• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

জোহরান মামদানি কি সত্যিই ট্রাম্পসাহেব বর্ণিত ‘একশো শতাংশ পাগল কমিউনিস্ট’

১৯৮৯ সালে যখন ‘মিসিসিপি মসালা’ সিনেমা নিয়ে গবেষণার কাজে উগান্ডার কাম্পালায় পৌঁছন, তখনই আলাপ মাহমুদের সঙ্গে, বিবাহ ১৯৯১ সালে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

নিউ ইয়র্কের মেয়র হওয়ার প্রতিযোগিতায় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে জোহরান মামদানির শীর্ষে থাকা মার্কিন রাজনীতিতে খানিকটা বামঘেঁষা ভাবনায় সিলমোহর। বুঝে নিতে হবে যে, এই জায়গায় পৌঁছতে চেষ্টা করেছিলেন বার্নি স্যান্ডার্স, কিন্তু ২০২০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ডেমোক্র্যাটদের প্রাইমারিতে জিততে পারেননি। ২০২০ সালে যখন ২১ বছর বয়সে তিরুবনন্তপুরমের মেয়র হয়েছিলেন সিপিআই (এম)-এর আর্যা রাজেন্দ্রন, তখন নাকি তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন মামদানি। যে হেতু তিনি জন্মেছেন উগান্ডায়, তাই মার্কিন নাগরিক হলেও কোনও দিনই সে দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আগামী ৪ নভেম্বরের নির্বাচন-শেষে যদি নিউ ইয়র্কের মেয়রের আসনে বসে পড়তে পারেন মামদানি, সেটাও বা কম কী! মার্কিন দেশে যথেষ্ট প্রভাবশালী এই পদটি। জ়োহরানের বাবা মাহমুদ— যাঁর পূর্বপুরুষ উগান্ডার— বর্তমানে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। তিনি ১৯৪৬-এর ২৩ এপ্রিল জন্মেছিলেন তৎকালীন বম্বেতে।

Advertisement

এরপর কিছুটা তানজানিয়ায় ইস্কুলে পড়াশোনা, কিছুটা উগান্ডায়। ১৯৬৩ সালে প্রথমবার উগান্ডা থেকে ২৬ জন পড়ুয়াকে উড়োজাহাজে চাপিয়ে মার্কিন দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্যে ছিলেন জ়োহরানের বাবা। বিষয়টি ইতিহাসে পরিচিত ‘কেনেডি এয়ারলিফ্ট’ নামে। সব মিলিয়ে সেই সময়ে প্রায় ৮০০ ছাত্রছাত্রী পূর্ব আফ্রিকা থেকে পৌঁছে গিয়েছিলেন আমেরিকায়, আধুনিক এবং উন্নত মানের শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে। তার মধ্যে ২০০৪ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের নাম করতেই হয়, যাঁর কাজ পরিবেশ নিয়ে। এই মানুষগুলি বড় হয়েছেন মার্কিন গণতন্ত্রের আঙিনায়। একটু মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’-এর বাইরেও কিন্তু সে দেশের ইতিহাস আছে, যা গণতন্ত্রকে রক্ষা করার ইতিহাস, যেখানে মানুষ পথে নামেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে, যেখানে উদারবাদী গণতন্ত্রের স্লোগান হারিয়ে যায় না ট্রাম্পের রাজত্বেও, যেখানে আজও শোনা যাচ্ছে প্রতিবাদীর কণ্ঠ। জোহরান স্মরণ করছেন ম্যান্ডেলাকে— ‘ইট অলওয়েজ সিমস ইম্পসিবল আনটিল ইট ইজ ডার্ক।’ জোহরানের মা মীরা নায়ার।

Advertisement

১৯৮৯ সালে যখন ‘মিসিসিপি মসালা’ সিনেমা নিয়ে গবেষণার কাজে উগান্ডার কাম্পালায় পৌঁছন, তখনই আলাপ মাহমুদের সঙ্গে, বিবাহ ১৯৯১ সালে। মীরা নায়ারের জন্ম ১৫ অক্টোবর, ১৯৫৭, পড়শি রাজ্যের রাউরকেলায়। বাবা, মা এবং ছেলের জন্মবৃত্তান্ত এই কারণে জরুরি যে কাল এবং স্থানের বিস্তার থেকে বোঝা যায়, কীভাবে এক হয়ে গেছে উন্নয়নশীল বিশ্বের ভারতীয় উপমহাদেশ, আরও পিছিয়ে পড়া আফ্রিকা এবং উন্নয়নের শিখরে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, শিক্ষাক্ষেত্রে মাহমুদ মামদানিও প্রায় একই রকমের বিখ্যাত। তাঁর ‘গুড মুসলিম, ব্যাড মুসলিম: আ পলিটিক্যাল পারস্পেকটিভ অন কালচার অ্যান্ড টেররিজম’ বইটি আফগানিস্তান, প্যালেস্তাইন ও পাকিস্তান, এই ধরনের গোলমেলে পরিস্থিতিতে পড়ে থাকা দেশগুলি নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখা। প্রচারে এই সব ‘আধুনিক প্রগতিশীল’ বিষয়ের ধার ধারেননি মামদানি, বরং জোর দিয়েছেন জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলিতে, ভারতীয় রাজনীতির ভাষায় যা রোটি-কাপড়া-মকান। বলেছেন শিশুদের পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত বিনামূল্যে ক্রেশে রাখার কথা, প্রচার করেছেন সরকারি স্কুলের পড়াশোনা নিয়ে। উচ্চ শিক্ষায় আমেরিকায় প্রচুর খরচ— ভেবেছেন, সেটি কীভাবে কমিয়ে আনা যায়। নিম্নবিত্ত মানুষ সস্তায় বা বিনামূল্যে যাতে পরিবহণ ব্যবস্থার সুযোগ পায়, সে কথা বলেছেন। অনেকটা আম আদমি পার্টির শুরুর দিনগুলো এবং তাদের কর্মসূচির সঙ্গে মিল চোখে পড়বে এ ক্ষেত্রে। ভয়ঙ্কর বেশি বাড়ি ভাড়া নিউ ইয়র্ক অঞ্চলে, সেখানে নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। গুছিয়ে উচ্চবিত্তদের ট্যাক্স বাড়ানোর কথা বলেছেন।

সোজা কথায় মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষের উত্তরণের কথা বলে মামদানি জয় পেয়েছেন এমন একটা সময়ে, যখন বিভেদের রাজনীতি প্রাধান্য পাচ্ছে ভারত থেকে আমেরিকা, সব জায়গায়। অর্থাৎ রাজনীতিতে ততটা নামজাদা না হয়েও জোহরান মামদানি জিতে গেছেন ডেমোক্র্যাট প্রাইমারিতে, এটা যতটা না অবাক করার মতো, তার থেকে অনেক বেশি চমকে ওঠার মতো বিষয় যে, এই ধরনের সমাজতন্ত্রী নির্বাচনী ইস্তেহার পেশ করার পরেও তিনি সামনে থেকেছেন। গোটা বিশ্বের বহু জায়গায়, এমনকী এ রাজ্যের রাজনীতিতেও এই সময়ে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের উন্নতি নিয়ে মানুষ যত না চিন্তিত, তার থেকে অনেক বেশি উদ্বেলিত প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে। ভারতে একই সঙ্গে একশো বছরে পৌঁছচ্ছে হিন্দু রাষ্ট্রবাদ ও কমিউনিস্ট ভাবনা, কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতিতে কে এগিয়ে, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই। এই বিশ্বব্যবস্থায় মামদানির জয়কে তাই একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ হিসেবে মেনে নেওয়াটাই আপাতত যুক্তিযুক্ত। পরে অন্য রকম ঘটলে এর একটা ব্যাখ্যা হতে পারে যে, তীব্র দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে কড়া বাম এবং একই সঙ্গে পরিচয়সত্তার রাজনীতি মিশিয়ে একটা ধারা হয়তো মাথাচাড়া দিচ্ছে।

মনে রাখতে হবে, উদারবাদী ভাবনার চারণক্ষেত্র হলেও নিউ ইয়র্ক কিন্তু পুঁজিরও পীঠস্থান, আর তা নিয়ন্ত্রণ করে গত শতকে ইউরোপ থেকে আমেরিকায় পাড়ি দেওয়া বেশ কয়েকটি ইহুদি পরিবার। ঠিক সেখানেই মুসলমান এবং বামপন্থী বুদ্ধিজীবী জ়োহরান মামদানির আপাত উত্থান। উল্লেখ করে রাখা দরকার যে, মামদানি সে দেশের সব থেকে বড় সমাজতন্ত্রী রাজনৈতিক সংগঠন ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্টস অফ আমেরিকা-র সদস্য। ঘটনা যদি সত্যিই প্রাথমিক ভাবে পুঁজিবাদের সঙ্কট সংক্রান্ত দিক নির্দেশ করে, সে ক্ষেত্রে ২০২৫-এর শেষে নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনকে কাল্টিভেট করা ছাড়া গতি নেই। এই নবীন নেতার দু’টি বৈশিষ্ট্য প্রথমেই লিখে ফেলা যাক। এক, পরিচয়-সত্তার রাজনীতি। দুই, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা। এর সঙ্গে যোগ হবে ট্রাম্পসাহেব বর্ণিত ‘একশো শতাংশ পাগল কমিউনিস্ট’ শব্দবন্ধ, যেখানে ‘কে বেশি পাগল’, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যে কোনও পুরস্কার নেই। একই প্রসঙ্গে ভারতের রাজনীতির কথাও আসবে, যেখানে শুধু বিজেপি নয়, কংগ্রেসের অভিষেক মনু সিংভিও মামদানিকে পাকিস্তানপন্থী বলে দাগিয়ে দিয়েছেন। একটুও দেরি না করে আবার দিগ্বিজয় সিং বলেছেন, শহুরে রাজনীতিতে মামদানির ধাঁচে প্রচার দুর্দান্ত উদাহরণ।

মামদানি যে প্রচারটি সেরেছেন, তাতে ভীষণ ভাবে উঠে এসেছে নিপীড়িত মানুষের কথা, যেখান থেকে গায়ে সেঁটে গেছে ‘কমিউনিস্ট’ সিলমোহর। আর একই সঙ্গে পরিচয়সত্তার কথা এসেছে, যেখানে তিনি মুসলমানদের দুঃখ-কষ্টের কথা বলেছেন, সামনে এনেছেন প্যালেস্টাইনের মানুষের দুর্দশার ছবি। পাকিস্তানের প্রসঙ্গও এই রকম আলোচনায় আসছে, ভারতের বর্তমান শাসকের পক্ষে যে বিষয়টি যারপরনাই বিরক্তিকর। সব থেকে বড় কথা, জ়োহরান নিজের মুসলমান পরিচয় লুকিয়ে রাখার এতটুকু চেষ্টা করছেন না। এক দিকে দক্ষিণপন্থী পুঁজিবাদী ভাষ্য, আর অন্য দিকে উদারবাদী বামপন্থা— এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব যথেষ্ট প্রকট আজকের মার্কিন মুলুকে। সেই দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির এক দিকে ট্রাম্পের আস্ফালন, অন্য দিকে উদারবাদী বামপন্থী ভাবনায় পুষ্ট বুদ্ধিজীবী বাবা-মায়ের অভিবাসী সন্তান নিউ ইয়র্কের রাজনৈতিক মঞ্চ কাঁপাচ্ছেন। সুতরাং উল্টো দিকটাও মাথায় রাখতে হবে, যেখানে অনেকে ট্রাম্পকে মনে করছেন ‘নতুন আমেরিকা’র রূপকার, আর জ়োহরান এক আপদ, যে কি না মার্কিন যুদ্ধসঙ্গী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে জেলে ভরার নিদান দেয়!

Advertisement