• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

ফেরে কি ফেরে না

নিয়তি রায়চৌধুরী পুরনো দেয়ালঘডি়তে বারোটি শব্দ গুনে গুনে— শুনে নিয়ে আর না পেরে উঠে পড়লেন অবিনাশবাবু৷ কিন্ত্ত উঠেই বা কী করবেন! বাডি় শুনশান৷ লাস্ট ট্রেনও চলে গেছে৷ শহরতলির রাস্তাঘাট জনবিরল হয়ে এসেছে৷ জানলা দিয়ে উঁকি মেরে নীচের রাস্তায় একটি কুকুরকে কাঁদতে শুনলেন৷ একজন ঠেলাওয়ালার অন্যের বারান্দায় গামছা বিছিয়ে নিশ্চিন্তে নিদ্রায়োজন, তাও দেখলেন৷ ভাবলেন, রাত্রির এই

নিয়তি রায়চৌধুরী

পুরনো দেয়ালঘডি়তে বারোটি শব্দ গুনে গুনে— শুনে নিয়ে আর না পেরে উঠে পড়লেন অবিনাশবাবু৷ কিন্ত্ত উঠেই বা কী করবেন! বাডি় শুনশান৷ লাস্ট ট্রেনও চলে গেছে৷ শহরতলির রাস্তাঘাট জনবিরল হয়ে এসেছে৷ জানলা দিয়ে উঁকি মেরে নীচের রাস্তায় একটি কুকুরকে কাঁদতে শুনলেন৷ একজন ঠেলাওয়ালার অন্যের বারান্দায় গামছা বিছিয়ে নিশ্চিন্তে নিদ্রায়োজন, তাও দেখলেন৷ ভাবলেন, রাত্রির এই বোবা চেহারা কী ভয়ঙ্কর অস্থির করে দিতে পারে কখনও কখনও৷
আসলে অবিনাশ বাবু আর কোনোভাবেই নির্ভাবনায় বিছানা নিতে পারছিলেন না৷ শিরদাঁড়ায় এক হিমস্রোত বোধ করছেন৷

Advertisement

গত বছর এমনদিনেই তারক গুপ্তর ছেলে রন্টু ঘরে ফিরল না৷ সারারাতের নিখোঁজ চিন্তা সকালের লাশ হয়ে সামনে এল৷ দলদ্বন্দ্বের আড়াআডি় থাকতে পারে৷ তারকবাবুর বেবাক বখে-যাওয়া ছেলের মর্গফেরৎ সেই দেহ কিছু মানুষের কাঁধে চেপে ঘটনার বিষয়বস্তু হয়ে গেল৷ লাইনের ধারে ছুরি খেয়ে রন্টু উপুড় ছিল রাতভর৷ তার রক্তময় বীভৎস ক্ষতগুলো ফুল আর মালায় গেল ঢেকে৷ প্রতিদিনের গালিগালাজ খাওয়া ছেলে আর ফিরেও বাবার ধার ঘেঁষল না৷

Advertisement

আজও একটা বড়রকমের গণ্ডগোল নাকি হয়ে গেছে কোথায়৷ কে বা কারা যেন কাউকে মায়ের ভোগে পাঠিয়েছে৷ তার মানে, আবারও বদলার শান পড়বে ছুরিতে৷ কথাটা অবিকল এইরকম শুনেছিলেন অবিনাশবাবু৷ বলেছিল কেউ তখন৷ এমন তো হচ্ছেই৷ স্থান কাল পাত্র বিষয়ক কৌতূহলী হননি তেমন৷
অবিনাশবাবুর সরিয়ে রাখা সেই কৌতূহল এখন তীব্র হল৷ মরীয়া করে তুলল তাঁকে৷ চটজলদি জানবার তাঁর কোনও ফোন নেই৷ কোনও কালে একটি ছোট সংস্থায় কাজ করেছেন৷ অবসর নেয়া অবধি ঘরেই থাকেন৷ প্রয়োজনের মুখ্য এখন বড় ছেলে অশোক, তাতেই সব মিটে যায়৷ নিজস্ব ও-বস্তু দরকার হয় না ৷
ভাবলেন, পাশের ঘরে অশোককে একবার ডাকবেন নাকি৷ শুধোবেন কি, অমিত কিছু বলে গেছে কি না৷ পরক্ষণে সামনে নিলেন; সারাদিনের চাকরি-শ্রান্ত অশোক বউছেলের বিছানায় হয়ত সবে চোখ বুঁজেছে— তাঁর এই চিন্তাটা এখনই অমিতের একটি কড়ানাড়ায় নস্যাৎ হয়ে গেলেও যেতে পারে৷ ছেলের ঘুমটা শুধু শুধু ভাঙাবেন! থাক৷…

