ঐতিহ্য ধরে রাখতে মরিয়া বর্তমান পৌরপ্রধান অমিত রায়

Written by SNS March 17, 2024 3:55 pm

নিশীথ সিংহ রায়: ১৫৩৭ খৃষ্টাব্দে পর্তুগীজদের দ্বারা হুগলি শহরের প্রতিষ্ঠা, ১৬৩৫ সালে ডাচদের দ্বারা চুঁচুড়া শহরের প্রতিষ্ঠা এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (বৃটিশ) দ্বারা ১৮২৫ সালে এই দুই শহরের সংযুক্তি ও ১৮৬৫ সালে হুগলি-চুঁচুড়া পৌরসভার প্রতিষ্ঠা বা ১৮৫৪ সালের ১৫ই আগষ্ট হাওড়া থেকে হুগলীতে প্রথম রেল চালু এরকম অজস্র ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই পুরাতন ঐতিহ্যবাহী দুটি যমজ শহরের পৌরপ্রধান মাননীয় অমিত রায় মহাশয় আজকে জানাচ্ছেন তাঁর কথা ও তাঁর প্রিয় এই যমজ শহরের কথা৷

আপনি এমন দুটি শহরের পৌরপ্রধান যার একটির নামে জেলা এবং নদী আছে, হুগলি জেলা ও হুগলি নদী এবং এই শহরটি পাঁচশো বছরের পুরানো আর একটি ডাচ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত চারশো বছরের পুরানো এতিহ্যময় চুঁচুড়া শহর যারা একত্রে ‘হুগলি-চুঁচুড়া’ পৌরসভা নামে পরিচিত৷ সেই ঐতিহ্যময় হুগলি-চুঁচুড়া পৌরসভার কর্মকান্ডের কান্ডারী পৌরপ্রধান অমিত রায়ের কাছ থেকে স্টেটসম্যান পত্রিকার মাধ্যমে বঙ্গবাসী শুনবে তাঁর ব্যক্তিগত এবং পৌরসভার সামগ্রিক কাজকর্ম৷

প্রশ্ন : আপনার রাজনীতির অঙ্গনে আসা কীভাবে বা এই ঐতিহ্যপূর্ণ যমজ শহরের চেয়ারম্যান হওয়ার নেপথ্য কাহিনী যদি একটু বলেন৷
অমিত বাবু : প্রথমেই বলি আমার এই ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যপূর্ণ দুই শহরের পৌরপ্রধান হিসেবে উত্থানের কাহিনী৷ সত্যি কথা বলতে কি আমাদের বাডি়র কেউ আগে রাজনীতি করেননি৷ দাদু, বাবা সবাই সরকারি চিকিৎসক ছিলেন৷ আমারও হয়তো ওই পথে যাবার কথা ছিল কিন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী ভূপতি মজুমদার যিনি প্রথম কংগ্রেসী মন্ত্রিসভায় পূর্ত ও সমবায় মন্ত্রী ছিলেন তাঁর আদর্শ এবং কর্মধারায় আকৃষ্ট হয়ে কিভাবে যে রাজনীতির অঙ্গনে চলে এলাম তা আজ আর মনে নেই৷ কারণ, ডাঃ বিধান রায় তখন নতুন করে পশ্চিমবঙ্গ গডে় তুলছেন এবং ভূপতি মজুমদার যেহেতু পূর্তমন্ত্রী তাই তাঁর হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গের সাথে সাথে হুগলি-চুঁচুড়াতেও উন্নয়নের জোয়ার এলো৷ তৈরি হলো চুঁচুড়া হাসপাতাল, সার্ভে কলেজ, ধান্য গবেষণা কেন্দ্র বা জুনিয়র টেকনিক্যাল কলেজ, ওয়ান ওয়ে রাস্তা বা আরও আরও অনেক কিছু৷ মানে আজ যা দেখছেন সবই ভূপতি মজুমদারের দান৷ ভূপতি মজুমদারের জন্য চুঁচুড়ায় এসেছেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি এবং এটাও দেখেছি ভূপতি মজুমদারকে ইন্দিরা গান্ধির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা৷ একাধিকবার এসেছেন ড. বিধান চন্দ্র রায় এবং উনি আমাদের বাডি়তেও গেছেন৷ আরও অবাক কান্ড আমি একবার বীরভূমে তারাপীঠের কাছে বাসেরা বলে একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েছিলাম স্বচক্ষে ভূপতি মজুমদারের কর্মকান্ড দেখবো বলে৷ আমি অবাক হয়ে গেলাম ওখানকার মানুষ যখন জানলেন আমি ভূপতি মজুমদারের জন্মস্থান থেকে গিয়েছি এই ষাট বছর পরেও তখন তাঁদের কি উৎসাহ উদ্দীপনা তা না দেখলে ভাবা যায় না৷ ভূপতি বাবু ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলে তখনকার দিনে গুটি পোকা চাষ করে তার থেকে সিল্ক উৎপাদন করার জন্য সমবায় গঠন করেছিলেন৷ যা এখনও ওখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা৷ তা, এরকম একজন মানুষকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং কংগ্রেস নেতা রবীন মুখার্জীর হাত ধরে কংগ্রেস আসা কিন্ত আমি যে রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জডি়য়ে যাব তখনও তা জানতাম না৷

