দীপাবলিতে বাজি পোড়ানোর কারণে বাতাসে দূষণ বেড়ে যায় মারাত্মকভাবে। দূষণ মারাত্মকভাবে বে়ড়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন শরীরে নানা সমস্যা দেখা দেয়, তেমনই ক্ষতি করে ফুসফুস বা হৃদযন্ত্রের। বাজির বিষাক্ত ধোঁয়া শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, কাশি, গলা ব্যথা এবং বুকে চাপ ধরার মতো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। সুস্থ শিশুরাও শর্ট ব্রিদিং, ক্লান্তি অনুভব করা বা কাশিতে কষ্ট পেতে পারে। এই সমস্যা যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় বা বারবার সমস্যাগুলি ফিরে আসে তবে তা ফুসফুসের কার্যক্ষমতায় বাধা দেয়। সেক্ষেত্রে অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের রোগ দেখা দিতে পারে। তাই বাজি পোড়ানো থেকে শিশুদের দূরে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানের অনারারি সিনিয়র কনসালট্যান্ট, শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আশা মুখার্জী।
দীপাবলি আলোর উৎসব। কিন্তু বাজি পোড়ানোর থেকে যে আলোর ফুলকি দেখে আমরা আনন্দে মেতে উঠি, তার থেকে শুধু আলোই নয়, প্রচুর ধোঁয়া, ধুলো এবং বিষাক্ত গ্যাসও বের হয়, যা শিশু বা বয়স্ক সবার জন্যই ক্ষতিকারক। বাজি পোড়ালে একদিকে যেমন সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড-এর মতো বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়, তেমনই, লেড, মার্কারি, ক্যাডমিয়াম-এর মতো হেভি মেটালসও নির্গত হয়। শিশু বিশেষজ্ঞ আশা মুখার্জী জানালেন, এই ক্যাডমিয়াম থেকে হাঁপানি, ফুসফুসের রোগ যেমন হয়, তেমনই কিডনিরও ক্ষতি করে থাকে। লেড বা সীসা থেকে পেটে ব্যথা , মাথাব্যথা, স্মৃতিশক্তির সমস্যা, বা নার্ভের সমস্যাও হতে পারে। একইভাবে মার্কারি থেকে ফুসফুস বা কিডনির ক্ষতি হতে পারে। এছাড়াও এটি দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণ শক্তির ক্ষতি করে থাকে। মার্কারি বা পারদ কিডনির কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে, রক্তে বিষাক্ত পদার্থ জমিয়ে দিতে পারে।
চিকিৎসক জানাচ্ছেন, অনেক শিশুর ক্ষেত্রেই অ্যাজমার সমস্যা আগে থেকেই থাকে। সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড শিশুদের শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করে। শিশুদের ওজন কম থাকে, ফলে তাদের ক্ষতি হয় বেশি। আশা মুখার্জী জানালেন, অ্যাজমায় এমনিতেই বড় শহরে বহু শিশু ভুগে থাকে। দীপাবলিতে বেশি দূষণের কারণে অ্যাকিউট অ্যাজমার সমস্যা দেখা দেয়। গলায় ব্যথা বা ইরিটেশন হয়। যাদের অ্যাজমার সমস্যা রয়েছে তাদের ফুসফুসের ক্ষতি হতে পারে। তারা কষ্টও আরও বেশি পায়।
একেবারেই ছোট শিশুদের ক্ষেত্রেও নানা সমস্যা দেখা দেয়। ৬ মাস থেকে শুরু ২ বা ৩ বছরের শিশুরা বাজির শব্দে ঘুমোতে পারে না।তাদের মনেও একটা অ্যাংজাইটি সৃষ্টি হয়। শিশুদের বুক ধড়ফড়ের মতো সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়াও একটু বড় শিশুদের ক্ষেত্রে মাথা ঘোরা, গা বমি বমির মতো সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
এর পাশাপাশি বাজি থেকে দুর্ঘটনাও ঘটে থাকে। চিকিৎসক আশা মুখার্জী জানান, এই সময় এমার্জেন্সিতে শিশুদের ভিড় অত্যন্ত বেড়ে যায়।হাতে, পায়ে, চোখে, মুখে এবং বুকে বাজি ফাটার পর তা ছিটকে এসে ক্ষতের সৃষ্টি করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে গভীর ক্ষত হয়। তুবড়ি, ফুলঝুরি, বা রংমশাল অনেক সময় বার্স্ট করে ছিটকে এসে গায়ে, মুখে লাগতে পারে, যার থেকে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
