বিমলকুমার শীট
দেশ স্বাধীন হল। শেষ পর্যন্ত দেশ ভাগ গান্ধীজি মেনে নিলেন। মগ্ন হলেন দেশবাসির ভবিষ্যৎ চিন্তায় । সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দেশ তখন জ্বলছে। উদবাস্তু স্রোত ভারতমুখী। কোন কিছু বাধা মানছে না। গান্ধীজি তখন কলকাতা ও নোয়াখালিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামানোর চেষ্টায় অনশন করছেন। ফলে তখনকার মতো দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া গেল। মাউন্টব্যাটেনের কথায় গান্ধীজি একক সীমান্ত প্রহরী। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবের অবস্থা ভয়াবহ। তাঁর প্রভাব পড়ে দিল্লিতে৷ তিনি পাঞ্জাব পর্যন্ত পৌঁছবার অবকাশ পাননি।
পশ্চিম পাকিস্তানের হিন্দু শিখ ও অন্যান্য অমুসলমান শরণার্থীর ভারে দিল্লি তখন ধুঁকছে। দিল্লির প্রত্যেক চতুর্থ ব্যক্তি তখন শরণার্থী। আহার নেই, বাসস্থান নেই। দিল্লিতে তখন প্রচন্ড ঠাণ্ডা। উন্মুক্ত রাজপথ ছিল শরণার্থীদের আশ্রয়। ধন সম্পদ আশ্রয় আনন্দ বিসর্জন দিয়েও তারা রেহাই পান নি । এমন পরিবার খুব কম ছিল, যাদের আত্মীয় স্বজন অপহৃত বা নিহত হয়নি। এই অবস্থায়, খুব স্বাভাবিক ভাবে আক্রোশটা গিয়ে পড়ল মুসলমানদের উপর। স্পষ্ট করেই সে দিন দাবি উচ্চারিত হয়েছিল যে, মুসলমানরা পাকিস্তান চেয়েছিলেন দেশমাতৃকার অঙ্গচ্ছেদ করে সেই পাকিস্তান সৃষ্টি করা হয়েছে অতএব তারা সেখানে চলে যান। অধিকাংশ মুসলমানের সহানুভূতি ছিল পাকিস্তানের প্রতি, পাকিস্তানের সাহায্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ করে কাশ্মীর এবং দিল্লি দখল করে নেবার পরিকল্পনার কথা তখন শোনা যেত। কাশ্মীর তো আক্রান্ত হয়েই ছিল। দিল্লিতে কাশ্মীরের মতো অভ্যুত্থান ঘটে নি। এর জন্য সর্বাধিক কৃতিত্ব ছিল সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের একমাত্র তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন মুসলিম লীগের লোকেরা রাতারাতি বন্ধু হয়ে উঠতে পারে না৷
Advertisement
গান্ধীজি দিল্লি এলে ভাঙ্গী কলোনিতে উঠতেন। কিন্তু তখন তা উদ্বাস্তুতে ভরে গেলে তিনি সর্দার প্যাটেলের পরামর্শে নতুন দিল্লির বিড়লা ভবনে ওঠেন। এই সময় দুঃখ যন্ত্রনাক্লিষ্ট মানুষ গান্ধীজিকে তাঁদের দুঃখের কথা বলেন। একদিন তিনি শরণার্থী শিবির দেখতে গেলে শিবির বাসিরা নির্বিচারে তাঁকে কটূক্তি করেন। গান্ধীজি নীরবে সব শোনেন। পরে মন্তব্য করেন এই রকম বলবার অধিকার এদের আছে । শরণার্থী মানুষের বেদনার গভীরতা তার চিত্ত স্পর্শ করেছিল। কিন্তু তার প্রতিকারের জন্য ভারতের মুসলমানদের আশ্রয়চ্যুত করা কিম্বা মসজিদাদি ধর্মস্থান অপবিত্র করার তিনি প্রতিরোধ করেছেন। পাকিস্তানে যা কিছু ঘটুক ভারতবর্ষের মুসলমানদের মর্যাদা এবং অধিকার অক্ষুন্ন রাখতে হবে। পুলিশের বা সৈন্যদের সাহায্য ছাড়াই তারা নিরাপদে এবং নির্ভয়ে চলাফেরা ও কাজকর্ম করতে সমর্থন না হলেও ভারত বা পাকিস্তানে কোন মানুষ সুস্থ ও স্বাধীন থাকতে পারবে না। দুই দেশের সামগ্রিক কল্যাণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রয়োজন । পাকিস্তান কি করছে সে কথা চিন্তা না করেই ভারত তার ধর্ম পালন করলে কালক্রমে সেই কাজের প্রতিক্রিয়া পাকিস্তানেরও কল্যাণ হবে। গান্ধীজির এই কথা তখন অধিকাংশ মানুষ যুক্তি দিয়ে সমর্থন করলেও, অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেন নি। এক শ্রেণীর হিন্দু তাঁকে হিন্দু ধর্মের বিনিময়ে মুসলমানদের স্বার্থরক্ষাকারি বলে চিহ্নিতও করে। গান্ধীজি চিরকালই লাঞ্ছিত পীড়িত দুর্বলতর মানুষের সঙ্গেই থেকেছেন। