টুইটে, চিঠিতে প্রতিবাদ মুখ্যমন্ত্রীর, ক্ষোভ মুখ্যসচিবের

র‍্যান্ডম টেস্টিং করছে এক স্বাস্থ্যকর্মী। (File Photo: AFP)

যুদ্ধ হচ্ছিল মহামারীর বিরুদ্ধে। তার মধ্যেও এই রাজ্যে জমে উঠল কেন্দ্র-রাজ্যের মহারণ। গত ক’দিন ধরেই বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব এবং রাজ্যপাল রাজ্য সরকারে বিরূপ সমালোচনায় সেই যুদ্ধের আঁচ পাওয়া গিয়েছিল। সোমবার কেন্দ্রীয় সরকারে আন্তঃমন্ত্রকের প্রতিনিধি দলের এই রাজ্যে আসার সংবাদ তাতে আরও উত্তাপ বাড়াল।

কলকাতা সহ বাংলার সাত জেলার করোনা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে সোমবার পণ্যবাহী বিমানে রাজ্যে এল কেন্দ্রের আন্তঃমন্ত্রকের দু’টি প্রতিনিধি দল। ওই দল রাজ্যে পা রাখার আগেই টুইটারে তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন কোন যুক্তিতে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল পাঠানো হচ্ছে? তা স্পষ্ট করুন, নইলে ঢুকতে দেব না।

শুধু ট্যুইটই নয় কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল আসার খবর দিয়ে সোমবার সকালে অমিত শাহ’র ফোন পাওয়ার পর এদিন বিকেলে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় সরকার যে সাতটি জেলাকে বেছে নিয়েছে তা একেবারেই কল্পনাপ্রসূত।


সোমবার বিকেলে নবান্নের সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যসচিব জানান, রাজ্য বলে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল সরাসরি পরিদর্শনে যাচ্ছেন, এটা সমর্থন করছি না।

কেন্দ্রীয় একটি প্রতিনিধি দল বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে বিএসএফ এবং এসএসবি টিম নিয়ে জলপাইগুড়ি রওনা দেন । অন্যদল কলকাতা বিমানবন্দরে নামার পর নবান্নে এসে মুখ্যসচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এদিন নবান্নে কেন্দ্রের আন্তঃমন্ত্রক প্রতিনিধিদল এসে মুখ্যসচিবের সঙ্গে কথা বললেও তাদের জেলা পরিদর্শনে যেতে দিতে নারাজ রাজ্য সরকার।

রবিবারই রাজ্যের মুখ্যসচিবকে চিঠি দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছিল, কলকাতা, হাওড়া, উত্তর চব্বিশ পরগণা, পূর্ব মেদিনীপুর, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং এবং কালিম্পং- বাংলার এই সাতটি জেলার পরিস্থিতি গুরুতর। সেখানে লকডাউনের শর্ত ঠিকমতো মানা হচ্ছে না। সামাজিক দূরত্ব না মেনে রেশন দোকান, ব্যাংক এবং বাজারে মানুষ ভিড় জমাচ্ছে। প্রাইভেট এবং বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত গাড়িতে যাত্রী পরিবহণ চলছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের চিঠিতে বলা হয়েছিল বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের পাঁচটি ধারা অনুযায়ী ইন্টারনাল মিনিস্ট্রি অফ কো-অর্ডিনেশন টিম’এর প্রতিনিধিরা পশ্চিমবঙ্গে করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলা ঠিকমতো হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখবেন। অত্যাবশকীয় পণ্য সরবরাহ ঠিকমততা হচ্ছে কিনা, মানুষ সোস্যাল ডিসট্যান্সিং ঠিকমতো মানছে কিনা এসব ছাড়াও স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এবং হাসপাতালের পরিস্থিতি সরজমিনে দেখবে এই প্রতিনিধি দল।

পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া মহারাষ্ট্র এবং রাজস্থানেও এই চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে চিঠি এসে পৌছনোর চব্বিশ ঘন্টা পেরোতে না পেরোতেই কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইট করেন। জানতে চান, কোন যুক্তিতে আন্তঃমন্ত্রক প্রতিনিধি দল পাঠানো হল তা স্পষ্ট করতে হবে। নইলে এই রাজ্যে ঢুকতে দেওয়া হবে না।

মমতার অভিযোগ, কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী। মুখ্যমন্ত্রী টুইট হুঁশিয়ারিকে কোনও গুরুত্ব না দিয়েই সোমবার পণ্য পরিবাহী উড়ানে আন্তঃমন্ত্রক টিমের প্রতিনিধিদের একটি দল বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে উত্তরবঙ্গে চলে যান এসএসবি এবং বিএসএফকে সঙ্গে নিয়ে। অন্যদল কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে মুখ্যসচিবকে ফোন করেন।

এই ঘটনায় ক্ষুদ্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখে জানান, কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল আসার কথা জানিয়ে ১৯ এপ্রিল (রবিবার) চিঠি দেওয়া হলেও তা রাজ্য সরকারে কাছে এসে পৌছয় ২০ এপ্রিল।

এছাড়া মমতার বক্তব্য, দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন পাওয়ার অনেক আগেই, সকাল দশটা নাগাদ কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল পণ্য পরিবাহী বিমানে কলকাতায় পৌছে যায়। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, কেন্দ্রের এই অতি সক্রিয়তা ভালো। কিন্তু রাজ্যকে না জানিয়ে এটা করা প্রোটোকল বিরোধী। প্রথা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত ছিল আগে রাজ্য সরকারের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করা।

সোমবার বিকেলে মুখ্যসচিবও একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কেন্দ্রীয় আন্তঃমন্ত্রক দলের প্রতিনিধিদের আসার বিষয়ে আমাদের কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি। শুধুমাত্র জানানো হয়েছে। যখন জানানো হয়েছে, তার পনেরো মিনিটের মধ্যেই প্রতিনিধি দল এখানে এসে পৌঁছেছে। করোনা নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যে যে যৌথ অভিযানের শর্তকেই অমান্য করছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও বিষয়ে জানার থাকলে রাজ্য সরকার অবশ্যই সহযোগিতা করবে। কিন্তু সরাসরি পরিদর্শনে মাঠে চলে যাওয়াকে মানতে পারছিনা। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদলের আগে রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল। তারপর যদি কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হত রাজ্য সরকারই তার ব্যবস্থা করে দিত।

কেন্দ্রীয় সরকারের ওই প্রতিনিধি দলে বিশেষজ্ঞরা থাকলে তারা হাসপাতালগুলিতে ওষুধ কিংবা করোনা প্রতিরোধের সরঞ্জামের বিষয় নিয়ে কোনও আশার কথা বলেত পারতেন। কিন্তু এখানে এমন করা হচ্ছে যেন কেন্দ্র ও রাজ্য দুই প্রতিপক্ষ।

করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের ভূমিকায় সন্তুষ্ট নয় বামফ্রন্টের নেতারা। তবে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা না করে, কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল রাজ্যে পাঠানোয় কেন্দ্রের সমালোচনা করে কার্যত মমতা সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছেন মহম্মদ সেলিম, সুজন চক্রবর্তীর মতো বাম নেতারা।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা মুখ্যমন্ত্রীর চিঠির পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের যুগ্ম সচিব পুণ্যসলিলা শ্রীবাস্তব বলেন, কেন্দ্রের তরফে আন্তঃমন্ত্রক প্রতিনিধি দল পাঠানোর অর্থ রাজ্যগুলিকে আরও সাহায্য করা। এই প্রতিনিধি দলে পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের প্রতিনিধিও রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সমস্যা হল তারা বিষয়টিকে সহযোগিতা হিসেবে নিচ্ছে না, ইগো হিসেবে নিচ্ছে।