ভেঙে পড়ল বহুতল, মৃত ৯

Written by SNS March 19, 2024 12:17 pm

নিজস্ব প্রতিনিধি– রবিবার রাত প্রায় ১২টা৷ সারাদিনের ব্যস্ততার পরে রাতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সকল‌েই৷ হঠাৎ করেই বিকট শব্দে কেঁপে উঠল গোটা এলাকা৷ মুহূর্তের মধ্যে ঘন অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারিদিক৷ তবে অন্ধকার ভেদ করে ভেসে আসছিল ভয়ের আত্মনাদ৷ সকলেই বুঝতে পারলেন কিছু একটা ঘটেছে৷ তড়িঘড়ি করে বেরতেই চক্ষু চড়ক গাছ সকলের৷ ভেঙে পড়েছে এলাকার নির্মীয়মাণ বহুতল৷ বহুতলের ইট, কাঠ, পাথরের তলেই চাপা পড়ে গিয়েছেন অনেকেই৷ তাঁদের মধ্য থেকে ইতিমধ্যেই মৃতু্য হয়েছে ৯ জনের৷ মৃতের তালিকায় যেমন রয়েছে ৬০ বছরের বৃদ্ধ ঠিক তেমনই রয়েছে ১৯ বছরের তরতাজা তরুণ৷ নির্মীয়মাণ বহুতলটি যার উপরে আঁছড়ে পড়েছে, এ দিন রাত পর্যন্তও সেটি ছিল এক আস্ত ঝুপড়ি৷ কিন্ত্ত বর্তমানে তার অবস্থা দেখে ঘটনার ভয়াবহতা নি:সন্দেহে বোঝা যায়৷

সোমবার সকালে এলাকা পরিদর্শনে যান সদ্য মাথায় আঘাত প্রাপ্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়৷ সঙ্গে ছিলেন দমকল মন্ত্রী সুজিত বসু, পুরো মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম৷ বহুতলটি যে বেআইনি ভাবে নির্মীত হচ্ছিল তা প্রকাশ্যেই বলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়৷ তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও বলেন তিনি৷
এই ঘটনার পর গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রোমোটারকে৷ গার্ডেনরিচের ফতেপুর ব্যানার্জি বাগান লেনে রবিবার রাত সাডে় বারোটা নাগাদ পাঁচতলার একটি নির্মীয়মান বহুতল ভেঙে পডে়৷ ওই বহুতলটি পাশের ছোট ছোট টালির চালের ঘরের উপর হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পডে়৷ বসতি টালির চাল ভেঙে অন্তত দুজনের তৎক্ষণাৎ মৃতু্য হয়৷ ধ্বংসস্তুপের তলায় আটকা পরে বেশ কয়েকজন৷ ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় এনডিআরএফ, পুলিশ এবং দমকল৷ জোর কদমে শুরু হয় উদ্ধার কাজ৷ রাতভর দুর্ঘটনাস্থলে দাঁডি়য়ে উদ্ধার কাজ তদারকি করেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম৷ সোমবার ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷

মুখ্যমন্ত্রী জানান, ঘিঞ্জি এলাকায় বেআইনি নির্মাণের জন্যই ঘটেছে এই দুর্ঘটনা৷ ঘটনাস্থলে দাঁডি়য়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দোষীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন৷ আর মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে এই গ্রেফতার হন ওই নির্মীয়মান বাডি়টির প্রোমোটার মহম্মদ ওয়াসিম৷ মেয়র ফিরহাদ হাকিম স্পষ্টই জানিয়েছিলেন ওই বহু দলটি নির্মাণের কোনও অনুমতি ছিল না৷ যে বা যারা এই ঘটনার সঙ্গে জডি়ত, তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে এফআইআর দায়ের করেছিল পুরসভা৷ মুখ্যমন্ত্রীও জানিয়েছিলেন, ‘‘এই এলাকা অত্যন্ত ঘিঞ্জি৷ এগুলো একদিনে তৈরি হয়নি৷ বছরের পর বছর ধরে তৈরি হয়েছে৷ আমি সবটা ঘুরে দেখেছি৷ আমাদের পুলিশ টিম, মন্ত্রীরা সকলেই কাজ করেছে সারারাত৷ আমি মেয়রকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, এই বহুতল নির্মাণের অনুমতি ছিল কিনা৷ ও জানাল, না ছিল না৷

বেআইনিভাবে নির্মাণ হচ্ছিল৷ সেই কারণেই এটা ঘটলো৷ আশেপাশের মানুষজনের বসতির দিকে খেয়াল রাখা হয়নি৷ আমি অত্যন্ত দুঃখিত৷ আমি বলছি, বেআইনি নির্মাণের জন্য এই ঘটনা ঘটল৷ যারা এর সঙ্গে জডি়ত তাদের বিরুদ্ধে করা অ্যাকশন নেওয়া হোক৷’’ এরপরেই গ্রেফতার হন অভিযুক্ত প্রোমোটার৷ কিন্ত্ত ঘটনার পরে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, কে এই প্রোমোটার মহম্মদ ওয়াসিম? তার উত্থান হলই বা কি করে? জানা গিয়েছে সোমবার ওই এলাকা থেকে কলকাতা পুলিশের গুন্ডা দমন শাখার আধিকারিকেরা তাঁকে গ্রেফতার করেন৷ তাঁর বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে৷

