সম্প্রতি ছট পুজোর পুণ্য লগ্নে যমুনার জল ঘোলা বলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অবগাহন করতে পারলেন না। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর পুণ্যার্জন করা থেকে বঞ্চিত হলেন। যদিও তাঁর স্নানের জন্য সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। স্নানের জায়গাটি আলাদা করে রাখা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নিরাপত্তারক্ষীরা ওই জায়গায় সর্বক্ষণ প্রহরারত ছিলেন। কিন্তু জল ঘোলা এবং দূষিত বলে তিনি ডুব না দিয়েই ফিরে এলেন। প্রধানমন্ত্রী ঘোলাজলে অবগাহন করতে পারলেন না ঠিকই, কিন্তু ঘোলা জলে রাজনীতি করতে তিনি বড্ড ভালোবাসেন। প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতি এমন যে তিনি চান দেশের সব রাজ্যেই ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক। তার জন্য তাঁর প্রতিশ্রুতির অভাব নেই। তিনি দেশবাসীকে আশ্বাস দিয়েছেন একটি স্বচ্ছ ভারত গড়া হবে, যেখানে মানুষ সুখে বাস করবেন।
অতীতে দেখা গেছে, এবং এখনও তার কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ে না। তা কি? দেশের অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যে নির্বাচন ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখাএন তিনি ছুটে যান ডবল ইঞ্জিন সরকার প্রতিষ্ঠা করার অভিপ্রায় নিয়ে। জনসভার পর জনসভা করে তিনি ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের মাহাত্ম্য বুঝিয়ে দেন তাঁর সভায় যোগদানকারীদের। যে অবিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসীন তার প্রশাসনিক কাজের তীব্র সমালোচনা করে বুঝিয়ে দেন তাঁরা যদি তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে বিজেপিকে ক্ষমতায় আনেন, তাহলে রাজ্যের বহুমুখী উন্নয়ন হবে— যে কাজে পিছিয়ে রয়েছে এই রাজ্য। উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি জানিয়ে দেন ডবল ইঞ্জিন সরকার এলে রাজ্যকে ঢালাও অর্থ সাহায্য করা হবে কেন্দ্রের সরকারের তরফে। সুতরাং বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন হলে রাজ্য সমৃদ্ধ হবে— সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা স্বচ্ছন্দ হবে—যা করতে বর্তমান সরকার ব্যর্থ।
Advertisement
কিন্তু বাস্তব দিকটা বিচার করলে দেখা যাবে এখন দেশের যে বেশির ভাতা রাজ্যে ডবল ইঞ্জিনের সরকার রয়েছে, সেই রাজ্যগুলি কি উন্নয়নের নিরিখে শীর্ষে রয়েছে? বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির বেশির ভাগই মনে করে ডবল ইঞ্জিন সরকার হলেও, তাঁরা তাঁদের অনেক ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত। যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল, তার বেশির ভাগই পূরণ হয়নি। প্রাপ্য অর্থ থেকেও তাঁরা বঞ্চিত। তাহলে ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের গুনগান গেয়ে কী লাভ? বিরোধীরা তাই বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি মানেই একটি ধাপ্পা।
Advertisement
ধরা যাক ত্রিপুরা। দীর্ঘ ১৫ বছর বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে সেখানে ‘ডবল ইঞ্জিন’ (বিজেপি) সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তৃণমূল কংগ্রেস অনেক চেষ্টা করেও, সেখানে তার প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেনি। বাধা এসেছে বিজেপির কাছ থেকে। তৃণমূলের ভোটের প্রচার কাজেও বাধা দিয়েছে বিজেপি। এই অভিযোগ তৃণমূল নেতৃত্বের। ভোটের প্রচারে এসে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ত্রিপুরায় ডবল ইঞ্জিন সরকার হলে এই রাজ্যকে তাঁরা সোনা দিয়ে মুড়ে দেবেন উন্নয়নের নিরিখে। কিন্তু এই ডবল ইঞ্জিন সরকার থাকলেও, ত্রিপুরার কি আহামরি কোনও উন্নয়ন হয়েছে? হয়নি। সাধারণ মানুষের জীবনও স্বাচ্ছন্দ্যের হয়নি। উন্নয়ন সেভাবে দানা বাঁধেনি। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি কোথায় গেল? মণিপুরে বিজেপির সরকারও এখানে এই গোষ্ঠীর মধ্যে মারদাঙ্গা থামাতে পুরোপুরি ব্যর্থ। উন্নয়ন স্তব্ধ থাকল। মণিপুরবাসীর দুর্যোগের সীমা ছাড়িয়ে গেল। মণিপুরে আইনশৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়লেও প্রধানমন্ত্রী একবারও এই রাজ্যে যাননি। অবশেষে রাষ্ট্রপতি শাসন জাড়ি হল— বিধানসভাকে জিইয়ে রেখে। এখানেও ডবল ইঞ্জিন সরকারের বড় পরাজয়।
এখন প্রধানমন্ত্রীর লোলুপ দৃষ্টি তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত পশ্চিমবঙ্গের দিকে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি নিশ্চিত ছিল এখানে ক্ষমতায় আসীন হচ্ছে। পর্দার আড়ালে মন্ত্রিসভাও গঠিত হয়েছিল। কিন্তু ভোটের ফল বের হলে দেখা গেল বিজেপির ঝুলিতে মাত্র ৭৭ আসন। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন বিজেপি বিধায়ক তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মানুষের হয়ে কাজ করতে। ২০২৬-এর নির্বাচনে এই দল ক্ষমতায় আসার জন্য বদ্ধপরিকর। কিন্তু বিজেপির রাজ্য নেতাদের মধ্যেই দলাদলি এবং সমন্বয়ের অভাব প্রকট। প্রধানমন্ত্রী তিন-চার বার রাজ্যে এসে মানুষকে বিজেপিকে এই রাজ্যে ক্ষমতায় আনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। তাহলে এ রাজ্যে ডবল ইঞ্জিন সরকার গঠিত হবে। রাজ্যের প্রভূত উন্নয়ন হবে। এসেছেন বিজেপির ভোটকুশলী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও। বিজেপির সাংগঠনিক শক্তি দুর্বল। শুধু তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ এনে মানুষের ভোট চাইছেন। আবার তলে তলে রাজ্যে এনআরসি চালু করারও অভিসন্ধি রয়েছে তাঁর। এনআরসি’র আতঙ্কে অনেকে আত্মহত্যাও করেছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তিনি এই রাজ্যে এনআরসি চালু শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে রোধ করবেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতদিন এই রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন, ততদিন বিজেপি বা অন্য কোনও দলের ক্ষমতালাভ অসম্ভব বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। কারণ রাজ্যের মানুষ মমতার মুখের দিকে তাকিয়ে ভোট দেন তৃণমূল কংগ্রেসকে। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের উন্নয়নের জন্য প্রচুর কাজ করেছেন। তাঁর জনহিতকর প্রকল্পগুলি বাস্তবে রূপ পাওয়ায় রাজ্যের মানুষ উপকৃত। শুধু দুর্নীতির দোহাই দিয়ে বিজেপি মানুষের ভোট পাবে না। সুতরাং ২০২৬-এর নির্বাচনেও বিজেপির ক্ষমতায় আসা অসম্ভব বলেই মনে হয়। কারণ তারা মানুষের পাশে নেই।
Advertisement



