কুমারেশ চক্রবর্তী
ভারতবর্ষে মাতৃ সাধনার ইতিহাস সুপ্রাচীন হলেও একটি মানবীয় শরীর মন অবলম্বনে দেবীত্ব ও মাতৃত্বের সমন্বিত পরিপূর্ণ প্রকাশের একটা অভাব এ দেশের অধ্যাত্মজগতে ছিল। জাগতিক মাতার স্নেহমূর্তির সঙ্গে জগদীশ্বরীর মানসকল্পনাকে মিলিয়ে নেওয়ার কোথায় ছিল একটু অস্বাচ্ছন্দ্য।… ভারত তথা জগতের ইতিহাসে সেই অভাব প্রথম পূর্ণ হয় শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিনী সারদা দেবীর আবির্ভাবে। বহুবছর আগে এই উক্তিটি করেছেন দক্ষিণেশ্বর সারদা মঠের সনামধন্য পূজনীয়া মাতাজি প্রব্রাজিকা বেদান্তপ্রাণা। লোকজননী নামক প্রবন্ধের শুরুতে। সারদার শিশু কাল থেকে শেষ বয়স পর্যন্ত আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী, পরে ভক্ত, শিষ্য, সন্ন্যাসী, অস্পৃশ্য দলিত এবং বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা আচরণ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে তিনি সত্যি কারের মা, তিনি সবার মা, তিনি বিশ্ব জননী।
Advertisement
খুব শিশু বয়স থেকেই সারদামণির মাতৃত্বের এই প্রকাশ লক্ষ্য করা গেছে। ছোট্ট বয়সে তিনি তার ভাই-বোনদের মাতৃস্নেহে আগলে রাখতেন। পাড়া-প্রতিবেশীর কাছেও তিনি ছিলেন মাতৃত্বের এক অন্য রূপ। তার পরিবার ধনী ছিল না কিন্তু জয়রামবাটিতে সৎ ব্রাহ্মণ ,ধার্মিক দয়ালু মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন সারদামনির পিতা রামচ্ন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও মাতা শ্যামাসুন্দরী দেবী। একবার আকালের সময় যখন সর্বত্র খাদ্যের অভাব, মানুষ খাদ্যের অভাবে মৃত্যু মুখে পতিত হচ্ছে। তখন মা সারদার বাবা তার সাধ্যের বাইরে গিয়েও প্রতিদিন বিশাল বড় বড় হাঁড়ি কড়াইতে খিচুড়ি রান্না করে ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াতে লাগলেন। এমনকি যখন তার খাদ্যশস্য ফুরিয়ে গেল তখন চাষের জন্য জমিয়ে রাখা শস্য ভান্ডার থেকে তিনি মানুষের জন্য খাদ্য তৈরি করার নির্দেশ দিলেন। এই সময় দেখা গেছে ছোট্ট সারদা ঘুরে ঘুরে ক্ষুধার্ত মানুষদের খাবার সময় তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করছেন। পরবর্তীকালে সারদা দেবী যখন দক্ষিণেশ্বরে চলে এলেন তখন শ্রীরামকৃষ্ণের বেশ খ্যাতি হয়েছে। মা সারদাও পাচ্ছেন বিরল সম্মান ও মর্যাদা। সারদা একবার দুঃখ করে ঠাকুর রামকৃষ্ণকে বলেছিলেন, আমার একটা ছেলে হলো না। তার উত্তরে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন, “তোমার ভাবনা কিসের ? তোমার এমন সব রত্ন ছেলে দিয়ে যাব– মাথা কেটে তপিস্যে করেও মানুষ পায় না। পরে দেখবে, এত ছেলে তোমায় মা বলে ডাকবে, তোমার সামলানো ভার হয়ে উঠবে।”
Advertisement
শ্রীরামকৃষ্ণের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়েছিল শুধু দেশে নয় বিদেশেও বহু মানুষের জননী রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন বিশ্বজননী সারদা দেবী। শুধু মা নয় ঠাকুরও সবসময় তাঁর শিষ্যদের নিজের ছেলে বলেই মনে করতেন। তাই যখন রাখাল (ব্রহ্মানন্দ) বিয়ে করে তার স্ত্রীকে( বিশ্বেশ্বরী) নিয়ে এলেন ঠাকুর তাকে পাঠিয়ে দিলেন মায়ের কাছে এবং বলে দিলেন পুত্রবধূকে টাকা দিয়ে মুখ দেখবে। মা সারদা ছেলের বউকে টাকা দিয়েই মুখ দেখেছিলেন। ঠিক নিজের ছেলের মতই। ভাবতে অবাক লাগে সারদা দেবী তার ভক্ত ছেলেদের জন্য তাদের রুচি অনুসারে খাবার তৈরি করতেন। নহবতে হাজার কাজের মধ্যেও তিনি সকলের খাওয়ার ব্যাপারে নজর রাখতেন। যেমন নরেন খুব ভালবাসতেন মোটা রুটি আর ছোলার ডাল। তাই নরেন এসেছে শুনলেই তিনি তাড়াতাড়ি ময়দা মাখতে বসতেন। খেয়াল রাখতেন কার কী প্রয়োজন।
কলকাতার বিখ্যাত নট নাট্যকার পরিচালক গিরিশ ঘোষ, দোর্দন্ড প্রতাপ তাঁর। কিন্তু মায়ের কাছে গেলেই তিনি হয়ে যেতেন ছোট্ট গিরিশ, মা বলতে অজ্ঞান। একবার গিরিশ জয়রামবাটিতে গেছেন। গ্রামে সব সময় দুধ পাওয়া যায় না। এদিকে মা জানেন কলকাতার ছেলে গিরিশ খুব চা-খোর। ঘুম থেকে উঠেই তাঁর চা চাই। তাই মা, সেই সন্ধ্যায় নিজে বেরিয়ে দুধ জোগাড় করে আনলেন। শুধু তাই নয় গিরিশ আবার সব সময় ধোপদুরস্থ থাকতে ভালোবাসতেন। তাই প্রতিদিন তাঁর বিছানার চাদর পাল্টে ধবধবে সাদা চাদর পাতা হতো। একদিন গিরিশ লক্ষ্য করলেন যে, মা নিজের হাতে সকালে তাঁর বিছানার চাদর সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করছে। নিজের মা ছাড়া এমন কেউ করে? ওই জয়রামবাটিতে থাকাকালীই তিনি মাকে একদিন প্রশ্ন করলেন, তুমি কি রকম মা ? সারদা দেবী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘আমি সত্যিকারের মা! গুরু পত্নী নয়। পাতানো মা নয়। কথার কথা মা নয়। সত্য জননী’। এটা যে কত সত্য সেটা মায়ের সামনে যারা এসেছেন সকলেই জানেন। দক্ষিণেশ্বর জয়রামবাটী বা কলকাতায় সর্বত্রই সারদা দেবী তাঁর সন্ন্যাসীর ছেলেদের পূর্বাশ্রমের নাম ধরেই ডাকতেন। এর কারণ জিজ্ঞেস করাতে তিনি একবার বলেছিলেন, আমি মা কিনা? সন্ন্যাস নাম ধরে ডাকতে প্রাণে লাগে।
শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যেমন জাত, ধর্ম, অর্থ, বর্ণের ভিত্তিতে কোন ভেদাভেদ ছিল না ঠিক অনুরুপ সারদা দেবীও ছিলেন সর্বপ্রকার সংস্কার মুক্ত। তিনিও হিন্দু ও মুসলমান খ্রিস্টান এসব বাছ বিচার করতেন না। কে অস্পৃশ্য কে দলিত কে সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা কে বেশ্যা এটা তার কাছে মোটেই বিবেচ্য ছিল না। কারণ সবাই ছিল তার ছেলে বা মেয়ে এবং তিনি ছিলেন সবার মা। মুসলমান ডাকাত সরদার আমজাদকে মা বুকে টেনে নিয়েছিলেন। একবার আমজাদ অনেকদিন পর জয়রামবাটিতে এলো। দেরির কারণ মা জিজ্ঞেস করাতে আমজাদ বললে, গরু চুরির জন্য জেল খাটছিলাম। মা তখন খুব অসুস্থ। তবুও আমজাদকে বসিয়ে খাওয়ানোর নির্দেশ দিলেন। নলিনী দিদি বাধ্য হলেন আমজাদকে বসিয়ে খাওয়াতে। কিন্তু তিনি তো মায়ের মতন সংস্কারমুক্ত