‘এভারগ্রিন’ সুব্রত চলে গেলেন এমন আলোর দিনে অন্ধকার নেমে আসবে ভাবতে পারিনি: মমতা

সুব্রত মুখােপাধ্যায় (File Photo: SNS)

বঙ্গ-রাজনীতিতে নক্ষত্র-পতন। প্রয়াত হলেন পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ৭৫ বছর বয়সে তার জীবনাবসান হল। কালীপুজোর দিনেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। পুজোঅন্ত প্রাণ ছিলেন এই রাজনীতিবিদ। বৃহস্পতিবার রাত ৯ টা ২২ মিনিটে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয় তৃণমূলের এই বর্ষীয়ান নেতার।

সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের শারীরিক অবস্থা সঙ্কটজনক শুনে বাড়ির কালীপুজো ছেড়ে হাসপাতালে ছুটে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেও সুব্রতদাকে বাঁচানো গেল না। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে রীতিমত শোকস্তব্ধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

তৃণমূল সুপ্রিমো বলেন, ‘কালীপুজোর দিন এত আলোর দিনে এত অন্ধকার নেমে আসবে ভাবতে পারিনি সুব্রতদার শেষযাত্রায় আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। সুব্রতদার মরদেহ আমার পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। আমি অনেক দুর্যোগ দেখেছি।


কিন্তু সুব্রতদার মৃত্যু আমার কাছে অনেক বড়ো দুর্যোগ। আমি কিছু বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই। এত হাসিখুশি একজন মানুষ। পরিবার, নিজের বিধানসভা কেন্দ্র, দল, ক্লাব-অন্ত প্রাণ একজন মানুষ। আর কেউ এমন হবেন না আমি গোয়া থেকে ফিরেই হাসপাতালে আসল ।

সেদিনও আমার সঙ্গে দেখা হল। হাসল। বলল আমি আবার জেলায় জেলায় যাব। সন্ধ্যেয় বলল ভালো আছেন। কালকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যেই বিরাট হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল । কিছু করা গেল না।’ শুধু রাজনৈতিক সাংগঠনিক অভিজ্ঞতার নিরিখেই নয়, এই বর্ণময় চরিত্রের জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গ-রাজনীতি হারাল তার অন্যতম প্রিয় সন্তানকে।

সুব্রত মুখােপাধ্যায় এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (File Photo: SNS)

ইন্দিরা গান্ধির প্রিয়, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সীর স্নেহধন্য, সোমেন মিত্রের সতীর্থ সুব্রত মুখোপাধ্যায় চলে গেলেন। তার দুই অগ্রজ, তার মধ্যে প্রিয়রঞ্জন আগেই চলে গিয়েছিলেন। সোমেন মিত্র চলে গিয়েছিলেন বছরখানেক আগে। এই নিয়ে মন খারাপ ছিল তার। এবার তিনিও চলে গেলেন। বঙ্গ রাজনীতিতে ষাটের দশকে যে তিন দামাল ছেলে কাঁপিয়ে রাখত রাজনীতিকে, সেই সোনালি অধ্যায়ের শেষজন আজ চলে যাওয়ায় বঙ্গ রাজনীতিতে শূন্যতা নেমে এলো।

(File Photo: SNS)

১৯৪৬ সালের ১৪ জুন বজবজ এলাকার সারেঙ্গাবাদে জন্ম তাঁর দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজের সারেঙ্গাবাদ থেকে ষাটের দশকে কলকাতায় এসেছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ভর্তি হয়েছিলেন বঙ্গবাসী কলেজে অ্যানথ্রোপলজি নিয়ে। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বঙ্গবাসী কলেজে পড়ার সময় কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি।

সেই সুত্রেই ঘনিষ্ঠতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সীর সঙ্গে। সত্তরের দশকে প্রিয় সুব্রত জুটি হয়ে উঠেছিল বাংলার ছাত্র রাজনীতিতে চর্চিত নাম। প্রিয়দার ডানহাত ছিলেন তিনি। ইন্দিরা গান্ধির প্রিয়পাত্র হলেও ভোটে জিতে কোনও দিন দিল্লির রাজনীতিতে যাওয়ার ছাড়পত্র পাননি সুব্রত। রাজ্যস্তরের নেতা হয়ে থেকে যাওয়া এই নেতা দিল্লি কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে স্নেহের বন্ধনে জড়িয়ে গিয়েছিলেন, যা সত্যিই বিরল।

১৯৭১ সালে ২৫ বছর বয়সে টালিগঞ্জ থেকে প্রথমবার দাঁড়িয়ে জয়ী হন। ওই সময় তিনি কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছাত্র পরিষদের সভাপতি হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে বালিগঞ্জ থেকে জিতে তিনি সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভার সদস্য হন। জরুরি অবস্থার বিতর্কিত পর্বে সুব্রত ছিলেন রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের দায়িত্বে।

তিনি ছিলেন বাংলার রাজনীতিতে এখনও পর্যন্ত সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী। এই রেকর্ড এখনও কেউ ভাঙতে পারেননি। ২০০০ সালে কংগ্রেস ছেড়ে তিনি তৃণমূলে যোগ দেন। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি ছিলেন কলকাতা পুরসভার মেয়র। মেয়র পদে থাকার শেষের দিকে মমতার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে তার। তিনি নিজের মঞ্চ গড়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে পুরভোটে লড়েন।

‘ঘড়ি’ চিহ্নে পুর ভোটে লড়েন তিনি। তিনি জিতলেও তাঁর দল কিন্তু হেরে যায়। ফলে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের আর কলকাতার মেয়র পদে ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে ফিরে যান তিনি। কার্যনির্বাহী সভাপতি হন কংগ্রেসের। ২০১০ সালে তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন ঘটে তার। সেই থেকে আমৃত্যু তিনি তৃণমূলেই ছিলেন।

