শোভনলাল চক্রবর্তী
কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজের সেমিনার কক্ষে এক তরুণী চিকিৎসকের ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত মৃতদেহ মিলল। প্রতিবাদরত ছাত্রছাত্রীদের এক জনের হাতের কাগজে দেখা গেল একটি প্রশ্ন— আমাদের দেশে ঘর, বাহির, এমনকি হাসপাতালও তা হলে সুরক্ষিত নয়? এর দায় কার? রাজ্যের প্রতিটি মানুষের মনে এই প্রশ্নটিই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
Advertisement
বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষ, তবে ইতিমধ্যেই এই ঘটনায় নির্যাতন, ধর্ষণ— বস্তুত নৃশংস ধর্ষণ— এবং খুন, সন্দেহের অতীত। ২০১২ সালে দিল্লিতে, ২০১৯ সালে হায়দরাবাদে দুই মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীর ধর্ষণ ও হত্যায় দেশ উত্তাল হয়েছিল, কারণ কর্মরত মহিলাদের নিরাপত্তাহীনতার বহর সকলের সামনে স্পষ্ট হয়েছিল। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীর অপমৃত্যু ততোধিক ভয়ানক দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াল। দিল্লিতে ফিজ়িয়োথেরাপির ছাত্রী, এবং হায়দরাবাদের পশুচিকিৎসকের ধর্ষণ-হত্যার ঘটনা ঘটেছিল বাসে, নির্জন রাস্তায়। কলকাতায় তরুণী চিকিৎসকের দেহ কিন্তু পাওয়া গিয়েছে তাঁর নিজের মেডিক্যাল কলেজের অভ্যন্তরে। মেডিক্যাল কলেজগুলি চিকিৎসক-পড়ুয়ার ঘরবাড়ি, সেখানেই তাঁদের সব চাইতে বেশি সময় থাকতে হয়। সেই পরিসরকে নিরাপদ, কাজ ও বিশ্রামের উপযোগী করে তোলার দায় অবশ্যই কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। সিসিটিভি, নিরাপত্তারক্ষী থাকা সত্ত্বেও যদি সেই নিরাপত্তা না দেওয়া যায়, তবে তা আর কেবল দায় থাকে না, অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়। এই ক্ষেত্রে কলেজ কর্তৃপক্ষ— অপরাধী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অপরাধীর প্রাণদণ্ড দাবি করেছেন। ন্যক্কারজনক এই ঘটনায় ধর্ষণকারী ও হত্যাকারীর কঠিন শাস্তি প্রাপ্য তো বটেই, কিন্তু যেখানে কলেজ কর্তৃপক্ষই এমন ভয়ানক দায়হীনতার অপরাধে অপরাধী, মুখ্যমন্ত্রী সে বিষয়ে কী করছেন?
Advertisement
প্রশ্নগুলো নেহাত সহজ। কেন একটি অসুরক্ষিত সেমিনার কক্ষকে মহিলা-চিকিৎসকদের বিশ্রামের জায়গা বলে নির্ধারণ করা হয়েছিল? কেন সেখানে সিসিটিভি-র মতো প্রাথমিক নিরাপত্তার ব্যবস্থাও ছিল না? কেন নিরাপত্তা রক্ষীরা টহল দেন না? কেন ছাত্রী ও মহিলা-ডাক্তাররা তাঁদের উপর অহরহ ঘটে যাওয়া শারীরিক নিগ্রহ নিয়ে কথা বললে তা অনুধাবনসহকারে শোনা হয় না? অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা নিয়ে অভিযোগ জানালে কেন কর্মীদের কানাকানি শোনা যায়, চাকরিটা তো রাখতে হবে, বেশি কিছুতে না জড়ানোই ভাল? কার বা কাদের প্রশ্রয়ে ঘটে এই সব দৈনন্দিন