নন তাই দূর থেকে ছুড়ে ছুঁড়ে খাবার দিচ্ছিলেন। মা দেখে বলে উঠলেন, অমন করে দিলে মানুষ কি খেয়ে সুখ পায়? তুই না পারিস আমি দিচ্ছি……! মায়ের কথায় শুনে দিদি ভালো করে পরিবেশন করলেন। কিন্তু খাওয়ার পরে দেখা দিল গোল। সেই জায়গাটা পরিষ্কার করবে কে? মা তাড়াতাড়ি উঠে আমজাদের জায়গাটা নিজের হাতে পরিষ্কার করে দিলেন। নলিনী দিদি বললেন,তোমার জাত গেল। সঙ্গে সঙ্গে মা বললেন, ‘আমার শরৎ (স্বামী সারদানন্দ) যেমন ছেলে, এই আমজাদও তেমন ছেলে’। শুধু আমজাদ নয়, ভক্ত ছেলে মেয়েদের জন্য তিনি সব করতে পারতেন! একবার এক অসুস্থ বৃদ্ধা রাতে তাঁর কাছেই ছিল। কিন্তু ঘুমের মধ্যে বিছানা নোংরা করে ফেলেছিল। পাছে অন্যরা দেখে তাঁকে অপমান করে তাই তাড়াতাড়ি তাঁকে জল খাবার বেঁধে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং নিজে সেই নোংরা বিছানা পরিষ্কার করেছিলেন। এমন সংস্কার মুক্ত, এমন উদারমনা নারী বাংলা তথা ভারতে বিরল। তাই জাত পাত, ধর্ম বর্ণের উর্ধ্বে থেকে তিনি হয়েছেন বিশ্ব জননী। এইসব ব্যাপারে তার মত হল, ‘ছেলেদের জন্য আমার কোন নিয়ম-কানুন ঠিক থাকে না’….. ‘ছেলেদের কল্যাণের জন্য আমি সব করতে পারি’।
সারদা দেবী অতি সাধারণ ভাবে থাকতেন ,অতি সাধারন তার পোশাক আশাক পড়তেন, নিজের কাপড় নিজে কাচতেন, ছিঁড়ে গেলে নিজেই সেলাই করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের কথা অনুসারে চলাফেরা করতেন। কিন্তু তাই বলে তিনি ব্যক্তিত্বহীন ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক সত্যিকারের সাহসী সিংহী মহিলা। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল পাহাড় প্রমাণ। যার পরিচয় ঠাকুর নিজেও পেয়েছেন মাঝেমধ্যে। দক্ষিণেশ্বরে মায়ের কাছে সকলের ছিল অবারিত দ্বার। সম্ভ্রান্ত গরিব দুঃখী ভিখারী দলিত সবাই তার কাছে আসতেন শূন্য মনে। যাবার সময় মন ভরে যেত। একবার তার কাছে এক পতিতা মহিলা এলেন। অতীতে যার দুর্নাম ছিল। কিন্তু এখন সে হরি ভক্ত হয়েছেন। মা তাঁকেও সরাসরি নিজের ঘরে নিয়ে বসালেন, তাঁর পাশে বসে গল্প করলেন এবং তাঁর মুক্তির উপায়ও বাতলে দিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে এটা ভালো লাগলো না। তিনি মাকে ডেকে বললেন, এভাবে মেলামেশা ঠিক নয়। মা সরাসরি বললেন, ‘আমি মা, সবার মা। সতের মা, অসতের মা, আমার কাছে সবাই আসবে। আমি সবাইকেই আশ্রয় দেবো’। আর একটা ঘটনা। শ্রীরামকৃষ্ণকে মা সারদা প্রতিদিন দুবেলা নিজের হাতে খাবার দিয়ে আসতেন এবং বসিয়ে খাওয়াতেন। একবার এক ভক্ত মহিলার ইচ্ছে হলো ঠাকুরকে খাবারটা দিয়ে আসবে। মা তাঁর হাতে খাবারের থালা তুলে দিল। সে গিয়ে ঠাকুরের সামনে থালা রেখে এলো। কিন্তু ঠাকুর তা স্পর্শ করলেন না, কারণ ওই মহিলা শুদ্ধ স্বভাবের ছিল না। ঠাকুর মাকে বললেন, আর কোনদিন কারও হাতে দেবে না বল ? মা বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বললেন, ‘তা তো আমি পারবো না ঠাকুর ! আমায় মা বলে চাইলে, আমি তো থাকতে পারবো না!’ ঠাকুর উপলব্ধি করলেন এর আসল অর্থ। তারপর তিনি আর কোনদিন মাকে এ ব্যাপারে কোনও কিছু বলেননি।
