ভার্চুয়াল জনসভায় অমিতের নিশানায় কংগ্রেস

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। (Photo: Twitter | @BJP4India)

হিসাব খাতা খুলে বঙ্গবাসীর সামনে রাখলেন বিজেপি প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। অভিযোগ তুললেন বিরোধীপক্ষের হিসেব খাতার গরমিলের দিকেও। কিন্তু অমিত শাহের হিসেব খাতায় সেভাবে গুরুত্ব পেল না আম্ফান ঘূর্ণিঝড় ও করোনা মোকাবিলায় কি কি পরিকাঠামো গড়া হয়েছে তার বিস্তারিত পরিসংখ্যান।

করোনা বাড়ছে দেশজুড়ে। কিন্তু তা বলে কি রাজনৈতিক ময়দানের কার্যক্রম থমকে থাকল। থমথমে অবশ্য ছিল তিন মাসের জন্য। প্রায় তিন মাস পর ফের রাজনৈতিক জনসভা থেকে শোনা গেল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন প্রসঙ্গে বিরোধীদের অবস্থান নিয়ে তীব্র কটাক্ষ, বিধানসভা ভোটের আগে বিরোধিতার কণ্ঠস্বর, তিন তালাকের ইস্যু, রাম মন্দির হচ্ছে হবে এই আশ্বাস, কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তির উপকারিতা ইত্যাদি ইত্যাদি। করোনার প্রসঙ্গ বারকয়েক উঠল ফুল ছড়ানোর, থালা বাজানো এবং রাজ্যবাসীর লাভ এর খতিয়ানের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ হয়ে রইল।

অমিত বক্তের সারমর্ম মোটের ওপর এই— শিয়রে বিধানসভা নির্বাচন। ভার্চুয়াল মাধ্যমে বক্তব্য রেখে বিধানসভা নির্বাচনের বঙ্গবাসীর সমর্থন চাওয়া। মঙ্গলবার বেলা ১১ টার সময় ভার্চুয়াল মাধ্যমে বঙ্গবাসীর উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। রাজ্যজুড়ে প্রায় ৭০,০০০ এলইডি স্ক্রিন লাগিয়ে এই ভার্চুয়াল সভা শোনানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল রাজ্য বিজেপির পক্ষ থেকে।


যদি করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে ২০২১ সালের বিধানসভা ৰ্বিাচনের আগে বাকি মাত্র নয় মাস। বিগত তিন মাসে বিশ্ব তথা ভারতকে জর্জরিত করেছে করোনা মহামারী। এই পরিস্থিতিতে মাঠ ভরিয়ে রাজনৈতিক সভা করা কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। তাই মাঠের বদলেই স্মার্টফোনধারীদের কাছে ভার্চুয়াল জনসভার মাধ্যমে রাজনৈতিক বার্তা তুলে দিতে চাইলেন বিজেপি।

মঙ্গলবার যখন ভারতের করোনা সংক্রমণ আড়াই লাখ ছাড়িয়ে গেছে ঠিক সেইসময় সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন, তিন তালাক ইত্যাদি বিষয়গুলি সামনে রেখে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার শুরু করলেন অমিত শাহ।

বক্তব্যের শুরুতেই লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্য থেকে বিজেপির পাওয়া ১৮ টি আসন তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করে অমিত শাহ। শুরুতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন, বিজেপি এমন সরকার নয় যে ১০ বছর শাসন করলেও কোনো হিসাব জনগণকে তারা দেবে না। জনগণ যখন চাইবেন তখনি সমস্ত হিসেব নিয়ে জনতার দরবারে উপস্থিত হবে বিজেপি।

এরপরেই মোদি সরকারে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের খতিয়ান থাকেন দিতে থাকেন তিনি। একইসঙ্গে আয়ুষ্মন ভারত প্রকল্প কেন এই রাজ্যে চালু হচ্ছেনা! তা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তোপ দাগেন অমিত শাহ। তিনি বলেন, নরেন্দ্র মোদি যাতে কোনোভাবেই বঙ্গবাসীর মধ্যে জনপ্রিয়তা না পায় সেই জন্যই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আয়ুষ্মন ভারত প্রকল্প এই রাজ্যে চালু করতে দিচ্ছেন না। বেশ কয়েকমাস বিরতির পর ফের একবার রাজনৈতিক আলোচনার শীর্ষে উঠে এল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন।

এদিন ভার্চুয়াল জনসভা থেকে অমিত শাহ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়’কে উদ্দেশ্য করে বলেন মতুয়া, নমঃশুদ্র, বাংলাদেশিরা আপনার কি ক্ষতি করেছে। শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দিলে আপনার সমস্যা কি! যখন বাংলাতে নির্বাচন হবে তখন বাংলার জনতা আপনাকে রাজনৈতিক শরণার্থী বানাবে।

করোনা মোকাবিলায় মোদি সরকারের খরচে খতিয়ানের বিস্তর না দিলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে এই মহামারীর মোকাবিলা করছে গোটা দেশ। নিজের বক্তব্যে এমনটাই জানান দেন অমিত শাহ। তিনি বলেন, এর আগেও বহু সরকার মহামারী মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু যেভাবে নরেন্দ্র মোদি পুষ্প বর্ষা করে, থালা বাজিয়ে গোটা দেশবাসীকে একত্রিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা প্রশংসনীয়।

পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে ফেরানো প্রসঙ্গে তৃণমূল সরকারকে নিশানা করে অমিত শাহ বলেন, সব থেকে কম ট্রেন এই রাজ্যে এসেছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার ট্রেনগুলিকে শ্রমিক ট্রেন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে কেন্দ্র। কিন্তু যে ট্রেনগুলি করে মহামারীর সময়ে নিজের আত্মীয় পরিজনের কাছে ফিরছে পরিযায়ী শ্রমিকরা সেই ট্রেনটিকে করোনা ট্রেন বলে আখ্যায়িত করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই করোনা এক্সপ্রেস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একদিন বাংলার বাইরে নিয়ে যাবেন বলে দাবি করেন তিনি।

পাশাপাশি অতীতে বিজেপির জনসভাগুলিকে কেন্দ্র করে রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে যে রাজনৈতিক তরজা হয়েছিল এ দিন সেই ঘটনাগুলিকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বিতর্ক উস্কে দেন অমিত শাহ। তিনি বলেন, এখন আর রাস্তা আটকে, হেলিকপ্টার আটকে সভা আটকানো যাবে না। ভার্চুয়াল মাধ্যমে টেকনোলজির উপর ভিত্তি করে বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছাবে বিজেপি। তৃণমূলের হিংসার পাঁক যত বেশি হবে, তত বেশি বিজেপির পদ্ম ফুটবে রাজ্যে বলেও দাবি করেন তিনি।

এমনকি তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে চড়াতে গিয়ে বাম সরকারের অল্প বিস্তর প্রশংসা করে বসেন অমিত শাহ। তিনি বলেন, বাংলার কিছু মানুষ বলে, এর থেকে তো কমিউনিস্টরাই ভালো ছিল। আম্ফান ঘূর্ণিঝড়ে হওয়া ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বিশেষকিছু না বললেও ত্রাণ দুর্নীতি নিয়ে সরব হন শাহ। বলেন, বাংলার কৃষকদের তালিকা শনিবার কেন্দ্রকে যদি দেয় রাজ্য সরকার সোমবার কৃষকদের অ্যাকাউন্টে ৬ হাজার টাকা পৌঁছে যাবে।

আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বাংলার মানুষ বিজেপিকে সুযোগ দিলে সোনার বাংলা গড়ে দেখাবে বলেও দাবি করেন অমিত শাহ। শেষবেলায় প্রধানমন্ত্রীর সুরে আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য বঙ্গবাসী’কে অনুরোধ করেন তিনি। অমিত শাহ বলেন, স্বদেশী জিনিস ব্যবহার করুন। লোকাল নিয়েই ভোকাল হন।

অমিত শাহের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের দাবি, বাড়ি বাড়ি পরিত পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া, দুর্নীতি, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন, তিন তালাক, রাজ্যে আয়ুষ্মন ভারত প্রকল্প চালু ইত্যাদি বিষয়কে সামনে রেখে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক যুদ্ধে নামবে বিজেপি।

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বঙ্গ উন্নয়নে অর্থ দিয়েছিলেন। কিন্তু শ্রেষ্ঠ নরেন্দ্র মোদিই। মঙ্গলবার ভার্চুয়াল জনসভায় কংগ্রেসকে আক্রমণ করে এই বক্তব্য বারংবার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলেন বিজেপির প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। রাহুল গান্ধি তো বটেই, এদিন তাঁর নিশানায় ছিলেন দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। অমিত শাহ দাবি করেন, মনমোহন সিং তাঁর ৫ বছরের প্রধানমন্ত্রীত্ব কালীন সময়ে রাজ্যকে যে অর্থ দিয়েছিলেন তার পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ৩২ হাজার ৭৬৩ কোটি।

এদিকে তৃণমুল সরকার বিভিন্ন সময়ে একাধিক ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরোধিতায় সরব হয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক তরজার ফলাফল কোন রকম ভাবেই প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আঘাত ফেলতে পারেনি বলেই দাবি অমিত শাহের।

তিনি জানান, মোদি সরকার ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাকে ৪ লক্ষ ৪৮ হাজার ২১৪ কোটি টাকা দিয়েছেন। অর্থাৎ কংগ্রেস থেকে অনেক বেশি অর্থ মোদি জামানায় পেয়েছে বঙ্গবাসী। এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে বাংলার মানুষের মন পেতে চেষ্টা করেন অমিত শাহ।

পাশাপাশি এই দিন রাহুল গান্ধিকে কটাক্ষ করে অমিত শাহ বলেন, যখন দেশের মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে ছিল মোদি সরকার তখন রাহুলবাবা টিপ্পনি কেটে ছিলেন। খালি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দিয়ে কি হবে! এই বলে সুর চড়িয়েছিলেন তিনি। করোনার সময় এই ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলিতেই টাকা পাঠিয়ে সাধারণ মানুষকে সাহায্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সময় যদি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না করা হত তাহলে এই মহামারীর সময় কিভাবে সরাসরি সাধারণ মানুষের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো যেত, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

অর্থাৎ শুধু বাংলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অমিত শাহ বক্তব্য রেখেছেন তা নয়। জাতীয় রাজনীতিকে কেন্দ্র করে এদিন কংগ্রেসকেও তীব্র আক্রমণ করে অমিত শাহ। তাঁর বক্তব্যে একাধিকবার উঠে আসে রাহুল গান্ধির সমালোচনা। মোটের ওপর জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও ভার্চুয়াল মাধ্যমে বিরোধীদের বিরোধিতা করায় একচুল পিছপা হননি বিজেপির ভারতীয় সভাপতি। এখন দেখার এই আক্রমণের ঠিক কিভাবে জবাব দেয় কংগ্রেস।