শেখ শাহজাহানকে গ্রেপ্তারে সবুজ সঙ্কেত দিল হাইকোর্ট

Written by Subhash Pal February 26, 2024 1:53 pm

কলকাতা, ২৬ ফেব্রুয়ারি: গতকাল অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৎপরতায় সক্রিয় হল আদালত। শেখ শাহজাহানের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করল। সন্দেশখালি কাণ্ডে শেখ শাহজাহানকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে আজ সবুজ সঙ্কেত দিল কলকাতা হাইকোর্ট। আজ প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যর ডিভিশন বেঞ্চ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, শাহজাহান শেখের গ্রেপ্তারিতে আদালতের কোনও বাধা নেই। পাশাপাশি সন্দেশখালি মামলায় শাহজাহানকে যুক্ত করারও নির্দেশ দিল আদালত। এই নির্দেশের ফলে সাত দিনের মধ্যে শাহাজাহান গ্রেপ্তার হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আজ সন্দেশখালির নারী নির্যাতনের ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত মামলার শুনানি ছিল। সেই মামলায় হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছে, মূল অভিযুক্ত শেখ শাহজাহানের গ্রেপ্তারিতে আদালত কোনওরকম স্থগিতাদেশ দেয়নি। অতএব শেখ শাহজাহানকে গ্রেপ্তার করতে রাজ্য পুলিসের কোনও বাধা নেই। শুধু তাই নয়, আদালত এদিন এই মামলায় শেখ শাহজাহানকে যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। এজন্য সংবাদমাধ্যমে পাবলিক নোটিস জারি করার নির্দেশ দিয়েছে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ।

আজ মামলার শুনানিতে রাজ্যের এডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত দাবি করেন, ওই এলাকায় গত চার বছর ধরে যৌন নিগ্রহের মোট ৪৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। সেগুলির মধ্যে পুলিশ ৪৭টি মামলায় ইতিমধ্যেই চার্জশিট দিয়েছে। বাকি মামলাগুলির তদন্ত চলছে। সেই সঙ্গে এডভোকেট জেনারেল দাবি করেন, গত ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত জমি কেড়ে নেওয়ার ঘটনায় মোট সাতটি মামলা দায়ের হয়েছে। পরবর্তীতে সন্দেশখালি থানার পুলিশ আরও ২৪টি এফআইআর রুজু করেছে। বিষয়টি শোনার পর উদ্বেগ প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম। তিনি বলেন, ‘এটা খুবই বিস্ময়কর যে, চার বছর ধরে রাজ্য পুলিশ সবই জানতো। অথচ ব্যবস্থা নিতে চার বছর সময় লাগলো। এটাও খুব আশ্চর্যের যে, রাজ্য ইতিমধ্যেই জমি ফেরতের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এর দ্বারাই প্রমাণ হয়, ওই এলাকায় আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও রাজ্য এতদিন চুপ করে ছিল!’

এদিকে ওখানকার যে মহিলারা নিগৃহীত হয়েছেন, তাঁরা পুলিশের কাছে অভিযোগ লিখতে যেতে ভয় পাচ্ছেন বলে দাবি করেন বিরোধী পক্ষের আইনজীবী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল। তখন প্রধান বিচারপতি আশ্বাস দিয়ে বলেন, পরবর্তীতে রাজ্য লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটির মাধ্যমে শিবির করা হবে। সেই শিবিরে ওই নিগৃহীত মহিলাদের অভিযোগ শোনা হবে। একই সঙ্গে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ আদালত বান্ধব জয়ন্ত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়কেও সন্দেশখালির সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। আগামী ৪ মার্চ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত বুধবার তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, শাহজাহানের গ্রেপ্তারির ক্ষেত্রে ‘অন্তরায়’ আদালত। কোর্টই পুলিশের হাত-পা বেঁধে দিয়েছে। অভিষেক বলেছিলেন, ‘‘শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে রাজ্য সরকার। ইডি তাঁকে ধরতে পারেনি। কিন্তু কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা গিয়ে রাজ্য পুলিশের ওই এফআইআরের বিরুদ্ধে আদালত থেকে স্থগিতাদেশ পেয়েছে। ফলে পুলিশের হাত-পা বেঁধে দিয়েছে আদালতই।’