অমিতের কোনও দলদ্বন্দ্বের খবর তাঁর জানা নেই৷ বন্ধুর সংখ্যা যদিও অগণন ৷ এইসব বন্ধু-বেষ্টনে কে কী করছে, কোন মর্জিতে চলছে, দিনকালের যা হতাশ হাওয়া বাতাস, লেখাপড়া শিখেও কাজকর্ম না পেয়ে কে কার হাতিয়ার হয়ে গিয়ে তালেবর বনে যাচ্ছে— সেসব সংবাদ বাবা-মা পরিবেশকে অবহিত করে গডে় ওঠে না আজকাল৷ মাত্র দুটি স্টপেজের পর রিষড়া৷ পাশেই শ্রীরামপুর, সে নিয়মিত যায়৷ বলে নাকি সদ্য টিউশন জুটেছে৷ অথচ বাড়ির কাছে এখানকার দু’টো টিউশন থেকে জবাব পেয়েছে কামাই করার কারণে৷
এসব কথা অমিতের কাছ থেকে বহু চেষ্টায় নিংড়ে নেওয়া৷ বেশির ভাগ সময় সে উত্তরহীন৷ সংসারে ভূমিকাহীন রুক্ষ এক যুবক৷ এ নিয়ে আশোকের বিরক্তি আছে৷ মধুমিতার অবহেলা আছে৷ আছে বলেই স্ত্রী গত হওয়ার পর মানসিকভাবে খানিকটা দায় অবিনাশবাবুকে নিতে হয়েছে৷ ঢালের মতো ৷ ছোট ছেলে কোথায় গেল, ফিরল কিনা, কখন ফিরবে, খেয়েছে তো— ইত্যাদি৷ ব্যাপারগুলোর ওপর বেশি জোর পড়লে আবার ছেলেবৌমার সঙ্গে সম্পর্কটা কমজোরি হবার আশঙ্কা দেখা দেয়৷

মধুমিতা তার তিনবছরের ছেলেটিকে নার্সারিতে ভর্তি করে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পডে়ছে৷ সমস্ত কাজকথা ফুঁডে় বিশ্ব সংসারে একটি কর্তব্যই তার প্রধান হয়ে ওঠে, সেটা দৌড়তে দৌড়তে ছেলেকে স্কুল দিয়ে আসা আর ছুটি হলে প্রায় লাফ দিয়ে কব্জা ধরে নিয়ে আসা৷ অবিনাশবাবু নিজেও দু’-একবার স্কুল গেছেন ছোট জিৎ-এর আবদারে৷ কাজের মেয়েটিকেও পাঠানো যেতে পারে৷ কিন্ত্ত মধুমিতার সেটা পছন্দ নয়৷ যেজন্য অবিনাশবাবু ধার ঘেঁষেন না৷ তবু যে কীভাবে অমিত ও নাতির মধ্যে তাঁর কর্তব্যের তুলনা এসে পডে় বৌমার কথায়, অবিনাশবাবু বুঝে উঠতে পারেন না৷

এসব যেনেশুনেও তিনি বিকেলের চা খেয়ে হাঁক দিলেন, পরীর মা তো আজ আসেনি বৌমা, দুধের ক্যানটা দাও, আমি নিয়ে আসি দুধটা৷ লেপা-পোঁছা সুতোর মতো ভ্রু-দু’খানিতে ভাঁজ তুলে মধুমিতা বলল, লাইন পেরিয়ে আপনি যাবেন কেন, অমিত গেলেই তো পারে! অবিনাশবাবু অবনত দ্বিধায় বললেন, ও কি এসময় ঘরে থাকে! ওকে কোনোদিন পারতে দেখেছ, তাহলে তো হয়েই যেত….৷ মধুমিতা পাশের ঘরে মুখ ফিরিয়ে অদ্ভুদ হাসল, বলল, পারলেও আপনি ওকে দেবেন না, তাই বলুন! কতদিন আর এভাবে আগলে রাখবেন, বাবা!

লুঙ্গির ওপর ফতুয়া চাপিয়ে অপ্রতিভ অবিনাশবাবু ক্যান হাতে বেরিয়ে গেলেন দুধ আনতে৷ ফিরে এসে ঘরেই নিকিার অমিতকে দেখে অবাক হলেন৷ একটু বিরক্তও৷ অস্বস্তিও বোধ করলেন, বৌমা তাঁর হাত থেকে দুধের পাত্রটি ধরে নিয়ে সরে গেল দেখে৷ পায়ে পায়ে তিনি ছেলের ঘরে ঢুকলেন৷ দাঁড়ালেন কাছাকাছি৷ দেখলেন, তার অন্যমনস্ক শুষ্ক চোখমুখ, দাডি় গজানো চোয়াডে় চোয়াল, সংবদ্ধ দু’হাতের ওপর নামানো৷ তার উপুড় শরীরের ছায়া পডে়ছে দেয়ালে৷ বিষণ্ণ না দূরমনস্ক অমিত, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না৷ অবিনাশবাবুর দৃষ্টি বিভ্রমও হতে পারে৷ নিজের উপস্থিতি জানাতে সামান্য গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, কিরে, ঘরেই আছিস–অথচ রেরোস না, সাড়া দিস না৷ কী ধরনের বেয়াদপি! পরবর্তী কথাগুলো একই রকম বহুব্যবহারে পরিচিত৷ অমিত তার শরীর গুটিয়ে তুলে নিয়েছিল৷ বাকি কথার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল চেনা উদ্ধত ভঙ্গিতে৷