স্থানীয় সূত্রে খবর, বছর ৪০ এর মহম্মদ ওয়াসিম গার্ডেনরিচ এলাকার প্রভাবশালী প্রোমোটার হিসাবে পরিচিত৷ শুধু প্রোমোটিংই নয়, তাঁর আরও একটি ব্যবসা বাডি় কেনাবেচার দালালি করা৷ স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন ওয়াসিমের অনুমতি না থাকলে গার্ডেনরিচ এলাকার একটি বাডি়ও বিক্রি হবে না৷ অভিযুক্ত প্রোমোটারকে মোটা অংকের কমিশন দিয়ে তবেই ওই এলাকায় বাডি়র হাত বদল সম্ভব৷ প্রায় দশ বছর ধরে ওয়াসিম গার্ডেনরিচ এলাকায় নিজের রাজত্ব চালাতেন৷ প্রথমে দুধ বিক্রেতা হিসাবেই ওয়াসিমের পরিচয় ছিল৷ তারপরেই ধীরে ধীরে নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসার কাজে নামেন তিনি৷ গার্ডেনরিচ এলাকার বাসিন্দা ফিরোজ নামে এই যুবকের সঙ্গে তিনি এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন৷ এরপর তিনি স্ত্রীর নামে জামাকাপডে়র ব্যবসা শুরু করেন৷

সূত্রের খবর বর্তমানে ওয়াসিম কলকাতা পুরসভার ১৩৪ নং ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর শামস ইকবালের ব্যবসা সামলাতেন৷ দুর্ঘটনাগ্রস্ত নির্মীয়মান বাডি়টি কেবলমাত্র ক্ষমতার জোরে অনুমোদন ছাড়া বানাচ্ছিলেন ওয়াসিম৷ স্থানীয় মানুষেরা আরো জানাচ্ছেন আগেও পাঁচ বছর কারাবাস ভোগ করেছিলেন ওয়াসিম৷ মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশের পরে ওয়াসিমকে গ্রেফতার করে পুলিশ৷ এই নির্মাণের সঙ্গে আর যারা যারা জডি়ত তাদেরও সন্ধান করছে পুলিশ৷ শেষ পাওয়া খবর অনুসারে এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ৯ জনের মৃতু্য হয়েছে৷ মৃতদের নাম আকবর আলি (৩৪), রিজওয়ান আলম (২৩), মহম্মদ ওয়াসিক (১৯), হাসিনা খাতুন (৫৫), শামা বেগম (৪৪), মহম্মদ ইমরান (২৭), রমজান আলি (৬০), নাসিমুদ্দিন শেখ (২৪)৷

তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও নির্মীয়মাণ বহুতল তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে দেখেছে তিলত্তমা৷ ইতিহাস বলছে, ১৯৮৯ সালের ১৯ জুন৷ পুরনো কলকাতার ভবানীপুরে এক বহুতল ভেঙে মৃতু্য হয়েছিল ১১ জনের৷ তারা সকলেই ছিলেন ওই বহুতলর বাসিন্দা৷ যা কলকাতার বুকে আজও এক কালো অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে৷

বহুতল ভেঙে পড়ার সাক্ষী থেকেছে বেঙ্গালুরুও৷ ১৯৮৩ সালে বেঙ্গালুরুর সুবেদার ছত্রম রোডে ‘গঙ্গারাম’ নামে এক সাত তলা নির্মীয়মাণ বহুতল ভেঙে মৃতু্য হয় কমপক্ষে ১২৩ জনের৷ যাদের মধ্যে ছিলেন ওই ভবনের শ্রমিক৷ আহতের সংখ্যা ছিল ১২০৷

২০১০ সালে দিল্লিতে ভেঙে পড়েছিল মাত্র ১৫ বছরের পুরনো ভবন৷ যার কারণ হিসেবে উঠে আসে বন্যার ফলে ভবনের ভিত আলগা হয়ে যাওয়ার মতো কারণ৷ ২০১৩ সালের ঘটনাস্থল মুম্বাই৷ মুম্বাইয়ের মাজাগাঁও-একটি পাঁচতলা ভবন ভেঙে পড়েছিল৷ মৃতু্যর মুখ ঢলে পড়েছিলেন প্রায় ৬১ জন মানুষ৷

বজ্রপাতের কারণে তামিলনাড়ুর চেন্নাইয়ে ভেঙে পড়েছিল ১১তলা এক নির্মীয়মাণ ভবন৷ যার ভয়াবহতা দেখে কার্যত কেঁপে উঠেছিল গোটা দেশ৷ ওই ভবনে বসবাসকারীদের মধ্যে প্রায় ৬১ জনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল৷ কলকাতার এই নির্মীয়মাণ ভবন ভেঙে পড়ার পিছনে উঠে এসেছে পুকুর বুজিয়ে দেওয়ার মতো অভিযোগ৷ তবে খাস কলকাতার বুকে এই অবস্থা হলে রাজ্যের অন্যান্য প্রান্তে ঠিক কী অবস্থা তা এখন প্রশ্নের মুখে৷