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। মুসলমানদের পরিত্রাতা রুপে তিনি আবির্ভূত হলেন। এই কাজে পূর্ণতা সম্পাদনের জন্যই তিনি আমৃত্যু অনশন ব্রত গ্রহণ করেন।
Advertisement
১৩ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে গান্ধীজি অনশন শুরু করেন। অনশনের সময় তিনি পাতিলেবুর রস মিশিয়ে বা শুধু লবণজল পানের অধিকার রাখেন। এবং জানান যে ভগবানই একমাত্র উপদেষ্টা। কোন পরিস্থিতিতে তিনি অনশন ভঙ্গ করবেন তার একটি রূপরেখা প্রথম দিনের অনশনের সময় তুলে ধরেছিলেন। পুলিশ ও মিলিটারি তুলে নেবার পরও যখন শান্তি থাকবে তখনই মাত্র তিনি অনশন ভঙ্গ করবেন। অনশন আরম্ভের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গান্ধীজি শয্যাপার্শ্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী-মণ্ডলীর বৈঠকে পাকিস্তানের হিন্দু নিধন ও কাশ্মীর আক্রমণ সত্ত্বেও পাকিস্তানের পাওনা মিটিয়ে দেবার কথা হয়। মাউন্টব্যাটেন এতে উৎফুল্ল হন। কিন্তু শরণার্থী এবং আরও অনেকের ক্রোধ এর দ্বারা বেড়ে যায়। তারা বিড়লা হাউসের সামনে এসে প্রতিবাদ জানান। তাঁদের দাবি হল গান্ধী মরতে চান তো মরুন, আমরা প্রতিশোধ চাই। জওহরলাল নেহরু কানে এই ধ্বনি গেলে তিনি রুখে দাঁড়ান এবং বলেন এ রকম ধ্বনি দিতে হলে আমাকে আগে মেরে ফেলে দিতে হবে । গান্ধীজির অনশনের ফলে তৎকালীন অবস্থায় পাকিস্তান ৫৫ কোটি টাকা পায়। কারণ তখন তারা ভারত আক্রমণ কারি। কাশ্মীরের খানিকটা দখল করে বসে আছে। পাকিস্তান ভালোভাবেই বুঝেছিল যে, ভারতের সব মুসলমানকে পাকিস্তানে স্থান দেওয়া যাবে না। ভারতের মুসলমানেরা পাকিস্তানে যাতে না আসে, নেপথ্য থেকে সে কাজ করতে তারা যত্নশীল ছিলেন বলে কেউ কেউ মনে করেন। সুতরাং পাকিস্তান এই অনশনের ব্যাপারে খুবই নমনীয় হয়েছিলেন। তাছাড়া তারা বুঝতে পেরেছিলেন করাচি বা ঢাকায় বসে যত আস্ফালন করা যাক না কেন। তার দ্বারা ভারতের মুসলমানদের ক্ষতি ছাড়া বিন্দুমাত্র উপকার করা যাবে না। দেশ বিভাগ রূপ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে একমাত্র গান্ধীজি তাঁদের রক্ষা করতে পারেন।
অনশনের তৃতীয় দিনেই গান্ধীজি খুব দুর্বল হয়ে পড়েন। সে দিন প্রার্থনা সভা পর্যন্ত তিনি যেতে পারেনি, নিজের ঘর থেকে মাইক্রোফোনের সাহায্যে সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলীকে দু-একটি কথা বলেন। লালকেল্লায় দশ হাজার উদ্বাস্তুর একটি সমাবেশে নেহরু বলেন— এই ভাবে গান্ধীজির জীবনাবসান মানে ভারত আত্মার মৃত্যু। গান্ধীজির স্বাস্থ্য শনৈঃ শনৈঃ খারাপ হতে থাকে। দিল্লির অবস্থার কিন্তু উন্নতি ঘটে নি । সারা দেশ ও বর্হিভারত থেকে চিঠিপত্র তারবার্তা মারফত গান্ধীজিকে অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ করা হয়। সেই রাতে দিল্লির উদ্বাস্তু হিন্দু ও শিখ একটি ঘোষণা পত্রে স্বাক্ষর করে বললেন—মুসলমানগন ফিরে এলে তাঁদের স্বাগত জানিয়ে বাসগৃহগুলি সানন্দে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। অপর দিকে দিল্লি প্রশাসন ঘোষণা করলেন এক সপ্তাহের মধ্যে শরনার্থীদের যা হোক একটা মাথা গোজার মত জায়গা করে দেওয়া হবে। মন্ত্রীরা পর্যন্ত তাঁদের বাড়ি ঘরের অংশ শরনার্থীদের জন্য ছেড়ে দিলেন।
