কাজল চট্টোপাধ্যায়
বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি ও সমগ্র বঙ্গভাষী ভুবনের (পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, ত্রিপুরা ও বরাক উপত্যকা) অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
Advertisement
তা যে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক শিবিরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাঙালি-বাংলা-পশ্চিমবঙ্গ বিদ্বেষ— ধর্মীয় উগ্রতার ঊর্ধ্বে বিচরণ করা মানবতাবাদী বাঙালি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও যে সেই শিবিরের অত্যন্ত চক্ষুশূল হবেন, এ তো বলাই বাহুল্য!
Advertisement
২০২১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে খোদ বোলপুরের বুকে তুলে ধরা নির্বাচনী পোস্টারে সেই রাজনৈতিক শিবিরের জনৈক হেভিওয়েট দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী নেতার ছবির নিচে কোনওক্রমে ঠাঁই হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের! বিশ্বকবির প্রতি সেই শিবিরের শ্রদ্ধার(!) পরাকাষ্ঠার পাশাপাশি রবীন্দ্রজ্ঞানও যে কী অপরিসীম, তার প্রমাণও তারা প্রদর্শন করেছে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীকে রবীন্দ্রনাথের ‘জন্মস্থান’রূপে আখ্যায়িত করে।
কিন্তু সম্প্রতি উপর্যুপরি যে খেলা গেরুয়াপন্থীরা খেলছে রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে, তার পাশে ২০২১-এর কেলেঙ্কারি নিতান্তই শিশু। যদিও তা বিশ্বকবির প্রতি বহিরাগত ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান’ শিবিরের অসীম তাচ্ছিল্য ও ঘৃণ্য মানসিকতার প্রমাণ স্পষ্টভাবে বহন করছিল।
দেহে কর্কট রোগ বাসা বাঁধলে এবং তার চিকিৎসা না করলে, উক্ত ব্যাধির আগ্রাসন যেমন প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেতে থাকে, অনুরূপভাবেই আত্মবিস্মৃত জাতি বাঙালির প্রতিবাদহীনতার ফলে ও বহিরাগত বাঙালি বিদ্বেষী শিবিরের প্রতি এক শ্রেণীর আত্মসম্মানহীন জাত্যাভিমানহীন তথাকথিত ‘বঙ্গালি’র নির্লজ্জ চাটুকারিতার সৌজন্যে আজ রবীন্দ্র-বিদ্বেষী পরিবেশ অসভ্যতার উচ্চ-গগন স্পর্শ করে ফেলেছে।
তাই রবীন্দ্রনাথের অমরগীতি, ‘আমার সোনার বাংলা’ ভারতবর্ষের বুকে গাইলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের খোদ মুখ্যমন্ত্রী ‘দেশদ্রোহী’দের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি প্রদান করেন।
আর সেই শিবিরের অবাঙালি প্রভুদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁদের বঙ্গীয় সংস্করণরা নির্লজ্জতার অন্তিম সীমা অতিক্রম করে অসীম ধৃষ্টতার সঙ্গে ‘সুনার বঙ্গাল’-এর স্বনিযুক্ত অভিভাবক সেজে ফরমান জারি করে যে, পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতে ‘আমার সোনার বাংলা’ কদাচই গাওয়া চলবে না। কারণ, সেটা বাংলাদেশের ‘জাতীয় সংগীত’ (হ্যাঁ, বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতির চেয়ে নিজেদের বহির্বঙ্গীয় রাজনৈতিক প্রভুদের প্রতি এদের আনুগত্য অধিক)।
তা কবিগুরু কি ওই গান লেখার সময় জানতেন যে, তাঁর পরলোকগমনের ৩১ বছর পর বাংলাদেশ নামক এক রাষ্ট্র গঠিত হবে এবং তার জাতীয় সঙ্গীত এই গানটিকেই করা হবে! আর যদি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কবি তা দেখতেও পেতেন, সে ক্ষেত্রেও এই গান লিখতেন, কারণ তিনি দেশকালের সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে ‘বিশ্বভারতী’র স্বপ্ন দেখেছিলেন। ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান’-এর কূপমণ্ডূক শিবির, যা কোনওদিন অনুধাবন করতে সক্ষম হবে না।
কোন গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক বা নৈতিক অধিকারে বহির্বঙ্গীয় ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান’ শিবিরের অন্ধ ‘বঙ্গালি’ অনুগামীরা আজ ঠিক করে দেওয়ার স্পর্ধা প্রদর্শন করে— বাঙালিরা পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের বুকে কোন গান গাইবে বা গাইতে পারবে না!