প্রশ্ন : এবারে শুনবো আপনার দীর্ঘ ৫২-৫৩ বছরের এই রাজনৈতিক চলার পথের কাহিনী—
অমিতবাবু : আমি প্রথমে শান্তিনিকেতনে সোশিওলজি নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম তারপরে বন্ধুদের চাপে পরে ফিরে আসতে হলো এবং ভর্তি হলাম হুগলি মহসিন কলেজে৷ এখানে ১৯৭২ সালে প্রথমে কলেজে ছাত্র পরিষদ ইউনিয়নের এ জি এস পরে জি এস বা সাধারণ সম্পাদক হলাম৷ মানে এবারে একেবারে রাজনীতির ময়দানে চলে এলাম৷ তখন আমাদের আন্দোলনে ঘডি়র মোডে় ভূপতি মজুমদারের মূর্তি বসানো হলো যার উদ্বোধনে এসেছিলেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়৷ এরপর আমি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ছাত্র পরিষদের সম্পাদক হই৷ তখনই আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি এনাদের সংস্পর্শে আসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই দেখেছি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কংগ্রেসে থেকেও কিভাবে একা বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা৷ তারপর তো তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি হল সবার মতো আমিও আমার নেত্রীর সঙ্গেই থাকলাম৷ ২০১০ সাল থেকে আমি হুগলি-চুঁচুড়া পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলাম এবং গত দু’বছর চেয়ারম্যান হিসেবে আছি৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকও করেছিলেন৷ অতএব এটা বলা ভুল হবে না ভূপতি মজুমদারকে দেখে রাজনীতিতে এলেও রাজনীতির অঙ্গনে যা কিছু করেছি সবই আমার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য৷

প্রশ্ন : পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে কোন কোন কাজে অগ্রাধিকার দিলেন?
অমিতবাবু : দেখুন আমার জন্ম এখানে, রাজনৈতিক কাজকর্ম সব এখানে এমনকি বারো বছর ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে থাকার কারণে পৌরসভারও সবকিছুই আমার নখদর্পণে৷ আর হুগলি-চুঁচুড়া যেহেতু খুব পুরানো এবং ঐতিহ্যময় শহর তাই এখানে অনেক ঐতিহাসিক স্থান আছে যার ঐতিহ্য ধরে রাখা এবং রক্ষণাবেক্ষণ খুব জরুরী৷ বঙ্কিমচন্দ্র এখানে যে বাডি়টিতে বসে বন্দে মাতরম গীত রচনা করেছিলেন সেটাকে রক্ষা করা৷ ঘডি়র মোডে়র ঘডি়টা যার আসল নাম ‘এডওয়ার্ডিয়ান ক্লক টাওয়ার’ সেটার ঐতিহ্য ধরে রাখা৷ রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের স্মৃতিতে বৃটিশরা এটিকে ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে এসে ১১০ বছর আগে স্থাপন করেন৷ স্তম্ভটির চারদিকে চারটি ঘডি় রয়েছে৷ আর এই ঘডি় স্তম্ভের উত্তর দিকেই রয়েছে ভূপতি মজুমদারের আবক্ষ মুর্তি৷ রয়েছে হংসেশ্বরী মন্দির, বিখ্যাত ইমামবাড়া বা ব্যান্ডেল চার্চ বা আরও আরও অনেক কিছু৷ এসমস্তের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম৷ আমরা চেষ্টা করছি এই সমস্ত ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য বা হেরিটেজগুলিকে স্বমহিমায় রেখে দেওয়া এবং এজন্য আমাদের যা টাকা প্রয়োজন সবই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রে রাজ্য সরকার দিচ্ছে৷