অমিতের কোনও বান্ধবী আছে কিনা জানা নেই তাঁর৷ থাকলে সেটাই স্বাভাবিক এ বয়সে৷ প্রেম ভালবাসার একটা ভালো দিক এই যে, মানুষকে খানিকটা বাঁচতে সাহায্যও করে৷ শিউ বলে একটি মেয়েকে অমিতের সঙ্গে মাঝে-মধ্যে এখানে আসতে দেখতেন৷ দু’জনেই নাকি এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, শুনেছিলেন৷ শ্যামলা পলকা৷ হাসলে গালে গভীর টোল ফুটতো সেই মেয়েটির৷ সবার সঙ্গেই বেশ কথা বলতো৷ মধুমিতার কাছে শুনেছিলেন, শিউর ব্যান্ডেলে বাডি়৷ এর বেশি জানাবোঝার আগে অমিতকে ফের একা হয়ে যেতে দেখলেন৷
অমিত স্টেশনের বাইরে কোথাও গিয়ে থাকলে মাঝপথে হঠাৎ বিকল ট্রেনে অনন্যোপায় হয়ে পড়তে পারে৷ ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কৌশিকের বাডি় শ্যাওড়াফুলিতে মাঝে মাঝে থেকেও যায়৷ একটা ফোন আসতে পারতো তাহলে৷ তিনিও খবরটা ছেলে-বৌমার কাছে নিতে পারতেন৷ এতরাতে নিতে ইতস্তত লাগলো৷ স্থানীয় কিছু বন্ধুদের তিনি চিনলেও এখন তো উপায় নেই৷ দুপুর রাতে বাডি়ফেরা তার কখনও ঘটেনি তা নয়৷ প্রশ্ন করলে উত্তর আসেনি৷ উওর এলেও স্থানীয় কিছু কাজে আটকে পড়া৷ অস্পষ্ট কথটি আধখানা রেখে ঘরে ঢুকে গেছে৷ না ফিরলে চাপা দেওয়া ভাত বাসি হয়েছে৷ না হয় বিড়ালে খেয়েছে৷ সকালে তার দেরি করে ওঠা— আড়াল রেখেছে দাদা বৌদির বিরক্তির ঝাঁজ৷

তবে এভাবে ফেরাও স্বস্তিকর হতো, না ফেরার উদ্বেগের থেকে৷ কিন্ত্ত সমস্ত আন্দাজের বাইরে যেসব ঘটনা ঘটে, যা অঘটন! যা দিনগত চলমানতার ব্যতিক্রম! অতি সহজ সরলরেখার মতো একটি দিন গড়াতে গড়াতে হঠাৎ থমকে গেল৷ ছেৎরে গেল এক মুহূর্তে একটি ভবিতব্য! অবিনাশবাবু ছিটকিনি খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন— প্রায় ছিটকে৷

পাশের বন্ধ কপাটে কড়া নাড়বেন কি! রাত তো ডুবসাঁতারে প্রায় রাত্রির মাঝনদী পেরিয়ে গেছে৷ মধুমিতা আজ ভাত ঢাকা দেয়নি৷ বিড়ালে খাবে বলে মিটসেফে রেখেছে, নাকি কিছু বলে গেছে অমিত! অবিনাশবাবু বড়ই অসহায় বোধ করেন৷ তাঁর অস্থির হাত বিস্তর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত বন্ধ দরজাতেই হুমডি় খেল— অশোক! অশোক রে!

সজাগ ছিল যেন ওঘর৷ যেন সমান উৎকর্ণ, উদগ্রীব৷ দরজা খুলে দাঁড়াল অশোক৷ পাশে মধুমিতা৷ অবিনাশবাবুর উৎকণ্ঠা ভেঙে ভেঙে কেঁপে কেঁপে প্রশ্ন হয়ে উঠবার আগেই অশোক বাবাকে দুই হাতে ধরে বলল, ঘরে যাও বাবা! ওর ফোন নট রিচেবল বলছে৷… এতরাতে কিছু করার নেই৷ অমিত এর মধ্যে ফিরবার হলে ফিরবে—- |

Advertisement