• facebook
  • twitter
Saturday, 13 December, 2025

মোদীজি ও ‘বঙ্কিমদা’

সত্যি বলতে কী, এঁরা কেবল মনস্বী নন, বাঙালির এক আবেগ বিশেষ। এঁদের প্রতি সামান্যতম অবহেলা, অসম্মান বাঙালি কোনোদিনই মেনে নিতে পারে না।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

যে সঙ্ঘ পরিবার বা আরএসএস কোনোদিন স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়নি, ব্রিটিশদের চর হিসাবে কাজ করেছে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে। যারা ব্রিটিশ শাসন-শোষণ, লুণ্ঠনকে ভারতের জন্য আশীর্বাদ মনে করতো, স্বাধীন দেশের জন্য, যাদের কোনও ত্যাগ নেই, তারা আজ হঠাৎ স্বাধীন দেশের সেরা দেশপ্রেমীর মুখোশ ধারণ করেছে। যারা স্বাধীনতাকেই মর্যাদা দেয়নি, জাতীয় পতাকাকে অস্বীকার করেছে, জাতীয় সঙ্গীতকে মান্যতা দেয়নি, সংবিধানকে অবজ্ঞা করেছে, তারা এখন দেশভক্তির জ্ঞান বিতরণ করছে। আসলে মোদী বাহিনীর লক্ষ্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে ইতিহাস বিকৃত করে কল্পনা ও মিথ্যার ভিতের উপর ধর্মান্ধ রাজনীতির ইমারত তৈরি করা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখে উচ্চারিত হতো বন্দে মাতরম, জয়হিন্, ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান। মোদী ও তাঁর পূর্বসূরিরা এইসব স্লোগানের মর্মার্থ বোঝেননি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অন্ধকূপে তাঁরা ঘুরপাক খেয়েছেন। তাই বন্দে মাতরম নিয়ে মোদী বাহিনীর বাড়াবাড়ি হাসির খোরাক জোগাচ্ছে।

সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মেছিলেন ১৮৭ বছর আগে। বঙ্কিমচন্দ্র বন্দে মাতরম রচনা করেছেন ১৫০ বছর আগে। আর ১০০ বছর আগে ধর্মীয় বিভাজন ও সাম্প্রদায়িকতাকে ভিত্তি করে উগ্র ও অন্ধ হিন্দুত্ববাদী আরএসএসের জন্ম হয়েছিল। এই আরএসএসের মতাদর্শের গর্ভেই জন্ম হিন্দু মহাসভা, জনসঙ্ঘ ও আজকের বিজেপির। নরেন্দ্র মোদী যাঁদের হাত ধরে হিন্দুত্ববাদী ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতি শিখেছেন, তাঁর সেই পূর্বসূরিরা কখনও কোনোদিন ভুল করেও ‘বন্দে মাতরম’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন বলে শোনা যায়নি। আজ হঠাৎ বঙ্কিমচন্দ্র রচিত বন্দে মাতরমের প্রতি তাঁর, তাঁর দলের ও তাঁর সরকারের দরদ উথলে উঠেছে। বন্দে মাতরমের প্রতি মোদীর হৃদয়ের আকুতি এতটাই মাত্রাতিরিক্ত যে খোদ রাজধানীর বুকে সরকারি উদ্যোগে সাড়ম্বরে বন্দে মাতরমের শতবর্ষ উদযাপন করে সেখানে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েও তাঁর সাধ মেটেনি, অনতিবিলম্বে সংসদে দু’দিনব্যাপী আলোচনারও ব্যবস্থা করে ফেলেন।

Advertisement

দেশজুড়ে বিমান পরিবহণ বিপর্যয়, ১১ বছরে ডলারের তুলনায় টাকার মূল্য ৬০ টাকা থেকে ৯০ টাকায় নেমে যাওয়া, রাজ্যে রাজ্যে সাধারণ মানুষের এসআইআর যন্ত্রণা, বন্ধু ট্রাম্পের গুঁতোয় বাণিজ্যের ভরাডুবি, লাগাতার ভারতের বাজার থেকে বিদেশি লগ্নি চলে যাওয়া ইত্যাদি হাজারও জরুরি বিষয় নিয়ে সংসদে দশ মিনিট আলোচনারও সময় জোটে না। সেখানে বন্দে মাতরম নিয়ে দু’দিন ধরে আলোচনার শুরুতে মোদী নিজেই এক ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আর সেই বক্তৃতার ছত্রে ছত্রে বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সম্পর্কে নিজের অজ্ঞতা প্রমাণ করলেন। পদে পদে অসম্মানিত ও অপ্রমাণিত করলেন খোদ বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাস্টারদা সূর্য সেন সহ অনেককে। হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আগুনে যথেচ্ছভাবে মিথ্যা, অর্ধসত্য, বিকৃত ইতিহাসকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়েছেন। আসলে যাদের গর্ব করার মতো কোনও ইতিহাস নেই, ঐতিহ্য নেই তাঁরা নিজেদের প্রাসঙ্গিক করতে মিথ্যা ও বিকৃতির আশ্রয় নেবেন, সেটাই স্বাভাবিক।

Advertisement

বিদ্যাসাগরকে ‘মহাশয়’, বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘সাহিত্য সম্রাট’, রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’, বিবেকানন্দ সম্পর্কে ‘স্বামীজি’ আর প্রফুল্লচন্দ্র ও জগদীশচন্দ্রকে ‘আচার্য’ বলে সম্মান জানানো হয়। সত্যি বলতে কী, এঁরা কেবল মনস্বী নন, বাঙালির এক আবেগ বিশেষ। এঁদের প্রতি সামান্যতম অবহেলা, অসম্মান বাঙালি কোনোদিনই মেনে নিতে পারে না। আর সেটাই করে বসেছেন স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাও আবার সংসদের ভিতরেই স্বাধীনতার সম্বোধন করে বসেছেন। তাও একবার নয়, বেশ কয়েকবার। সংসদের গরিমাকে কালিমালিপ্ত করলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।

Advertisement