নাগরিক পরিষেবা উন্নত করার জন্য আমরা সবরকম ব্যবস্থা নিয়েছি৷ এব্যাপারে একটা কথা বলি পশ্চিমবঙ্গের নারীদের জন্য মমতা যা করেছেন স্বাধীনতার পরে কেউ তা করেনি৷ আমরা জানি হুগলি জেলা রাজা রামমোহন রায়ের জন্মস্থান৷ যিনি নারী উত্তোরণের পুরোধা ব্যক্তি৷ আবার ভারতের নারী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তি হিসেবে যিনি পরিচিত সেই বিদ্যাসাগরের জন্মস্থানও এই পশ্চিমবঙ্গ৷ আর স্বাধীনতার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের এমন একজনের নাম বলুন যিনি নারীদের নিয়ে এত ভেবেছেন বা এত প্রকল্প চালু করেছেন যেখানে ধর্ম, বর্ণ বা বয়স নির্বিশেষে সবাই উপকৃত হচ্ছেন৷ আমাদের পৌরসভায় প্রতিটি ওয়ার্ড ধরে ধরে আমরা চেষ্টা করেছি এই প্রকল্পগুলির উপকারিতা যেন সবাই পায়৷ আমি নর্থ এভিনিউতে ইন্দুমতি ভট্টাচার্যফ্ল্যাটে থাকতাম৷ যিনি ইন্দীরা গান্ধী মারা যাওয়ার পর হুগলী লোকসভা আসন থেকে কংগ্রেসের হয়ে প্রথম জেতেন আর তার ঠিক ওপরেই থাকতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তিনি সেই সময় আমাকে রাজীব গান্ধীর কাছেও নিয়ে গিয়েছিলেন৷ ডানলপ কারখানার চরম ডামাডোলের সময় মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আমরা শ্রমিকদের হয়ে লডে়ছি৷ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মস্থানে ‘শরৎ স্মারক তৈরি হচ্ছে৷ আমার এখানে দুটি সরকারি স্কুল আছে এবং ব্রাঞ্চ ও কলেজিয়েট দুটোতেই বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইংরেজী মাধ্যম চালু করেছেন৷ দানবীর হাজী মহম্মদ মহসিন চুঁচুড়া শহরে অনেক কিছু দিয়েছেন তাই বর্তমান হুগলী সেতুর কাছে যেখানে তাঁর নোঙর খানা ছিল সেই জায়গাটিকে হেরিটেজ ঘোষনা করে উন্নয়নের কাজ চলছে এবং যে বাডি়টিতে বসে বঙ্কিমচন্দ্র ‘বন্দে মাতরম’ লিখেছিলেন সেই বাডি়টিকে অসাধু চক্ররা হোটেলে পরিণত করতে চেয়েছিলেন আমরা সেটা রোধ করে তাকে হেরিটেজ বিল্ডিং ঘোষণা করেছি এবং তারও উন্নয়নের কাজ চলছে৷ আমাদের এখানে ডাচেদের স্মৃতিবিজডি়ত অনেক জায়গা আছে যেমন চুঁচুড়া কোর্ট, পুলিশ লাইন বা ডাচ সিমেট্রি সেগুলি আমরা রক্ষণাবেক্ষণ করছি৷ সার্কিট হাউস ছাড়া সরকারি ভাল থাকার জায়গা না থাকায় আমরা রামকৃষ্ণ জলাধারের উল্টোদিকে মিউনিসিপ্যালিটির জায়গায় একটি ভাল থাকার জায়গা তৈরি করতে উদ্যোগ নিয়েছি৷ চুঁচুড়া রবীন্দ্র ভবনের কাছে আমরা একটি আর্ট গ্যালারি ও শুধুমাত্র নাটকের জন্য একটি নাট্যশালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি যেটা আগামী বাজেটে পাশ হলে কাজ শুরু হবে৷ এটা বলতে পারি পুরানো ঐতিহ্যকে ধরে রেখে বা সঙ্গে নিয়ে আমরা হুগলি-চুঁচুড়াকে আধুনিক শহরের চেহারা দিতে বদ্ধপরিকর৷