ে রাখবে জনতা৷