• facebook
  • twitter
Saturday, 13 December, 2025

প্রহরশেষের রাঙা আলোয়

ধারাবাহিক উপন্যাস

কাল্পনিক চিত্র

তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

২০.
সচকিতা

Advertisement

এসেছি প্রিয়তম, ক্ষমো মোরে ক্ষমো

Advertisement

রবীন্দ্রসদনের প্রবেশপথের ঠিক আগেই বিশাল একটা হোর্ডিং লাগিয়েছে সচকিতা৷
রবীন্দ্রনাথের ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের নবতম রূপায়ণ৷ তিনটি প্রধান নৃত্যধারার সম্মিলন৷ বজ্রসেনের নৃত্য, ভারতনাট্যম ও কথাকলি৷ উত্তীয়র নৃত্য কথকের আদর্শে, শ্যামার নৃত্য প্রচলিত মণিপুরী ভঙ্গিতে৷ বজ্রসেনের গানে তমোনাশ গুপ্ত, শ্যামার গানে সচকিতা রায়চৌধুরি ও উত্তীয়র গানে বিচিত্র লাহা৷ সেই সঙ্গে নৃত্যশিল্পীদের নাম৷ তার নীচে দুটি বিশাল ছবি, একটি তমোনাশ গুপ্তর, অন্যটি সচকিতা রায়চৌধুরির৷ তার নীচে ছোটো করে বিচিত্র লাহার৷

সচকিতার বহুদিন ধরে সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার দিন এই নৃত্যনাট্যের রূপায়ণে৷ তমোনাশ গুপ্তর পাশে এতোদিন সুরঞ্জনা বসুর ছবি থাকত হোর্ডিংয়ে৷ দৃশ্যটা সচকিতার বুকের ভিতর ঈর্ষার পিন খোঁচা দিত বরাবর৷ এবার সেই ছবির ইতি ঘটিয়ে তমোনাশের পাশে সচকিতার ছবি৷ নিশ্চয় কলকাতার রবীন্দ্রসঙ্গীতপ্রিয় শ্রোতাদের ভ্রূযুগলে পড়বে ঈষৎ কুঞ্চন৷ কে এই সচকিতা, তা নিয়ে আলোচনা চলবে কিছু কিছু মহলে৷

সচকিতা জানে, এই অনুষ্ঠানের সাফল্যের উপর নির্ভর করছে তার খ্যাতিও৷
সেই কারণে গত কয়েকদিন তার প্রবল পরিশ্রম গিয়েছে নৃত্যনাট্য ঠিকঠাক প্রস্তুত করতে৷ যেমন, নাচের দলকে তালিম দিতে হয়েছে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা করে, সেই সঙ্গে তৈরি করেছে নিজের গান, আবার তমোনাশ গুপ্তর ফ্ল্যাটে গিয়েছে তাঁর গলায় তুলে দিতে বজ্রসেনের গান৷

তমোনাশ গুপ্তর ফ্ল্যাটে যাওয়ার আকর্ষণই ছিল তার যাবতীয় উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু৷ এমন একজন দীর্ঘদেহী সুদর্শন মানুষের সামনে বসে থাকা, তার সঙ্গে গানের মহলা দেওয়া— প্রতিটি মুহূর্ত ছিল তার উৎসাহের মূল আকর্ষণ৷

সেদিন রবীন্দ্রসদনের প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ৷ সচকিতার গানের স্কুলের খ্যাতি টেনে এনেছে বহু দর্শক৷ রত্নদীপদার হাতযশও কম নয়৷

গায়কদের আসনে তখন তমোনাশের পাশেই বসে সচকিতা, সহসা অনুভব করল তমোনাশের বাঁ-হাতের মুঠোয় তার ডান হাত৷ কী আশ্চর্য ভীষণ গরম তমোনাশের হাত৷ তমোনাশদা কি এই মুহূর্তগুলো উপভোগ করছে?