অপরাধ? হাসপাতালের অভ্যন্তরে চিকিৎসক আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা অকস্মাৎ ঘটে না। কর্তৃপক্ষের দীর্ঘ দিনের শিথিলতার সুযোগ নিয়েই ঘটে। রোগীর আত্মীয়দের হাতে আক্রান্ত হন জুনিয়র ডাক্তাররা। আছে দালালচক্র, কলেজ কর্তৃপক্ষের উপরে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছড়ি ঘোরানো, কর্মচারীদের মধ্যে দলীয় বাহুবলীদের উপস্থিতি। কর্তৃপক্ষ এক অনড়, অনমনীয় মনোভাব নিয়ে থাকেন। কারও কোনও প্রস্তাবকে গুরুত্ব দেওয়া, কোনও অভিযোগের সারবত্তা স্বীকার করাকে অধ্যক্ষ, সুপাররা যেন দুর্বলতা বলে মনে করেন।এই মনোভাবটি রাজনীতির। মেডিক্যাল কলেজের প্রশাসনে তার অনুপ্রবেশের ফলে ছাত্রছাত্রী, চিকিৎসকরাও আজ কলেজ কর্তৃপক্ষের ‘প্রতিপক্ষ’ হয়ে উঠেছে। তরুণ চিকিৎসক, নার্স ও রোগীদের বিপন্নতা বাড়ছে।
রাজনীতির প্রভাব পুলিশ-প্রশাসনের উপরেও। না হলে কী করে ঘটনাটির যথাযথ তদন্তের আগেই মেয়েটির মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে আখ্যা দিলেন পুলিশ কর্তা? এ রাজ্যে যে কোনও গুরুতর নারী-নির্যাতনের ঘটনাকে লঘু করে দেখানোর যে জঘন্য চেষ্টা, আবারও তাই ঘটল। হাঁসখালির কিশোরী, সন্দেশখালির গৃহবধূ থেকে কলকাতায় কর্মরত চিকিৎসক, সকলের ক্ষেত্রেই সত্য ঘটনার প্রকাশের চাইতে শাসক দলের তৈরি বয়ানকে সত্য বলে চালানোর চেষ্টাই বেশি। এই অপচেষ্টাকে সর্বশক্তিতে পরাভূত করা চাই।মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, আর জি কর কাণ্ডের অপরাধীরা দ্রুত ধরা পড়বে। শুনে প্রাথমিক ভাবে আশ্বস্ত লাগতে পারত। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর জানা দরকার, তাঁর রাজ্যে এমন কথায় ‘কোনও এক কারণে’ এই মুহূর্তে অধিকাংশ নাগরিকই আশ্বস্ত বোধ করেন না। রাজ্যের সর্বোচ্চ নেত্রী ও কর্ত্রী যখন তদন্তে গতি আনার কথা বলেন, অভিযুক্তের চরম শাস্তির কথা বলেন, তার পরও আশ্বাসের এত অভাব হয় কেন?
এই প্রশ্নের ভিত্তিটি খুঁড়ে দেখলে অনেক কিছু মিলবে। কিন্তু প্রথমেই বলা জরুরি, যে পুলিশ-প্রশাসনের হাতে কয়েকটি গুরুতর দিনে তিনি এই তদন্তের ভার ছেড়ে রাখছিলেন, তার উপর রাজ্যবাসীর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। আর জি কর ঘটনায় ইতিমধ্যেই যা যা ঘটে গিয়েছে, তাতে সংশয়ের বিস্তর জায়গা যে রাজ্য প্রশাসনের তরফে সত্য খুঁজে বার করার থেকে সত্যকে চাপা দেওয়ার চেষ্টাটাই বেশি। এক তরুণীর উপর নৃশংস অত্যাচারের নানা প্রমাণ চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও কেন এই ঘটনাকে প্রথমেই আত্মহত্যা বলে বর্ণনা করা হল? হাসপাতাল অঙ্গনে ঘটে যাওয়া তরুণী ছাত্রীর এমন নৃশংস হত্যা দেখেও কেনই বা কর্তৃপক্ষ গোড়ায় মৃতার দায়িত্বের কথা তুললেন? কেন তদন্ত ভাল ভাবে শুরুর আগেই এক জনই হত্যাকারী বলে দাবি করা হল?
