গোবিন্দ মুখার্জি ও দেবাশিস দাস, দিঘা
ইতিহাস গড়লেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভগবান জগন্নাথের প্রাণ প্রতিষ্ঠার পর বুধবার অক্ষয় তৃতীয়ার মাহেন্দ্রক্ষণে দিঘার জগন্নাথধামের দ্বারোদ্ঘাটন করলেন মুখ্যমন্ত্রী। দ্বারোদ্ঘাটনের আগে সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় তিনি সকলের উদ্দেশে বলেন, ‘সবারে করি আহ্বান।’ পাশাপাশি তিনি ঘোষণা করেন, মন্দিরের ছবি ও প্রসাদ গোটা পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
পরিকল্পনা মতো বুধবার সকাল থেকেই ভগবান জগন্নাথের বিগ্রহে প্রাণ প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। শুরু হয় যজ্ঞানুষ্ঠান। সেই সময় বিগ্রহকে চার দিক দিয়ে সোনা, রুপো ও তামার তার দিয়ে ঘেরা হয়। সেই তিন ধাতুর ‘কার’ প্রধান পুরোহিতের কোমরে বাঁধা ছিল। এরপর বিগ্রহের সামনে প্রতিষ্ঠা করা হয়ে যজ্ঞকুণ্ড ও কুম্ভকুণ্ড। পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী সকাল ১১টা ১০ থেকে ১১টা ৩০ মিনিটের মধ্যে নিমকাঠের তৈরি জগন্নাথের মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হয়। এই কাজের দায়িত্বে ছিলেন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের অন্যতম প্রধান সেবায়েত রাজেশ দয়িতাপতি। দেবতার সর্বাঙ্গে কুশ স্পর্শ করে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ পাথরের জগন্নাথ মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন ইসকনের সেবায়েতরা। তারপর জগন্নাথদেবের স্নান ও বস্ত্র পরিধানের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভগবানের উদ্দেশে ৫৬ ভোগ অর্পণ করেন পুরোহিতরা।
উদ্বোধন উপলক্ষ্যে মন্দির চত্বরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্তা থেকে শুরু করে বিনোদন জগতের তারকারা। সেই অনুষ্ঠানে মমতার লেখা, সুর দেওয়া গান গেয়ে সকলের মনোরঞ্জন করেছে জিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ও শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়াও ছিলেন নচিকেতা, অদিতি মুন্সি, ইমন চক্রবর্তী, রূপঙ্কর বাগচী সহ সঙ্গীত জগতের শিল্পীরা। নৃত্য পরিবেশন করেছেন ডোনা গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর নাচের দল। পাশাপাশি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দেব, রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, জুন মালিয়া, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত মোহতা, অরিন্দম শীল, লাভলি মৈত্র, দেবলীনা কুমার সহ বিনোদন জগতের তারকারা উপস্থিত ছিলেন। সকল অতিথিদের পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। এরপর দুপুর ৩টে থেকে ৩টে ১০ মিনিটের মধ্যে মন্দিরের দ্বার উন্মোচন করেন মমতা। দরজা ঠেলে তিনি মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করেন। বিগ্রহের সামনে আরতিও করেন তিনি। এ দিন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার পাশাপাশি রাধাকৃষ্ণের মূর্তিতেও প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটনের আগে মুখ্যমন্ত্রী সকল পুরোহিত, সন্ন্যাসী, তারকা, শিল্পী ও স্থানীয় মানুষকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। গত ৩ বছর ধরে মন্দির তৈরির কাজে নিযুক্ত শ্রমিক ও ইঞ্জিনিয়রদের অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘এই মন্দির আগামী হাজার বছর ধরে সমুদ্র তরঙ্গে তীর্থস্থান ও পর্যটনস্থল হিসেবে উন্মাদনার প্লাবন তৈরি করবে। যা এক অপূর্ব সৃষ্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলি, সবারে করি আহ্বান। এই মন্দির আপনাদের জন্যেই।’
মমতা জানিয়েছেন, মন্দিরের শীর্ষে ভগবান বিষ্ণুর অষ্টধাতুর নীল চক্র স্থাপন করা হয়েছে। তৈরি হয়েছে চারটি প্রবেশদ্বার। পূর্ব দিকে সিংহদ্বার, পশ্চিমদিকে ব্যাঘ্রদ্বার, দক্ষিণদিকে অশ্বদ্বার ও উত্তরদিকে হস্তিদ্বার। তৈরি করা হয়েছে চৈতন্যদ্বারও। রত্নবেদীর উপর জগন্নাথ, বলরাম ও শুভদ্রার পাথরের তৈরি বিগ্রহের পাশাপাশি নিমকাঠের তৈরি বিগ্রহও স্থাপন করা হয়েছে। মন্দির চত্বরে প্রায় ৫০০–র বেশি গাছ লাগানো হয়েছে। গত সাতদিন ধরে কলস যাত্রা, যজ্ঞ ইত্যাদি আচার অনুষ্ঠান হয়েছে।
দ্বারোদ্ঘাটনের পর সাধারণ মানুষের জন্য দিঘার মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া হয়। কড়া নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছিল মন্দির চত্বর। তার মধ্যেই উপস্থিত অতিথি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এ দিন জগন্নাথ দেব দর্শনের সুযোগ পান।