স্বপনকুমার মণ্ডল
অবশেষে ষোলকলা পূর্ণ হওয়ার মতো ১৭ নভেম্বর ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-এ শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার ফলে শত্রুর শেষ না রাখার বিকৃত উল্লাস ছড়িয়ে পড়েছে এবং তা একই সঙ্গে বিশ্বজুড়ে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে চলেছে। বাংলাদেশের মৌলবাদী মদতপুষ্ট অন্তর্বর্তী সরকারের শেষ হাসির আয়োজনে শেখ হাসিনার ফাঁসি আসলে সে দেশের গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে হত্যা করার সামিল। কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছুতোয় মৌলবাদীদের সংগঠিত ষড়যন্ত্রে জনরোষ সৃষ্টি করে ২০২৪-এর জুলাই-এ যেভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ৫ আগস্টে ক্ষমতা দখলের আয়োজন শুরু হয়েছিল, তার মধ্যেই সেই নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড লেখা হয়ে গিয়েছিল। মানবতাবিরোধী গণহত্যা চালানোর গুরুতর অভিযোগে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, আজ্ঞাবাহী পুলিশপ্রধানের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায়দান ছিল সময়ের অপেক্ষা। সেই গণহত্যার মূলচক্রী হিসেবে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডই মূল লক্ষ্য ছিল, তাও ‘খুনী’ হাসিনার বিচারের জিগির অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের অব্যবহিত পরিসরে মৌলবাদীদের ষড়যন্ত্রেই ক্রমশ দাবিদাওয়ার মধ্যেই প্রকট হয়ে ওঠে। এজন্য ধর্মীয় মৌলবাদীদের মদতপুষ্ট অন্তর্বর্তী সরকার দেশে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেই স্বস্তি লাভ করেনি, ভারতে আশ্রয় নেওয়া দেশান্তরী শেখ হাসিনাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আয়োজনে কফিনে শেষ পেরেক মারার জন্য ক্রমশ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। তারই ট্র্যাজিক পরিণতি শেখ হাসিনার ফাঁসির মৃত্যুদণ্ড যা বিচারের নামে নির্বিচারে শত্রুনিধন যজ্ঞের সর্বশেষ আয়োজন। সময়ের প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তা জরুরি হয়েও উঠেছিল ।
Advertisement
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড মহম্মদ ইউনুস দেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার উপরে অধিক গুরুত্ব আরোপ করে নিজের স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করার জন্য যেভাবে সময় নিয়ে সংশোধন ও সংস্কারের পথে হাঁটতে চেয়েছেন,তাতে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর ক্ষমতার মেয়াদ নানাভাবে শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে। শেষে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির চাপে ওজর আপত্তি মেনে নিয়ে নানা টালবাহানার পর বছর দেড়েকের মাথায় ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও ২০২৪-এর ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের জের তারপরেও সক্রিয় থাকে। সেখানে মৌলবাদীরা ষড়যন্ত্র করে একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে দেশের ক্ষমতা দখল করেও স্বস্তিতে ছিল না। নানা ফন্দি ফিকির করে সুস্থ ও সুষ্ঠু গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার বুলি কোপচিয়ে যেভাবে একের পর এক প্রতিরোধাত্মক থেকে প্রতিশোধাত্মক সিদ্ধান্তে সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, তার মধ্যেই মৌলবাদীদের মদতপুষ্ট সরকারের আসল উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে । অন্তর্বর্তী সরকারের সংবিধান সংশোধন থেকে নির্বাচনী সংস্কারের মাধ্যমে নানা অজুহাতে ক্ষমতা ধরে রাখার দুরভিসন্ধি, মৌলবাদীদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার গোপন ষড়যন্ত্র কিছুই অলক্ষ্যে থাকেনি। যেখানে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের নির্বাচন নিরপেক্ষ ভাবে করার মধ্যেই দায়দায়িত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে নির্বাচিত সরকার না হয়েও জাতীয় সংসদকে উপেক্ষা করে শুধু মাত্র অস্থায়ী ভিত্তিতে সরকার পরিচালনার দায় নিয়েই একের পর এক অসাংবিধানিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শুধু তাই নয়, প্রতিশোধের খেলায় মেতে যেমন দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমন বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে ধ্বংস করে ধর্মীয় মৌলবাদীদের পূর্ব পাকিস্তানকে ফিরিয়ে আনার আয়োজনও চলেছে। মৌলবাদী মদতপুষ্ট সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে ও শেখ হাসিনা নির্বাসিত হলেও স্বস্তিবোধ করতে পারেনি। বিশেষ করে বাংলাদেশে এখনও বঙ্গবন্ধুর প্রভাব বর্তমান। তাঁর আওয়ামী লীগের প্রতি সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন রয়েছে।