গ্রিনরুমে তখন নানাবয়সি বহু নৃত্যশিল্পী সাজগোজ করে প্রস্তুত৷ তৃতীয় বেলের পর পর্দা উঠতে সচকিতার বুকের ভিতর মৃদু কাঁপন৷ তার সহকারী চন্দ্রিমা রায় নৃত্যশিল্পীদের উদ্দেশে শেষ মুহূর্তের নির্দেশনায় ব্যস্ত৷ প্রথম দৃশ্যে বজ্রসেন ও তার বন্ধু মঞ্চে অবতীর্ণ, আর মিশ্র (বাউল) রাগে বন্ধুর কণ্ঠে গাইছে এক তরুণ শিল্পী রাহুল সান্যাল :
তুমি ইন্দ্রমণির হার
এনেছ সুবর্ণদ্বীপ থেকে—
রাজমহিষীর কানে যে তার খবর দিয়েছে কে৷
তার নৃত্য সমাপন হলে শুরু মঞ্চে বজ্রসেনরূপী মিমো পালের নৃত্য, আর মঞ্চের এ কোণে উপবিষ্ট তমোনাশের কণ্ঠে গান:
না না না বন্ধু,
আমি অনেক করেছি বেচাকেনা
অনেক হয়েছে লেনাদেনা—
না না না,

দম বন্ধ করে তমোনাশের গান শুনছিল সচকিতা৷ প্রথম গানেই বেজে উঠল তার মন্দ্র কণ্ঠস্বর৷ স্তব্ধ হয়ে শুনছে দর্শক-শ্রোতারা৷ তমোনাশের উপর আজ তার বাজি৷ তার গান ভালোমন্দ হওয়ার উপর নির্ভর করছে সচকিতার জীবনের অনেক কিছু৷

রাজবাড়িতে সেই ইন্দ্রমণির হার বিক্রি করে বন্ধু বাঁচাতে চাইছে বজ্রসেনকে৷ কিন্তু নগরকোটাল খবর পেয়ে লাফিয়ে এসেছে, বজ্রসেনের পেটিকায় কী আছে তা জানতে চায়৷ বজ্রসেন বলছে:
এই পেটিকা আমার বুকের পাঁজর যে রে—
সাবধান সাবধান তুমি ছুঁয়ো না৷ ছুঁয়ো না এরে৷
বজ্রসেন পালিয়ে গেল কোটালের নজর এড়িয়ে৷ কোটালও বলছে, ‘ভালো ভালো তুমি দেখব পালাও কোথা/ মশানে তোমার শূল হয়েছে পোঁতা—’
মঞ্চের নৃত্যশৈলী দেখছে দর্শকরা৷ শুনছে গায়ক-গায়িকার গান৷
পরের দৃশ্যে শ্যামার ঘরে বসে গান গাইছে সখীরা, তখনই প্রবেশ উত্তীয়ের৷ তার ইমন কল্যাণ রাগে গান:
‘মায়াবনবিহারিণী হরিণী/ গহন স্বপন সঞ্চারিণী’
শ্যামার প্রেমে পাগল এক তরুণ উত্তীয়৷ শ্যামার কোনও মোহ নেই তার প্রতি৷ সখীরা তাকে উদ্বুব্ধ করছে মিশ্র ভৈরবী রাগে গান গেয়ে:
জীবনের পরম লগন কোরো না হেলা, হে গরবিনী।
কিন্তু শ্যামা খুঁজে ফিরছে তার যোগ্য কোনও প্রেমিক৷ মিশ্র খাম্বাজ রাগে গাইছে সচকিতা:
ধরা সে যে দেয় নাই, দেয় নাই/ যারে আমি আপনারে সঁপিতে চাই—
গানের সঙ্গে মঞ্চে তখন অভিনয় হচ্ছে৷ স্বপ্নে বিভোর শ্যামার রতি আকাঙ্ক্ষা৷ নৃত্যশিল্পীর নাচের ভঙ্গিমার সঙ্গে সচকিতার কণ্ঠে গান:
…এসো মম সার্থক স্বপ্ন৷ কর মম যৌবন সুন্দর৷
সেই মুহূর্তে কোটাল তাড়া করেছে বজ্রসেনকে৷ ‘ধর চোর ওই চোর, ওই চোর৷’
বজ্রসেন বলছে ‘নই আমি নই চোর, নই চোর নই চোর৷’
ঠিক এমনই মুহূর্তে শ্যামার নজর পড়ল বজ্রসেনের দিকে, অমনি মাথা ঘুরে গেল তার, সচকিতা ইমনকল্যাণ রাগে গাইল:
আহা মরি মরি, মহেন্দ্রনিন্দিতকান্তি উন্নতদর্শন / কারে বন্দি করে আনে/ চোরের মতন কঠিন শৃঙ্খলে৷ শীঘ্র যা লো সহচরী, যা লো যা লো––৷
শ্যামা তখন রূপবান যুবক বজ্রসেনের শরীরী সৌন্দর্যে কামার্ত৷ তুলনায় উত্তীয় তার কাছে বালকমাত্র৷ উত্তীয়র প্রেমে কোনওদিনই সাড়া দেয়নি সে৷
কোটাল তখন বজ্রসেনকে বেঁধে নিয়ে চলে গেল, শ্যামার কাছে সেই দৃশ্য হৃদয়বিদারক৷ হাহাকার করে উঠল সচকিতার কণ্ঠ :
রাজার প্রহরী ওরা অন্যায় অপবাদে
নিরীহের প্রাণ বধিবে বলে কারাগারে বাঁধে৷…

