রাজভবনের ডাকে নীরব মমতা, পত্রযুদ্ধে সেই সংঘাতেরই আবহ

রাজভবনে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের সঙ্গে দেখা কোর্টে এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। (File Photo: IANS)

রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানার জন্য সােমবারই মুখ্যসচিব রাজীব সিনহা ও রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তা বীরেন্দ্রকে রাজভবনে তলব করেছিলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। কিন্তু রাজ্যপালের ডাকে তাঁরা সাড়া দেননি। স্বভাবতই ক্ষুব্ধ রাজ্যপাল এবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মঙ্গলবার রাজভবনে ডেকে পাঠান। রীতিমতাে চিঠি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে তলব করেন তিনি। যদিও রাজভবনে মুখ্যমন্ত্রী যাবেন কিনা তার কোনও স্পষ্ট উত্তর না দিয়ে রাজ্যপালকে কড়া ভাষায় চিঠি লেখেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিকে মুখ্যমন্ত্রীর চিঠির দ্রুত প্রাপ্তি স্বীকার করে রাজ্যপালও পাল্টা চিঠি লেখেন নবান্নে।

অন্যদিকে রাজ্য-রাজ্যপালের সংঘাত নতুন নয়। অতীতে একাধিক ক্ষেত্রে রাজ্যের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। সােমবার এনআরসি নিয়ে এই রাজ্যের বিক্ষোভ পরিস্থিতির ওপর একটি সামগ্রিক রিপাের্ট চেয়ে মুখ্যসচিব ও ডিজিপিকে রাজভবনে তলব করেছিলেন রাজ্যপাল। কিন্তু তারা দেখা না করায় টুইটারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন রাজ্যপাল। তিনি টুইট করে লেখেন, ‘রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গুরুত্ব সহকারে বিচারের জন্য মঙ্গলবার রাজভবনে মুখ্যমন্ত্রীকে নিজের সময়মতাে আসতে বলেছি’। শুধু তাই নয়, তিনি আরও লেখেন, মুখ্যসচিব ও ডিজিপির তরফে কোনও প্রত্যুত্তর পাওয়া যায়নি এখনও পর্যন্ত। এই ঘটনা ‘দুর্ভাগ্যজনক’ ও ‘কোনও মতেই মেনে নেওয়া যায় না’ বলে মন্তব্য করে আরও একটি টুইট করেন রাজ্যপাল। তাঁর কথায় ডিজিপি ও মুখ্যসচিবের থেকে কোনও উত্তর না পাওয়ার ঘটনা ‘আশ্চর্যজনক’।

পুরাে ঘটনায় রাজ্য-রাজ্যপালের মধ্যে নতুন সংঘাতের তৈরি হয়েছে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, মঙ্গলবার কি রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করতে রাজভবনে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী?


একদিকে যখন রাজ্যের প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন রাজ্যপাল তখন রাজ্যপালের অবস্থান নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তােলেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। তিনি বলেন, রাজ্যপাল নিজে সাংবিধানিক গণ্ডি নিয়ে ওয়াকিবহাল নয়। সেজন্য লঘু মন্তব্য করছেন। পাশাপাশি সােমবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শান্তি মিছিল প্রসঙ্গে এই তৃণমূল সাংসদ বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি সত্ত্বা রয়েছে। তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পাশাপাশি সর্বভারতীয় তৃণমূলের চেয়ারম্যানও। সােমবার তৃণমূল নেত্রী হিসাবে পথ হেঁটেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান তিনি।

পাশাপাশি রাজ্যপালের বিরুদ্ধে তােপ দেগে সৌগত রায় জানান, এই রাজ্যে হরেন বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে গােপাল কৃষ্ণ গান্ধির মতাে রাজ্যপাল পেয়েছেন অতীতে। রাজ্যের কিছু সিদ্ধান্তের সঙ্গে অনেক সময় তাদের মতের অমিল হয়েছে। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেউই বর্তমান রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের মতাে লঘু মন্তব্য করেননি বলে জানান সৌগত রায়। পাশাপাশি রাজ্যপালের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজ্যের পরিস্থিতি সামাল দেওয়া এখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাথমিকতা।