Advertisement
শেখ হাসিনার প্রতি সাধারণ মানুষের আশাভরসা এখনও সচল, সরল। এজন্য দেশের বাইরে থাকলেও দেশে যাতে তাঁর বার্তা ছড়িয়ে না পড়ে, তা নিয়েও অন্তর্বর্তী সরকারের বিবিধ নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে । তাঁর অনুগামীদের মধ্যে এখনও শেখ হাসিনার তুমুল জনপ্রিয়তা । তাঁর ফিরে আসার প্রতীক্ষায় সে দেশের মানুষের স্বপ্ন জেগে রয়েছে অবিরত । সেক্ষেত্রে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে নিষ্কণ্টক হওয়ার চেতনা ধর্মীয় মৌলবাদী থেকে অন্তর্বর্তী সরকারেরও পাখির চোখ হয়ে ওঠে। সে চোখেই হাসিনার ফাঁসির প্রতীক্ষাই বলে দেয় আগামী বাংলাদেশের পাকিস্তানি সরকার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে হাসিনার মৃত্যুদণ্ড কতটা জরুরি ছিল। সে দেশে এখনও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের প্রতিভূ, আলোর দিশারি শেখ হাসিনা । এজন্য সেই আলোদিশারিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন না করা গেলে জাতীয় নির্বাচনের আরাধ্য ফলাফলে বাংলাদেশকে মৌলবাদীদের পাকিস্তান বানানো সম্ভব হবে না।
অন্যদিকে, ইতিহাসে যুদ্ধে জয়ীরাই চিরকাল পরাজয়ীদের বিচার করে নিজেদের ইচ্ছেমতো নিষ্কণ্টক ক্ষমতায়নের পথে হাঁটে, নিজেরাই নিজেদের ইতিহাস রচনায় সক্রিয় হয়ে ওঠে । সেক্ষেত্রে পরাজয়ীর কোনওরকম ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনায় বা ক্ষমতায় ফিরে আসার সদিচ্ছার প্রতিরোধ থেকে শত্রুদমনের প্রয়াসে ধর্মের কাঠগড়াকেই অধর্মের হাতিয়ার করে তোলা হয়। জয়ীদের যুদ্ধজয়ের ষড়যন্ত্র জনরোষের প্রতিফলনে মহিমান্বিত হয়, পরাজয়ীর প্রতিরোধের প্রয়াসেও গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ জেগে ওঠে। কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে মৌলবাদীদের সংগঠিত পরিকল্পনায় গড়ে তোলা ষড়যন্ত্রের শিকারে দেশের একটি নির্বাচিত সরকারকে তীব্র জনরোষে গণঅভ্যুত্থানের ছায়ায় উৎখাত করাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কুশাসন ও দুর্নীতি থেকে নির্বাচনী তছরুপ করে ভোটে জেতা প্রভৃতির মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসন-শোষণের অভিযোগ তুলে ধরা হয়। অথচ তাঁকেই ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পথে। গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা যেত। সেখানে স্বৈরাচারীর বুলেটের চেয়ে গণতন্ত্রের ব্যালট জরুরি ছিল। অথচ তা না করে দেশের জনগণকে প্ররোচনা দিয়ে সরকারবিরোধী যুদ্ধং দেহি মনোভাব জাগিয়ে তুলে দেশের জনগণকে গণহত্যারের টোপে পরিণত করে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস থেকে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে অমান্য করে ভেঙে দিয়ে সর্বত্র ধ্বংসলীলা চালানোর প্রয়াস বৈধতা লাভ করে। সেক্ষেত্রে তা রক্ষা করতে গিয়ে বা প্রশাসন সচল রাখার জন্য সদর্থক ভূমিকা পালন করাকেই গণহত্যায় সামিল করে পরিকল্পিত ক্যাঙারু আদালতে দোষী সাব্যস্ত করা স্বাভাবিক, মৃত্যুদণ্ডও প্রত্যাশিত। তাতে মাথাকে নিশ্চিহ্ন করলে দেহ যেমন চেনা যায় না, তেমনই দেহটাই অকেজো হয়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধুর শেষ প্রভাবশালী উত্তরসূরিকে সোনার বাংলা থেকে নিষ্প্রাণ করতে পারলেই আওয়ামী লীগ আপনাতেই অকেজো হয়ে যাবে, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ অস্তে ধর্মীয় মৌলবাদীদের বাংলাদেশের উদয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। অন্যদিকে ইতিহাসেরও পুনরাবৃত্তি ঘটে, এটাও অমোঘ সত্য। সময়ের দাবিতে ইতিহাস বদলে যায় ঠিকই, কিন্তু তাতে ইতিহাস সৃষ্টি বন্ধ হয় না। মানুষের মধ্যেই সেই ইতিহাস সৃষ্টির ক্ষমতা বর্তমান।
স্মৃতি স্তম্ভ, চিত্র, স্থাপত্য, মূর্তি সব ভাঙা যায়, ভাবমূর্তি কখনওই নয়। মানুষের ইতিহাসে সেই ভাবমূর্তি থেকে যায় নিরবধি। শুধু তাই নয়, ফিরেও আসে সেই ভাবমূর্তির আদর্শে। শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শেখ হাসিনা তারই পরম্পরায় ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছে । সেক্ষেত্রে ধর্মীয় মৌলবাদী থেকে তাদের মদতপুষ্ট ড ইউনুস সরকার যতই শেখ হাসিনাকে ছেঁটে ফেলার আয়োজন করে বিরোধী মানসে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ক্ষমতা কায়েম করতে নিষ্কণ্টক হতে চান কেন, জনমানসে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার গড়ে তোলা ভাবমূর্তিই সেক্ষেত্রে আলোর সাহারা হয়ে ক্ষমতালোভীদের নিরুপদ্রবে ঘুমোতে দেবে না, নিরুদ্বিগ্ন রাখবে অবিরত ।
Advertisement