আবার অনেক সময় বাজির শব্দে কানের এমন ক্ষতি হতে পারে যাতে কোনও শিশুর শ্রবণ ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে শ্রবণশক্তি হারিয়েও যেতে পারে। দুর্ঘটনা থেকে চোখেরও মারাত্মকভাবে ক্ষতি হয়। বাজি দুর্ঘটনায় চোখের কর্নিয়াতে ক্ষত সৃষ্টি হয়, রেটিনার ক্ষতি হয় , এমনকি বাজি দুর্ঘটনা থেকে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়েছে এমন উদাহরণও বহু রয়েছে বলে জানান চিকিৎসক।
বাজি পোড়ানোর কারণে কয়েকমাস পরেও শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বাজির মধ্যে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক থেকে চোখের ও নাকের সমস্যা দেখা দিতে পারে। চোখে জ্বালা করা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া এমন নানা ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ঘ্রাণশক্তিরও ক্ষতি করতে পারে বিষাক্ত রাসায়নিক। বাজিতে থাকা ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, সোডিয়াম, পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের মতো ভারী পদার্থ ফুসফুস ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। কার্বন মনোক্সাইড রক্তের হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে মিশে গিয়ে শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বাজি থেকে হৃদযন্ত্রেরও ক্ষতি হতে পারে। রক্তনালী , এমনকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। গবেষণা বলছে, বাজিতে থাকা বিভিন্ন ভারী পদার্থের কণা, যেমন নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং কার্বনের মতো বিষাক্ত এবং দূষণকারী পদার্থগুলি একত্রিত হয়ে শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা অন্যান্য সমস্ত অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে হার্ট অ্যাটাক এবং ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগ দেখা দিতে পারে।
এছাড়াও ক্ষতি হয়ে থাকে ত্বকের। ত্বকের নানা সমস্যা, র্ষাশ দেখা দেয়। চিকিৎসক আশা মুখার্জী জানান, দীপাবলি চলে গেল মানেই দূষণের শেষ নয়। দীপাবলির পরেও অনেক দিন এই সমস্ত দূষিত পদার্থ বাতাসে থেকে যায়। ফলে শিশুদের নানারকম শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
কলকাতার অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ইন্টারভেনশনাল পালমোনোলজিস্ট অ্যান্ড স্লিপ মেডিসিন স্পেশালিস্ট চিকিৎসক দেবোপম চ্যাটার্জি জানালেন শিশুদের শারীরিক ক্ষতি তো বটেই, দীপাবলিতে বাতাসে দূষণের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে তাতে গর্ভবতী মায়েদের বহু ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে গর্ভের সন্তানের এতে ক্ষতি হতে পারে। শিশুর অকাল জন্ম, কম ওজন নিয়ে শিশুর জন্ম হতে পারে, শিশুর শ্বাসকষ্টের সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এর পাশাপাশি ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে যে কোনও বয়সের মানুষের।
চিকিৎসক দেবোপম চ্যাটার্জির কথায়, দীপাবলি আলোর উৎসব। এর উদ্দেশ্য, মানুষের মনের অন্ধকার দূর করে সুস্থ শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো জ্বালানো। কিন্তু সেই আলোর রোশনাই শরীরের অসুস্থতা ও অন্ধকার দিক ডেকে নিয়ে এলে, দীপাবলির মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। ফলে আমাদের সবাইকে একত্রিতভাবে দীপাবলির দুষণ থেকে পরিবেশকে মুক্ত করতে হবে, সুস্থ থাকতে হবে, পাশাপাশি দীপাবলি উৎসবের অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যাপকভাবে প্রচার করে সমাজকেও সুস্থ ও সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে। নয়তো এই উৎসব আলোর বদলে অন্ধকার ডেকে নিয়ে আসবে।