গতকাল রবিবার মহেশতলায় গিয়েও সেই একই কথা বলেন অভিষেক। এরপর চাপে পড়ে যায় আদালত। আদালতের অবস্থান নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। সেই জট কাটাতে আজ সোমবার কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম মামলার শুনানির সময় বলেন, ‘‘স্পষ্টভাবে বলছি, পুলিশকে কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি। ইডির মামলায় সিট গঠনের উপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছিল। আমরা পুলিশকে বলিনি যে, গ্রেপ্তার করা যাবে না।’’

এব্যাপারে আজ তৃণমূলের মুখপাত্র ও রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘আদালতের ব্যাপারে সাধারণত কেউ কিছু বলেন না। অপ্রিয় প্রশ্নটা তুলেছিলেন অভিষেক। তিনি বলার পরেই আদালতকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। তাই মামলা নির্ধারিত না থাকলেও স্বতঃপ্রণোদিতভাবে সোমবার মামলাটি ওঠে।’’ তৃণমূল পুরনো রায়ের ৭ এবং ৮ নম্বর অনুচ্ছেদ দেখিয়ে দাবি করছে, আদালত স্পষ্টই বলেছিল, রাজ্য পুলিশকে সংযত থাকতে হবে। তারা কোনও প্রক্রিয়া করতে পারবে না।

প্রসঙ্গত রবিবার মহেশতলায় অভিষেক বলেন, যেখানে পার্থ, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের মতো নেতাদের দল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে; সন্দেশখালি কাণ্ডে যেখানে পুলিশ শিবুপ্রসাদ হাজরা, উত্তম সর্দারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; সেখানে শেখ শাহজাহানকে গ্রেপ্তারে কোনও সমস্যার কথা আসে না। শাসকদল তাকে আড়াল করার চেষ্টা করছে বলে যে অভিযোগ বিরোধীরা করে আসছে, সেই অভিযোগকেও নস্যাৎ করে দেন তৃণমূলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, শেখ শাহজাহানের আড়ালের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। কলকাতা হাইকোর্ট শেখ শাহজাহানের মামলায় স্থগিতাদেশ দিয়েছে। সেজন্য রাজ্য পুলিশ কোনও পদক্ষেপ করতে পারছে না।

এদিকে সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে আজ পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রীকে বিঁধলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামানিক। তিনি আজ বলেন, যদি মমতা শাহজাহানকে গ্রেপ্তার করতে না পারে, তাহলে কেন্দ্র সরকারের সাহায্য নিক রাজ্য। তিনি আরও দাবি করেন, শেখ শাহজাহানকে এক ঘন্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করার সামর্থ আছে রাজ্য সরকারের। এব্যাপারে রাজ্যকে সম্পূর্ণভাবে সাহায্য করতে প্রস্তুত কেন্দ্র। বাহিনী সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত আছে।

প্রসঙ্গত গত ৫ জানুয়ারি ইডি আধিকারিকরা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে অভিযানে গিয়ে আক্রান্ত হন। এরপর ঘটনা পরম্পরায় উঠে আসে একাধিক তথ্য। শাহজাহান ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতাদের দুর্নীতি নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেন এলাকাবাসীরা। শুরু হয় দফায় দফায় বিক্ষোভ ও আক্রমণ। শিবু, উত্তম সহ একের পর এক তৃণমূল নেতাদের বাড়িতে হামলা চালানোর মতো ঘটনা ঘটে। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় পোল্ট্রি ফার্ম ও আলা ঘরে। আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়া ও ক্রমবর্ধন হিংসার ঘটনায় পদক্ষেপ নিতে শুরু করে পুলিশ। হিংসা থামাতে ও এলাকায় শান্তি বজায় রাখতে দফায় দফায় বিভিন্ন অঞ্চলে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। কিন্তু মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে থামানো যাচ্ছে না।

গতকাল রাজ্যের দুই মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক ও সুজিত বসু এলাকায় গিয়ে মানুষের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। সূত্রের খবর, তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন আর এক বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতা অজিত মাইতি। তাঁকে দেখতে পেয়ে গ্রামের মহিলারা আক্রমণ করেন। তিনি একজন সিভিক ভলান্টিয়ারের বাড়িতে আশ্রয় নেন। দিনভর সেই বাড়িতে গ্রামবাসীদের বিক্ষোভ চলে। প্রায় পাঁচ ঘন্টা পর গ্রামবাসীদের দাবি মেনে দিনের শেষে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আজ সোমবার ফের উত্তপ্ত হয় সন্দেশখালির বেড়মজুর এলাকা। একাধিক অভিযোগে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য শঙ্কর সর্দারের বাড়িতে হামলা চালায় গ্রামের বিক্ষুব্ধ মহিলারা। ভাঙচুর করে তার বাড়ি।