বাগবাজারে থাকাকালে সারদা দেবীর কাছে বহু বিদেশি মহিলা মাঝেমধ্যেই আসতেন। বিস্ময়ের বিষয় মা সারদা সব রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে সংস্কার মুক্ত হয়ে তাদের সঙ্গে সহজ ভাবে কথা বলতেন, তাদের পাশে বসতেন, তাদের সঙ্গে বসে খেতেন। আজ থেকে দেড়শ বছর আগে যা কল্পনা করাও যায় না। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, যে, তিনি বিদেশি প্রথা অনুসারে সেইসব মহিলাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতেন, আবার যাবার সময় তাদের গালে হাত দিয়ে চুমু খেতেন! তাঁর সঙ্গে একবার যারা দেখা করেছে সে-ই সারদা দেবীকে নিজের মা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বিদেশিদের মধ্যে তাঁর একেবারে ছায়া সঙ্গী হয়েছিলেন মার্গারেট বা আমাদের সিস্টার নিবেদিতা। মায়ের সমর্থনেই তিনি যেমন নারী শিক্ষা আন্দোলনে নেমে ছিলেন তেমনই স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। মায়ের জন্যই বহু বহু সশস্ত্র বিপ্লবী বাগবাজারে মায়ের কাছে এবং বেলুড় মঠে আসা যাওয়া করতো। যার মধ্যে বাঘাযতীন, অরবিন্দ, শচীন্দ্রনাথ সেন, রাসবিহারী, অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, সতীশ দাশগুপ্ত (স্বামী সত্যানন্দ) অতুল গুহ (স্বামী অভয়ানন্দ বা ভরত মহারাজ) প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন বেলুড় মঠে বহু বিপ্লবী আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। যার জন্য রামকৃষ্ণ মঠকে বহুবার বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
স্বামী বিবেকানন্দ বহুবার বলেছেন, একদিন ভারত সহ সারা বিশ্বেই ঠাকুর ও মা পূজিত হবেন। সে কথা যে কত বড় সত্য আজ তা প্রমাণিত হয়েছে। তবে মায়ের যে ছবিটি আজ রামকৃষ্ণ মঠ মিশন সহ সারা পৃথিবীতে ঘরে ঘরে পূজিত হয় সেই ছবিটি কিন্তু এক বিদেশিরই তোলা। একবার বাগবাজারে নিবেদিতার বাড়িতে মা থাকাকালীন তিন আমেরিকান মহিলা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। এরা সকলেই স্বামীজির ভক্ত এবং অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত মহিলা। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অত্যন্ত ধনী ভক্ত মিস বুল। তিনি মাকে বললেন, মা আমি তোমার একটা ছবি চাই, দেশে গিয়ে তোমার পুজো করবো। অত্যন্ত দ্বিধা-সহ মা রাজি হলেন। এর আগে সারদা দেবী কখনো ছবি তোলেন নি। ক্যামেরার সামনে এটাই প্রথম। বিখ্যাত ইংরেজ ফটোগ্রাফার হ্যারিংটোন তিনটি ছবি তুললেন। আজ ঘরে ঘরে যে ছবি পূজিত হয় তা এই হারিংটনের তোলা সামনে চুল। আসলে ছবি তোলার সময় মায়ের গা দেখা যাচ্ছিল তাই নিবেদিতার কথায় মা চুলের গোছা সামনে আনলেন। যা আজ ইতিহাস হয়ে গেছে।
Advertisement