(File Photo: SNS)

২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার গঠন হলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী করেন। টানা তিনবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভায় সুব্রত মুখোপাধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রী ছিলেন। সুব্রত মুখোপাধ্যায় বাম-বিরোধী রাজনীতি করলেও সর্বস্তরের বাম নেতাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল।

সত্তরের দশকে যাঁদের হাত ধরে বাংলার ছাত্র রাজনীতি এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছিল সুব্রত তাদেরই একজন। কলকাতায় এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করার সময় তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন গড়িয়াহাট এলাকার একডালিয়া এভারগ্রিন ক্লাবের সঙ্গে। ১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্লাবটি ‘সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ক্লাব’ নামেই পরবর্তীতে পরিচিতি পায়।

তিনি একডালিয়ার দুর্গাপুজোকে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য মাত্রায়। এই পুজো এখনও থিমের স্রোতে গা ভাসায়নি। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বিশ্বাস ছিল পুজোর আসল গরিমা যেন ম্লান হয়ে না যায় থিমের কারণে। একডালিয়াকে তিনি পুজো প্রতিযোগিতার দৌড়ে না রেখে সাবেকি পুজোতেই সারা জীবন এভারগ্রিন রাখতে চেয়েছিলেন।

সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু বাংলার রাজনীতিতে অপুরণীয় ক্ষতি’ বলে মন্তব্য করেছেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য। সুব্রতর পরে কলকাতার মেয়র হয়েছিলেন বিকাশবাবু। সেই তিনি এদিন সুব্রতবাবুর প্রয়াণের পর বলেন, ‘রাজনীতির মতভেদ থাকলেও ব্যক্তিগত স্তরে উনি কখনও বিদ্বেষকে প্রশ্রয় দেননি। যেটা এঁর চরিত্রের বড় দিক। আমি ওঁর পরে মেয়র হয়েছিলাম। সেই সময় তিনি আমাকে নানা পরামর্শ দিয়েছিলেন।

বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘দক্ষিণপন্থী রাজনীতির অনুসারি হলেও আমাদের মধ্যে আদর্শগত মতপার্থক্য ছিল। ওঁর রাজনৈতিক জীবন সত্যিই ঈর্ষণীয়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর যোগ্যতাসম্পন্ন নেতা ছিলেন উনি তাদের মধ্যে অন্যতম।

শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় আশঙ্কাজনক অবস্থায় রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে এসএসকেএম হাসপাতালের আইসিইউ-তে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। বাড়িতে কালীপুজো চলছে। তারই মাঝে সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে দেখতে এসএসকেএম গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিলেন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও অরূপ বিশ্বাস।

উল্লেখ্য, গত আগে বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে কয়েকদিন এসএসকেএম হাসপাতালের আইসিইউ-তে ভর্তি হয়েছিলেন মন্ত্রী। তার ধমনীতে স্টেন বসানোর পরও শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। জানা যাচ্ছে, বাথরুমে যাওয়ার সময় তিনি পড়ে গিয়েছিলেন। তারপরই হার্ট অ্যাটাক হয় বর্ষীয়ান এই মন্ত্রীর। প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকে চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়। আইসিইউ-তে স্থানান্তরিত করার পরে তাঁর শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়।

সম্প্রতি হৃদযন্ত্রের দুটি আর্টারিতে ব্লকেজ ধরা পড়ায় এসএসকেএম-এ অ্যানজিওপ্লাস্ট হয় সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের। তারপরে শরীরিক অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু আজ ফের তার অবস্থার অবনতি হয়। জানা যাচ্ছে, এদিন ফের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে সুব্রতবাবুর।

উল্লেখ্য, গত ২৫ অক্টোবর সকালে বাড়িতে অসুস্থ বোধ করেন এই বর্ষীয়ান মন্ত্রী । তড়িঘড়ি তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সরোজ মণ্ডলের তত্ত্বাবধানে তিনি ভর্তি ছিলেন।

সুব্রত মুখোপাধ্যায় কলকাতার একডালিয়া এভারগ্রিনের পুজোর মূল উদ্যোক্তা। অন্যান্য বারের মতো এবারও এই পুজো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রী। পুজোর সময় শারীরিক ধকল পড়েছিল। তার প্রভাবে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় বলে মনে করা সুব্রতর প্রয়াণে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী।

তিনি এক শোকবার্তায় জানিয়েছেন, ‘সুব্রত মুখার্জির প্রয়াণে বাংলার রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হল তা পুরণ হওয়ার নয়। শোকপ্রকাশ করেছেন কলকাতা পুরসভার মেয়র তথা মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।

সেচমন্ত্রী ড সৌমেন মহাপাত্র শোক প্রকাশ করে বলেন, ‘মেদিনীপুরের সঙ্গে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের নিবিড় যোগাযোগ ছিল। সম্প্রতি বাংলা যখন বানভাসী হয়, তখন তিনি মেদিনীপুরে এসেছিলেন। সেই সময় তার সঙ্গে অনেক কথা হয়। এরকম বর্ণময় চরিত্র বঙ্গ রাজনীতিতে সচরাচর দেখা যায়নি।’

রবীন্দ্র সদনে আজ শুক্রবার তার মরদেহ শায়িত থাকবে সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ২ টো পর্যন্ত। এখানে প্রয়াত মন্ত্রীকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হবে। দুপর ২ টোর পর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে বালিগঞ্জ কেন্দ্রের বিভিন্ন স্থানে ও গড়িয়াহাটে শেষবারের মতো তার বাড়িতে। সেখান থেকে তার প্রিয় ক্লাব একডালিয়া এভারগ্রিন যাবেন তিনি। শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে।