• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

পিচকিরি

বাস থেকে নেমে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করার পর চব্বিশ নম্বর বাড়িতে পৌঁছে গেলো সে। দরজা খুলতেই ভদ্রলোকের মুখোমুখি।

কাল্পনিক চিত্র

সমাজ বসু

সাবান দিয়ে ভালো করে হাতদুটো ধুয়ে ফেলল দিবাকর। ছুটির আগে এটা নিয়মমাফিক কাজ। আজ শনিবার। সাপ্তাহিক বেতনের দিন। সপ্তাহের শেষে টাকাটা পেলে ভালোই লাগে। সারা মাস অপেক্ষা করতে হয় না। নিয়মটা মালিক বিজয় মজুমদারই স্থির করেছেন। সে ছাড়া আরো দু’জন কর্মচারী আছে। আজ বেতন নিয়ে সবারই চারটেয় ছুটি।

Advertisement

টাকাটা মানিব্যাগে ভরতে গিয়ে এক টুকরো কাগজে চোখ পড়ল দিবাকরের। কাগজটা বের করে নিলো। ছেলেটা রাতে শোবার আগে লিখে জামার পকেটে ভরে দিয়েছে, কাল দোল। আমার জন্য বড় একটা পিচকিরি আনবে। ভুলে যেও না কিন্তু। মনে মনে হেসে ফেলে দিবাকর। ছেলেও জানে তার ভুলো মনের কথা।
পেট্রল-ডিজেলের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি। তাই রাস্তায় বাসের সংখ্যা কম। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে এসডি ফোর বাসের অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পর তার বাস এলো। বাসটায় গেটের কাছে সামান্য ভিড়। ভেতরটা ফাঁকাই। এখন বেশি ভিড়েও ভয়। তবু উঠে পড়ল।

Advertisement

বুকপকেট থেকে দশটা টাকা বের করে টিকিট কেটে নিলো দিবাকর। প্রাইভেট বাসের এই এক রোগ। চালাবার নাম নেই। প্যাসেঞ্জার তুলছে তো তুলছেই। আধ ঘণ্টার রাস্তা এক ঘণ্টায় শেষ হলো।

মানিব্যাগটা নিয়ে অগাধ জলে পড়লো কাতুন। মানিব্যাগ খুলতেই বাঁ দিকে একটা ছোট্ট ছেলের ছবি। তারই ছেলের বয়সী হবে। ছেলেটাই একটা টুকরো কাগজে বাবাকে পিচকিরি আনার কথা লিখে দিয়েছে। বাসে ওঠার মুখেই ব্যাগটা প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে তুলে নিয়েছে। ভদ্রলোক ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। কাতুনের মনে হলো, টের পেলে ভালোই হতো। হয়ত গালিগালাজ আর মার পড়তো। কিন্তু এইরকম বিবেকের দংশন থেকে তো রেহাই পেতো। ভদ্রলোকের মুখটা ভেসে ওঠে তার চোখে। ছেলেটাকে মুখ দেখাবে কোন লজ্জায়? পরক্ষণেই নিজের ছেলের কথা মনে পড়ে। সেও বারবার বলেছে, একটা পিচকিরি নিয়ে এসো।

অনেকক্ষণ হাতড়ানোর পর নাম ঠিকানা লেখা একটা কাগজ খুঁজে পেলো কাতুন। কিছুটা স্বস্তি পেলো সে। মানিব্যাগের টাকায় একজোড়া ভালো পিচকিরি কিনে পাঠকপাড়ার বাসে উঠে পড়লো কাতুন।

বাস থেকে নেমে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করার পর চব্বিশ নম্বর বাড়িতে পৌঁছে গেলো সে।
দরজা খুলতেই ভদ্রলোকের মুখোমুখি।
—আপনি? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না।
—আপনি আমায় চিনবেন না। আমি কাতুন রায়। গোবিন্দ নস্কর রোডেই থাকি। আপনিই তো দিবাকর মান্না। আবার কী মতলবে লোকটা এসেছে, কে জানে? চিনেও না চেনার ভান করে দিবাকর।
—কী ব্যাপার? কেন এসেছেন বলুন।
—না, আমার একটা প্রয়োজনে এসেছি। আসলে আমার ছেলে আর আপনার ছেলে খুব ভালো বন্ধু। একই ক্লাসে, একই সেকশনে পড়ে। ছেলেটাই গল্প করে। আপনার ছেলে নাকি তাকে প্রায়ই ভালো ভালো খাবার খেতে দেয়। কাল ওর জন্মদিন তার ওপর দোল। তাই সে তার বন্ধুর জন্য এই উপহার পাঠিয়েছে। এই বলে একটা সুদৃশ্য রঙিন পিচকিরি তুলে দেয় দিবাকর মান্নার হাতে।

পিচকিরির নাম শুনতেই দিবাকরের ছেলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বাবাই পিচকিরিটা তুলে দেয় ছেলের হাতে।
—তোর বন্ধু তার জন্মদিনের উপহার পাঠিয়েছে।
—কী সুন্দর পিচকিরিটা। আঙ্কল, সোহমকে বোলো আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি খুব খুশি হয়েছি।
—তোমার পছন্দ হলে সোহমও খুশি হবে। কাল এটা দিয়ে হই-হই করে রঙ খেলবে, কেমন! কাতুন আর দাঁড়াতে চায় না।
—এবার আমি চলি, দিবাকরবাবু। আমার ছেলেটাও আবার পিচকিরির অপেক্ষায় বসে আছে। দোল তো ওদেরই। ওরাই তো মজা করবে।

মানুষটা চলে যেতেই এক অদ্ভুত অনুভূতি ছুঁয়ে যায় দিবাকরকে। এক অশিক্ষিত নিম্নপেশার মানুষ এত কঠিন পরিস্থিতিতেও তার মানবিক আদর্শ হারায়নি। আগাগোড়া মিথ্যের মোড়কে সে আর এক বাবার সম্মান রেখে গেল। তার মনে হলো, কাল সকালে দোলের রঙ আরো রঙিন হবে। তারই মত ছেলের সঙ্গে রঙখেলায় মেতে উঠবে আর এক বাবাও। একজন মানুষের সততা, তার টাকা হারানোর দুঃখে যেন কী এক প্রলেপ বুলিয়ে দিল। অদ্ভুত এক সুখে দিবাকরের বুকটা ভরে গেল।

Advertisement