পুলিশ কেন একাধিক বার নিজেদের পুরনো বক্তব্য সংশোধন করল— সে কি বেগতিক দেখে? পুরনো বক্তব্য কি পেশ করা হয়েছিল কোনও চাপে পড়ে? কার চাপ, কত ‘বড়’ সেই চাপ? কাকে বাঁচানোর চাপ? সে চাপ কি এতই বড় যে, অধ্যক্ষকে সরিয়ে দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে আবার অন্য হাসপাতালের শীর্ষকর্তা হিসাবে বহাল না করে উপায় থাকে না? এই চাপ কি রাজ্যবাসীর অচেনা বলে মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী? কী ভাবে তিনি আশা করছিলেন, তাঁর আশ্বাসবাক্যে মানুষ ‘ভুলবেন’? কী ভাবে রাজ্যবাসী বুঝতেন যে মৃতার পরিবারের উপর কিংবা অভিযুক্ত ব্যক্তির উপরও ‘চাপ’ কাজ করছে না?এই আশ্বাসের হিমালয়সমান অভাব আজ পশ্চিমবঙ্গের বাস্তব, যে কারণে সিবিআই তদন্তের ভার নেওয়ায় হাঁপ ছাড়ছেন রাজ্যবাসী।
আর জি কর ঘটনা আবারও বুঝিয়েছে, এই রাজ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে ঘরের ছেলেমেয়েরা যখন পড়তে বা কাজ করতে যায়, তারা কতটা অনিরাপদ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মেনে নিতে হবে যে, নিরাপত্তাবোধের এই অভাব, প্রশাসনের প্রতি এই আশ্বাসহীনতা তিনি ও তাঁর সরকার গত এক দশকে যত্নসহকারে তৈরি করে তুলেছেন। রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, দলপোষণ, স্বার্থলোভ, রাজনৈতিক ফন্দি: এ সবের বাইরে গিয়ে তাঁর পুলিশ কোনও ‘নিরপেক্ষ’ তদন্ত করতে পারে, তা আজ আর বিশ্বাস্য নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর হত্যারও যে কোনও বিচার ও শাস্তিই হয় না, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগিং-কাণ্ডই তার যথেষ্ট প্রমাণ। রাজ্য জুড়ে ডাক্তাররা যে কাজ বন্ধ রেখে উষ্মা প্রকাশ করছেন, তার অন্তর্নিহিত গুরুত্ব সরকারকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে, পশ্চিমবঙ্গকে তাঁরা কোথায় নিয়ে গিয়েছেন যে ভারতের অন্যত্রও ডাক্তারদের বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। অবশ্যই, কেন্দ্রীয় সরকার অহরহ যে প্রতিষ্ঠানকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে, সেই সিবিআই-ও স্বার্থনিরপেক্ষ নয়।
তবে আশা করা যায়, এমন একটি দুঃস্বপ্নসম কাণ্ডের অপরাধীদের আড়াল করার জন্য যে ‘সিস্টেম’ সদাসচেষ্ট বলে অনুমান, সেই সিস্টেম-এর বাইরে থেকে তারা কাজ করবে। কলকাতা হাই কোর্টের রাজ্য প্রশাসনের প্রতি কঠোর ভর্ৎসনাও মনে করিয়ে দেয়, যখন শাসনবিভাগ অপদার্থ, দুর্নীতিপরায়ণ এবং অপরাধ-প্রশ্রয়কারী, বিচারবিভাগই একমাত্র ভরসা। তবে, রাজ্য না কেন্দ্র, সরকার না বিরোধী, এই তরজার রাজনীতি এই মুহূর্তে বিবমিষা উদ্রেককারী। এখন একমাত্র কাম্য, সম্পূর্ণ সত্যের উদ্ঘাটন। অপরাধী যে বা যারা, তাদের দ্রুত ও কঠোর বিচার ও শাস্তি।
Advertisement



