• facebook
  • twitter
Saturday, 13 December, 2025

আইসক্রিম ও বুম্বার অভিযান

শুনে তো অবাক রাস্কিন বন্ড। তারপর বুম্বাকে আরও কাছে টেনে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, বইয়ের সব কথা বাস্তবে হয় না, মাই সন।

সুতপন চট্টোপাধ্যায়

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

Advertisement

দরজা দিয়ে প্রবল বেগে দমকা বাতাস ঢুকল ঘরের মধ্যে। সকলে প্রায় লাফিয়ে উঠল। নন্দিনী অতনুর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল, অজয় ভাই, ওকে জাগিয়ে দিন। দিয়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিন।
অজয় বলল, তার আগে রেলপুলিশের অফিসার আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে চায়।
—দিন। আমি কথা বলব।

Advertisement

অন্যদিক থেকে গম্ভীর গলায় এক অফিসার জানতে চাইলেন, ডাক নাম, ইস্কুলের নাম, ক্লাস, বাড়ির ঠিকানা। মনে হচ্ছিল তাঁরা খাতা দেখে মেলাচ্ছেন। তাঁরা ধীরে ধীরে প্রশ্ন করছেন। শেষে বুম্বাকে অজয়ের হাতে দেবেন কি না, তার অনুমতি চাইলেন। নন্দিনী সবেরই উত্তর দিলে সেই ভদ্রলোক এবার জানতে চাইলেন, অজয় কীভাবে পরিচিত, কতটা চেনা এবং অজয় তাদের কে হয়?

নন্দিনী বলল, আমার হাজব্যান্ড কথা বলবে, কেননা অজয় তাঁর অফিসের কলিগ। বলে ফোনটা এগিয়ে দিল অতনুর হাতে।

অতনু অফিসারকে বলার আগে তিনি বললেন, দাঁড়ান আপনার বয়ান রেকর্ড হবে। ধীরে ধীরে বলবেন।
অজয়ের নাম, অফিসে তার পদ, কোম্পানি ও তার বসের নাম বলল অতনু। তিনি শর্মাজির ফোন নম্বর জানতে চাইলেন। তারপর চুপ কিছুক্ষণ। কিছু একটা হচ্ছে টের পাওয়া যাচ্ছে। সব শেষে তিনি বললেন, আপনার ভিজিটিং কার্ডটা রাখুন অজয়জি। তাঁরা অজয়ের পরিচয়ের সঙ্গে অতনুর বয়ান মিলিয়ে দেখছিলেন এতক্ষণ।

প্ল্যাটফর্মের উপর একাধিক পুলিশ ও রেলের অফিসারদের দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল বুম্বা। সে ঠিক আন্দাজ করতে পারছিল না, সে কোথায় এসে পৌঁছেছে, এরাই বা কী করতে চায়? লোকে লোকারণ্য। অনেকেই তাদের দিকে সন্দেহের চোখে দেখছে। এখন অনেক রাত, সে এ কোন অচেনা, অজানা দেশে এসেছে? তার চারপাশের লোকজনকেও সে চেনে না। প্রথমে সে ট্রেন থেকে নামতে চায়নি। পরে নিরুপায় হয়ে নেমেছে।
আবার ফোন এল। অজয় বলল, ওরা শর্মাজির সঙ্গেও কথা বলেছে। আমি বুম্বাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে নেবো প্ল্যাটফর্মে। ও আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

হাত থরথর করে কাঁপছে অতনুর। হঠাৎ সুদূর গ্রহ থেকে বুম্বার কন্ঠস্বর, বাবাই, অজয় আঙ্কল বলে একজন আমাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিতে চাইছে। আমি কি নামব? যেন সে অতনুর অনুমতি নিয়েই ট্রেনে উঠেছিল, তাই নামার অনুমতি চাইছে। অতনু বলল, হ্যাঁ, নামো।
বুম্বা আবার প্রশ্ন করল, অজয় আঙ্কলকে তুমি চেনো? সে কে?
অতনু তাকে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলল। তারপর বলল, আজ রাতে তুমি অজয় আঙ্কলের সঙ্গে তাঁর বাড়ি যাবে। আঙ্কল তোমায় তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাবে। কোনও ভয় নেই। কাল সকালে তোমার আর আঙ্কলের সঙ্গে আমার দেখা হবে।
বুম্বা বলল, আচ্ছা।
সেই রাতে অজয়ের বাড়িতে তাঁর মা গরম দুধ খাইয়ে বুম্বাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন।

পরের দিন ভোরে শতাব্দী ধরে লখনউ। পাশাপাশি বসে দু’জনে, তবু কথা নেই। কী প্রবল ঝড় বয়ে গেছে। অতনু আর নন্দিনী লখনউ পৌঁছে দেখে অফিসে বসে আছে বুম্বা, অজয় আর শর্মাজি মিটিমিটি হাসছেন। নন্দিনীকে দেখে বুম্বা দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকের ওপর। তারপর অতনুকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম বলে তুমি কি খুব কষ্ট পেয়েছো?
উত্তর দেবে কী! গলা রুদ্ধ তখন অতনুর।

 

১৫
গরমের ছুটিতে নন্দিনী মুসৌরি বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করল। তার ইচ্ছে ছিল রাস্কিন বন্ডের সঙ্গে দেখা করে তার জীবন্ত রাস্টির গল্প শোনাবে।
বুম্বা রাজি হল না। অতনুকে বলল, বাবাই, আমি যাব না।

অতনু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কেন যেতে চাইছো না? জায়গাটা খুব সুন্দর। ঠান্ডা ঠান্ডা। বেড়াতে খুব মজা লাগবে। তাছাড়া রাস্কিন বন্ড আছেন। তোমার প্রিয় লেখক। দেখা হলে খুব ভালো লাগবে।

বুম্বা বলল, না, ওঁর ভালো লাগবে না। ওঁর রাস্টি তো সমুদ্রের কাছে যেতে পেরেছিল। আমি তো যেতে পারলাম না। সেটা জানতে পারলে উনি হয়ত খুব কষ্ট পাবেন, দুঃখও পাবেন।

নন্দিনী বলল, আমরা তো তোমাকে ফেলে বেড়াতে যেতে পারবো না। তোমাকেও আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। প্রথমে খুব আপত্তি করল বুম্বা। বলল, আমি ক’দিন তোমার বন্ধু ছন্দামাসির কাছে থাকবো। অতনু বলল, না, তা হয় না।
কেন হয় না? বেঁকে বসল বুম্বা।
নন্দিনী বলল, সে তুমি বড় হলে বুঝবে।

মুসৌরিতে সেবার খুব ঠান্ডা। প্রধান রাস্তায় দলে দলে পর্যটক। ম্যালে বুম্বার ইস্কুলের এক বন্ধুর বাবা-মার সঙ্গে দেখা। খুব স্বাভাবিক। দিল্লি থেকে শীতের হাল্কা মেজাজে প্রায় সবাই কাছে পিঠে বেরিয়ে পড়ে। এক বিকেলে রাস্কিন বন্ডের সঙ্গে দেখা করতে গেল অতনু। বুম্বাকে দেখেই চিনতে পারলেন তিনি। দেখেই কাছে টেনে নিলেন। অনেকটা অস্বস্তি কেটে গেল বুম্বার। কথায় কথায় অতনু বলল, বুম্বার বাড়ি থেকে সমুদ্রের দিকে চলে যাওয়ার গল্প।

শুনে তো অবাক রাস্কিন বন্ড। তারপর বুম্বাকে আরও কাছে টেনে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, বইয়ের সব কথা বাস্তবে হয় না, মাই সন। আরও বড় হও, তুমিও যখন আমার মতো লিখতে শুরু করবে, তখন বুঝতে পারবে। তবে তোমার কল্পনা শক্তি আছে। এখন যেখানেই যাবে, বাবা-মার সঙ্গে যাবে। একা যাবে না, কেমন?

তার বছর খানেক পরেই অতনুর বদলির কারণে বুম্বা ফিরে এলো কলকাতায়।

(সমাপ্ত)

Advertisement