ঠিক তখন প্রবেশ উত্তীয়ের, সে ন্যায় অন্যায় জানে না, শুধু শ্যামাকেই জানে৷ শ্যামার সুখের জন্য সে প্রেমের চরম মূল্য দিতেও রাজি৷ শ্যামা তখন বজ্রসেনের প্রেমে এতই উন্মত্ত যে, উত্তীয়কে সে প্রেম দিতে পারবে, তার বিনিময়ে সে যদি বজ্রসেনের চুরির অপবাদ তুলে নেয় নিজের কাঁধে৷ তাতেই রাজি হয়ে উত্তীয় বলল প্রহরীকে: ‘প্রহরী, ওগো প্রহরী, লহো লহো লহো মোরে বাঁধি৷’
প্রহরী তখন উত্তীয়কে বেঁধে নিয়ে বলল, ‘তুমিই করেছ তবে চুরি৷’
উত্তীয়কে বেঁধে নিয়ে যাওয়র মুহূর্তে শ্যামার বোধোদয় হল, গাইল :
‘থাম রে, থাম রে তোরা, ছেড়ে দে, ছেড়ে দে—
দোষী ও যে নয় নয়, মিথ্যা মিথ্যা সবই, / আমার ছলনা ও যে—’
কিন্তু ততক্ষণে উত্তীয়কে হত্যা করেছে প্রহরীরা৷

মঞ্চে হত্যার দৃশ্যে ঝনাৎ করে শব্দ হতেই শরীর শিরশির করে উঠল দর্শক-শ্রোতাদের৷ সচকিতা অনুভব করল তার হাত চেপে ধরেছে তমোনাশ৷ সে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু উপলব্ধি করছে নৃত্যনাট্যের ভয়ংকরতম দৃশ্যটি৷
পর্দা পড়ে গেল, কিছুক্ষণ ঘোর স্তব্ধতা৷ শুরু হল তৃতীয় দৃশ্য৷ বজ্রসেনের সঙ্গে শ্যামার বার্তা বিনিময়৷ শ্যামা গাইছে :
‘হে বিদেশী, এসো এসো৷ হে আমার প্রিয়,…’
বজ্রসেন তখন মুক্তির আনন্দে মাতোয়ারা, সেই উল্লাসে গাইছে :
‘এ কী আনন্দ, আহা—’
শ্যামার ভিতর তখন উথল দিচ্ছে অনুশোচনা :
‘বোলো না, বোলো না, বোলো না৷
আমি দয়াময়ী৷ মিথ্যা মিথ্যা মিথ্যা৷ বোলো না৷’
বজ্রসেন বলছে: জেনো প্রেম চিরঋণী আপনারে হরষে, / জেনো প্রিয়ে৷
তখন বজ্রসেন আনেন্দ উত্তাল৷ গাইছে :
‘প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে
বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও৷’

এই গানটির মুহূর্তে তমেনাশ বেশ জোরে চেপে ধরল সচকিতার হাত৷ প্রবল উল্লাস তার কণ্ঠে৷ পর্দা পড়ে যাওয়ার পরও হাত ছাড়ল না৷ প্রেক্ষাগৃহে তখন তুমুল হাততালি৷

চতুর্থ দৃশ্যে বদলে গেল আবহাওয়া৷ বজ্রসেন জানে না কীভাবে ঘুচল তার বন্দিদশা, পেয়েছে মুক্তি৷ শ্যামাকে নিয়ে তার মনে অসীম আনন্দ৷ দু’জনে একসঙ্গে গাইছে : ‘হৃদয়ে বসন্ত বনে যে মাধুরী বিকশিল / সেই প্রেম সেই মালিকার রূপ নিল, রূপ নিল /এই ফুলহারে প্রেয়সী তোমারে বরণ করি’ বজ্রসনের মনে তখন বিপুল কৌতূহল: ‘কহ কহো মোরে প্রিয়ে, / আমাক করেছ মুক্ত কী সম্পদ দিয়ে৷’