আর হ্যাঁ, কেবলমাত্র বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার কারণেই যদি ভারতের বুকে ‘আমার সোনার বাংলা’ পরিবেশন ‘দেশদ্রোহিতা’ হয়, তাহলে সেই একই যুক্তি অনুসারে ভারতের মন্দিরে হিন্দু দেবদেবীদের আরাধনা করাও সমান ‘দেশদ্রোহী’ কর্ম। কারণ, কাঠমান্ডুর পশুপতিনাথ মন্দিরে যে হিন্দু দেবতার পূজা করা হয়! অনুরূপভাবেই যদি একাংশের দাবিতে নেপাল কোনওদিন হিন্দু রাষ্ট্র রূপে স্বীকৃতি পায়, তাহলে তখন অবিলম্বে ভারতে হিন্দু ধর্ম পালন নিষিদ্ধ করা উচিত!
দেশের তাবড় তাবড় স্বাধীনতা সংগ্রামী যাঁর সান্নিধ্য ও পরামর্শের জন্য বারবার শান্তিনিকেতন ছুটে এসেছেন, (যেমন— মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু থেকে সুভাষচন্দ্র বসু) যাঁর কবিতার পঙ্ক্তি ছিল অগণন বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা, বক্সা জেলে বন্দি স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবীদের যিনি আশীর্বাদ করে লিখেছিলেন, ‘অমৃতের পুত্র মোরা কাহারা শোনাল বিশ্বময়, আত্মবিসর্জন করি আত্মারে কে জানিল অক্ষয়’ ও সর্বোপরি জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার প্রতিবাদে যিনি নাইটহুড পরিত্যাগ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছিলেন— তিনি তো আজ ব্রিটিশদের তোষামোদকারী হবেনই (ইংরেজদের খুশি করা ‘জনগণমন’ লেখার অপরাধে)— হ্যাঁ, সেই ‘জাতীয়তাবাদী’দের সৌজন্যে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যাদের নূন্যতম অবদান তো নেইই, উপরন্তু যাদের আদর্শগত শিবিরের কোন এক ‘বীর’ আবার মুচলেকা দিয়ে কারাগার-মুক্ত হয়ে আজীবন ব্রিটিশদের অনুরক্ত হয়ে থাকার পণ করেছিলেন।
‘বন্দেমাতরম’-এর ১৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপনকে মূলধন করেও যে কীভাবে সাম্প্রদায়িকতা ও রবীন্দ্র-বিদ্বেষে নিমজ্জিত হওয়া যায়, তাও এই বিদ্বেষের সওদাগরদের কাছ থেকে শিখতে হয়!
হ্যাঁ, এই বহুধর্মীয় বৈচিত্র্যময় দেশে প্রতিটি গোষ্ঠীর ভাবাবেগকে সম্মান প্রদান করে পারস্পরিক সৌহার্দ্যবোধ ও জাতীয় ঐক্য রক্ষার মহান লক্ষ্যে যে কমিটি বন্দেমাতরমের কেবলমাত্র প্রাথমিক অংশটাকে ‘জাতীয় গান’ রূপে বরণ করেছিল— সেই কমিটির অন্যতম প্রধান সদস্যদের মধ্যে জওহরলাল নেহরু, মৌলানা আজাদ, সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছিলেন। আর হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ-সহ সেই সমস্ত ‘বিভেদকামী অপশক্তিই’ নাকি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, তথা দেশভাগের বীজ বপন করে গিয়েছেন সম্পূর্ণ বন্দেমাতরমকে জনসমক্ষে না আনার ‘অপরাধে’!
নতুন ভারতে আর কত নতুন ইতিহাস যে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে, ‘আচ্ছে দিন’-এর এই সমস্ত অমূল্য রতনদের সৌজন্যে, তা সত্যিই কল্পনারও অতীত!
Advertisement