দিল্লি শান্ত, উদ্বাস্তুরা মুসলমানদের ঘর বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছেন। নানা স্থানে হিন্দু মুসলমান শিখ সম্মিলিত ভাবে শান্তি রক্ষার জন্য কাজ করতে শুরু করেছেন। গান্ধীজি এই সময় সাত দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন। পরের দিন রাজেন্দ্র প্রসাদের পৌরহিত্যে সকল সম্প্রদায়ের ১৩০ জন প্রতিনিধি নিয়ে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। রাজেন্দ্রপ্রসাদের বাড়িতে সাত দফা প্রতিশ্রুতি পত্রে নেতারা স্বাক্ষর করেন। যে দলিল মহাত্মার হাতে দেওয়া হয় তার মর্মকথা হলঃ দিল্লিতে হিন্দু মুসলমান শিখ এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা পূর্ণ শান্তিতে পূর্বের মত বাস করবে। তারা মুসলমানদের রক্ষা করবে এবং দিল্লিতে যা ঘটে গেছে তেমনটি আর কখনও ঘটবে না। সব্জীমুণ্ডি, কেরল বাগ, পাহাড় গঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় পূর্বের ন্যায় বিনা বাধায় মুসলমানগন চলা ফেরা করতে পারবেন। পরিত্যক্ত মসজিদগুলি যা এখন হিন্দু-শিখদের দখলে আছে তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। মুসলমানদের জন্য পৃথক করে রাখা এলাকা জোর করে দখল করা হবে না। যে সব মুসলমান দেশ ছেড়ে গেছেন তারা ফিরে আসতে চাইলে আপত্তি করা হবে না। মুসলমানেরা আগের মতই ব্যবসা বানিজ্য করতে সমর্থ হবে । এ সব ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হবে, পুলিশ বা সৈন্যের সাহায্যে নয়। তারপর গান্ধীজিকে অনশন ত্যাগ করতে অনুরোধ করা হয়।
গান্ধীজি ইচ্ছা অনুসারে প্রতিজ্ঞাপত্রটি হিন্দী ও উর্দুতে লেখা হয়। গান্ধীজি স্বীকার করলেন, তিনি যা চেয়েছিলেন তা তিনি পেয়েছেন। তার এর ভিতর যদি ঐকান্তিকতা না থাকে এবং সেই মত কাজ না হয় তা হলে পুনরায় তাঁকে অনশন করতে হতে পারে। তিনি মুসলিম প্রতিনিধিদের নিকট জানতে চাইলেন দিল্লিতে তাঁদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে কিনা যার ফলে তিনি অনশন ত্যাগ করতে পারেন।
অবশেষে গান্ধীজি ১৮ জানুয়ারি পৌঁনে একটায় অনশন ভঙ্গ করেন। দিনটি ছিল গুরু গোবিন্দ সিংহের পুণ্য জন্মদিন। মৌলানা আজাদের হাতে ফলের রস খেয়ে গান্ধীজি অনশন ভঙ্গ করেন। অনশন ভঙ্গের পূর্বে যথারীতি প্রার্থনা হয়। ২০ জানুয়ারি তাঁকে হত্যার জন্য তাঁর প্রার্থনা সভায় বোমা ছুঁড়েছিলেন গডাসের সহযোগী মদনলাল। কর্তব্যরত পুলিশ ও প্রার্থনা সভার শ্রোতৃমণ্ডলীকে গান্ধীজি অনুরোধ করেছিলেন অপরাধীকে ক্ষমা করতে এবং নিজের হৃদয়ের দিকে ফিরে তাকাতে। এই ছিল গান্ধীজির আবেদন দেশবাসীর প্রতি। আজকের অশান্ত পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে বলা যেতে পারে গান্ধীজির পথই আজকের এই সমস্যা জর্জর মানুষের একমাত্র পথ। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি আততায়ী নাথুরাম গডসের গুলিতে গান্ধীজি
নিহত হন।
Advertisement