এদিন রাজ্যপালকে চিঠি লেখেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লেখেন, রাজ্য সরকার এবং রাজ্যের শীর্ষ আধিকারিকদের সমালােচনা করে আপনি যে ঘন ঘন সাংবাদিক বৈঠক ও টুইট করছেন তা দেখে আমি খুব মর্মাহত। আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন দেশজুড়ে যা চলছে তার প্রভাব পড়েছে এই রাজ্যেও। যারা রাজ্যের শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করতে চাইছে তা নিয়ন্ত্রণ করাটাই রাজ্য প্রশাসনের কাজ। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় রাজ্য সরকারকে সহযােগিতা করাটাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু কোনও ভাবে উস্কানি মূলক কিছু করে শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্ট করা উচিত নয়। এরকমই শব্দ বন্ধে রাজ্যপালকে চিঠি লিখেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

রাজ্যপালের নাম না করে তাঁকে খোঁচা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, আমি মনে করি শান্তি ও সদ্ভাবের পরিবেশ বজায় রাখতে রাজ্য সরকারের পাশে থাকাটাই সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা। বিশেষ করে যারা শৃঙ্খলার পরিবেশ নষ্ট করতে চাইছে তাদের উস্কানি না দেওয়াটাই কর্তব্য। প্ররােচনা নয়, দয়া করে শান্তি রক্ষায় সহযােগিতা করুন। রাজ্য সরকারের সমালােচনামূলক আপনার বারবার বিবৃতি ও সংবাদ মাধ্যমে সমালােচনা দেখে আমার খারাপ লাগছে। মুখ্যমন্ত্রীর চিঠির শেষ লাইনগুলি যে রাজ্যপালকে নিশানা করে তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। রাজ্যপালও নবান্নের চিঠি পাওয়ার আধঘন্টার মধ্যেই পাটা চিঠি পাঠান।

তাতে তিনি লেখেন, আপনার চিঠি পেয়েছি। চিঠিতে যেভাবে আপনি তির্যক উক্তি করেছেন তা পড়ে আমি বিস্মিত শুধু নই, প্রচন্ড মর্মাহত হয়েছি। আপনি যা বােঝাতে চেয়েছেন তার সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল নেই। তাই অনুরােধ করছি আপনি আত্মসমীক্ষা করুন। এখানেই থেমে থাকেননি রাজ্যপাল। তিনি আরও লিখেছেন, আপনাকে আমি মনে করিয়ে দিতে চাই যে সাংবিধানিক এক্তিয়ারের মধ্যে থেকেই আমি সুচিন্তিত ভাবে কিছু পদক্ষেপ করেছি। লক্ষ্য একটাই শান্তি, সদ্ভাব ও আইনের শাসন যাতে বজায় থাকে। এর জন্যই বহুবার সাধারণ মানুষ ও সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।

ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন রাজ্যপালও লিখেছেন, খুব কম সময় হয়েছে রাজ্যপাল পদে এসেছি। কিন্তু আপনার মন্ত্রীরা যেভাবে আমার সম্পর্কে গালমন্দ করে ভরিয়ে দিয়েছেন তাতে আমার অমর্যাদাই হয়েছে। আমার সাংবিধানিক পদের গুরুত্ব ভুলে যাওয়া হয়েছে। সেই বিষয় এবং সংবিধানের ১৬৬ ও ১৬৭ ধারার অমর্যাদা করা নিয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কিন্তু কোনও জবাব পাইনি। বর্তমান সংকটজনক যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা আমাকে রাজ্য সরকারের কোনও স্তরের কেউই জানাননি।

সবশেষে রাজ্যপাল শেষ করেছেন এই বলে যে, যাক এসব নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করতে চাই না। বরং জনস্বার্থে দুজনে মিলে সমন্বয় করে চলতি হিংসার পরিস্থিতি থেকে মানুষকে রেহাই দিয়ে শান্তি কায়েম করি। এটাই আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে রাজ্যপাল আরও আশাবাদী যে আগামী কালের মিটিংয়ের ব্যাপারে আপনার কাছ থেকে ইতিবাচক জবাব আশা করছি।

সবমিলিয়ে নবান্ন ও রাজভবনের পত্ৰযুদ্ধ এখন কোন দিকে মােড় নেয় এখন সেটাই দেখার। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, প্রথমে মুখ্যসচিব ও ডিজিপিকে ডেকে রাজ্যপাল তাদের কাছ থেকে পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই দুই রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষস্তরের আধিকারিক রাজ্যপালের ডাকে সাড়া না দেওয়ায় রাজ্যপাল সাংবিধানিক ক্ষমতা বলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জরুরি ভিত্তিতে ডেকে পাঠান। মুখ্যমন্ত্রীও রাজভবনে যাবেন কিনা তা নিয়ে ধোঁয়াশা রেখে চিঠি দিয়ে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে তিনিও তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন।