• facebook
  • twitter
Saturday, 6 December, 2025

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

তাহা আমার মস্তকের উপর ঝুলিতে লাগিল। পিনিস অবশিষ্ট পাল-ভরে ঝড়ে ছুটিতে লাগিল, এবং বোটকে আকৃষ্ট করিয়া সঙ্গে সঙ্গে লইয়া চলিল। যে দুই জন দাঁড়ী পিনিস ধরিয়া আছে, তাহারা আর ঠিক রাখিতে পারে না।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতের পর

তখন তিনি একজন কৃতবিদ্যা বলিয়া গণ্য। তাঁহার বিদ্যা, বিনয় এবং ধর্ম্মভাব দেখিয়া, দিন দিন তাঁহার প্রতি আমার অনুরাগ বৃদ্ধি হইতে লাগিল। অবশেষে তিনি ১৭৬৭ শকে ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ করিলেন। ধর্ম্মভাবে তাঁহার সহিত আমার হৃদয়ের খুব মিল হইয়া গেল। তাঁহাকে আমি উৎসাহী সহযোগী পাইলাম। তখন ধর্ম্ম প্রচারের জন্য যে কিছু ইংরাজী লেখা পড়ার প্রয়োজন, তাহার বিশেষ ভার তাঁহার উপরে দিলাম। কঠাদি উপনিষদের অর্থ আমি তাঁহাকে বুঝাইয়া দিতাম, তিনি তাহা ইংরাজীতে অনুবাদ করিতেন, এবং সে সকল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে প্রকাশিত হইত।

Advertisement

যদিও তাঁহার সাংসারিক অবস্থা তখন ভাল ছিল না, তথাপি তিনি সর্ব্বদা প্রহৃষ্ট থাকিতেন, তাঁহার হাস্যমুখ সর্ব্বদাই দেখিতাম। তখন তিনি আমার সঙ্গের সঙ্গী ছিলেন; তাঁর সঙ্গে ধর্ম্মচর্চ্চা করিতে আমার বড় ভাল লাগিত। আমি তাঁহাকে পরিবারের মধ্যেই গণ্য করিতাম। যখন আমি পরিবার লইয়া বেড়াইতে চলিলাম, তখন রাজনারায়ণ বাবুকে সঙ্গে লইলাম। তিনি সেই বোটে আমার সঙ্গে রহিলেন; পিনিসে আমার স্ত্রীপুত্র-সকল।

Advertisement

উৎসাহ সহকারে আমরা ভ্রমণ করিতে বাহির হইলাম। তখনকার সেই শ্রাবণ মাসের প্রবল স্রোত আমাদের বিপক্ষে; তাহার প্রতিকূলে, অতি কষ্টে, আস্তে আস্তে, চলিতে লাগিলাম। হুগলী আসিতেই তিন চারি দিন কাটিয়া গেল। আর দুই দিন পরে কাল্নাতে আসিয়া মনে হইল, যেন কতদূরেই আসিয়াছি।

এইরূপে চলিতে চলিতে পাটুলি পশ্চাৎ করিয়া এক দিন বেলা চারিটার সময় আমি রাজনারায়ণ বাবুকে বলিলাম, ‘আজ তোমার দৈনন্দিন লেখা শেষ করিয়া ফেল। আজ প্রকৃতির শোভা বড়ই দীপ্তি পাইতেছে, চল, আমরা বোটের ছাদের উপর গিয়া বসি।’ তিনি বলিলেন যে, ‘এখনও বেলার অনেক বাকী, ইহার মধ্যে আমার দৈনন্দিনের জন্য কত ঘটনা ঘটিতে পারে, তাহা কে জানে?’

এইরূপে তাঁহার সঙ্গে কথা বার্ত্তা হইতেছে, এমন সময় দেখি, পশ্চিমের আকাশে ঘটা করিয়া একটা মেঘ উঠিতেছে। তখন একটা ভারী ঝড়ের আশঙ্কা হইল। রাজনারায়ণ বাবুকে বলিলাম, ‘চল আমরা পিনিসে যাই; ঝড়ের সময় বোটে থাকা ভাল নয়।’

মাঝি পিনিসের সঙ্গে বোট লাগাইয়া দিল। আমি সিঁড়িতে পা ঝুলাইয়া বোটের ছাদের উপর বসিয়া আছি, এবং দুই জন দাঁড়ী পিনিসের সঙ্গে মিলাইয়া বোট ধরিয়া আছে। অন্য একটা নৌকা গুণ টানিয়া যাইতেছিল। তাহাদের নৌকার গুণ আমাদের বোটের মাস্তুলের আগায় লাগিয়া গেল। সেই গুণ আমাদের এক জন দাঁড়ী লগি দিয়া ছাড়াইতেছিল। আমি সেই গুণ ছাড়ান দেখিতেছি। যে দাঁড়ী গুণ ছাড়াইতেছিল, সে সেই বাঁশের লগির ভার সামলাইতে পারিল না। তাহার হাত হইতে লগি আমার মস্তকের উপর পড় পড় হইল। সামাল-সামাল রব পড়িয়া গেল, মহা গোল উঠিল।

আমি তখনও সেই মাস্তুলের দিকে তাকাইয়া আছি। দাঁড়ী সাধ্যমত চেষ্টা করিয়া আমার মস্তক বাঁচাইল বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ সামলাইতে পরিল না। লগির কোণ আসিয়া আমার চক্ষুর কোণে চশমার তারের উপর পড়িল। চক্ষুটা বাঁচিয়া গেল, কিন্তু চশমার তার আমার নাসিকা কাটিয়া বসিয়া গেল। আমি টানিয়া চশমা তুলিয়া ফেলিলাম, আর দর দর করিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল। ছাদ হইতে নামিয়া তখন আমি নীচে বোটের কিনারায় বসিয়া রক্ত ধুইতে লাগিলাম।
ঝড়ের কথা মনে নাই, সকলেই একটু অসাবধান। দাঁড়ীরা পিনিস ধরিয়া আছে, এবং সেই অবস্থায় বোট লইয়া পিনিস চলিতেছে। এমন সময় একটা দমকা ঝড় আসিয়া পিনিসের মাস্তুলের একটি শাখা ভাঙ্গিয়া ফেলিল! সেই ভগ্ন মাস্তুলটি তাহার পাল দড়াদড়ি লইয়া বোটের মাস্তুলকে জড়াইয়া তাহার ছাদের উপর পড়িল; সেই খানে আমি পূর্ব্বে বসিয়াছিলাম। এখন তাহা আমার মস্তকের উপর ঝুলিতে লাগিল। পিনিস অবশিষ্ট পাল-ভরে ঝড়ে ছুটিতে লাগিল, এবং বোটকে আকৃষ্ট করিয়া সঙ্গে সঙ্গে লইয়া চলিল। যে দুই জন দাঁড়ী পিনিস ধরিয়া আছে, তাহারা আর ঠিক রাখিতে পারে না।
(ক্রমশঃ)

Advertisement