শ্যামা বলতে চাইছিল না, কিন্তু এই অপরাধ মনকে পীড়া দিচ্ছিল, তাই স্বীকার করল অকপটে৷ বলল : ‘তোমা লাগি যা করেছি/ কঠিন সে কাজ,/ আরো সুকঠিন আজ তোমারে সে কথা বলা৷
সেই কাহিনি শুনে বজ্রসেন স্তব্ধ: ‘কাঁদিতে হবে রে, রে পাপিষ্ঠা’
শ্যামা : ‘ক্ষমা করো নাথ, ক্ষমা করো’
বজ্রসেন : ‘এ জন্মের লাগি তোর পাপমূল্যে কেনা / মহপাপভাগী/ এ জীবন করিলি ধিক্কৃত’৷
শ্যামা : ‘তুমি যদি না করো দয়া / সবে না, সবে না সবে না’৷
বজ্রসেন শ্যামাকে আঘাত দিয়ে দূরে সরিয়ে দেওয়ার পর আবার তাকেই পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে গায়, ‘এসো এসো প্রিয়ে/ মরণ লোক হতে নূতন প্রাণ নিয়ে৷’
বিষাদের কুহেলিকা সরিয়ে যেখানে নতুন প্রাণের মন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে নব্য যৌবন সুখের আশায় কাতর শ্যামার উচ্ছ্বাসকে সচকিতা অসাধারণভাবে ধরেছে তার কণ্ঠে৷
ঠিক তারপরেই যেন শ্যামা ফিরে আসে ছায়ার মতো, ‘এসেছি প্রিয়তম, ক্ষমো মোর ক্ষমো’— প্রেম, অনুতাপ, বেদনা, হাহাকার, ক্লান্তি সব একাকার৷
ঠিক সেই মুহূর্তে আবার চরমে ওঠে বজ্রসেনের প্রতিবাদ ও নীতিবোধের সংঘাত, ‘কেন এলি, কেন এলি’ গানে যেমন উথলে ওঠে নাটকীয়
ঘাত–প্রতিঘাত, তেমনই আকার নিতে থাকে নাচের মুদ্রা৷
একজনের কণ্ঠে বজ্রগম্ভীর স্বরের নাটকীয়তা, অন্যজনের কণ্ঠে বিষাদ৷
আবার বজ্রসেন যখন বলছে, ‘তবু ছাড়িবি না মোরে’, তখন শ্যামার অসহায় কণ্ঠ, ‘ছাড়িব না ছাড়িব না৷’ সচকিতার আকুতি ঝঁকিয়ে দিল শ্রোতা-দর্শকদের৷
বজ্রসেন : ‘ক্ষমিতে পারিলাম না যে / ক্ষমো হে মম দীনতা
পাপীজনশরণ প্রভু৷’

শেষ কলি গাওয়ার রেশ এমন নিবিড় হয়ে ছড়িয়ে গেল সারা প্রেক্ষাগৃহে যে, সবাই বহুক্ষণ নির্বাক৷ তার কিছুক্ষণ পর প্রবল হাততালি বুঝিয়ে দিল সফল হয়েছে সচকিতার এতদিনের পরিশ্রম, আর আকাঙ্ক্ষা৷ পর্দা পড়ে যেতে কতজন দর্শক যে এলেন গ্রিনরুমে, প্রকাশ করলেন তাঁদের উচ্ছ্বাস, প্রশংসা, ভালো-লাগা! রত্নদীপবাবু ছুটে এলেন, একবার সচকিতাকে, একবার তমোনাশকে বললেন আজকের সাফল্যের কথা৷
তমোনাশের মুখে তখন বিস্তৃত হাসি৷
সেদিন শোয়ের পর সচকিতা নিজেই তমোনাশকে পৌঁছে দিতে এল তার ফ্ল্যাটে৷
তমোনাশ বারবার বলল, সচকিতা, তুমি আমাকে নবজীবন দিলে৷
ঘরে ঢুকে সচকিতা প্রকাশ করল তার উচ্ছ্বাস, সজোরে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তমো, আমি এতদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম তোমার মতো একজন পুরুষের জন্য৷

(ক্রমশ)

অলঙ্করণ: সোময়েত্রী চট্টোপাধ্যায়

Advertisement