অতনু রায়
‘হরিণের কাজল-চোখ নিয়ে আমাদের বেদনাগুলি ভালোবাসার কাছে আসে / শ্বাপদের উদগ্রীব থাবা নিয়ে আমাদের ভালোবাসাগুলি আকাঙ্ক্ষার কাছে যায়’—
Advertisement
পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতায় ভেবেছিলেন বেদনা, ভালোবাসা আর আকাঙ্ক্ষাই আমাদের শিকড়। বোলপুরের মোহনপুর গ্রামে দেখলাম বিভূতিভূষণ আর পূর্ণেন্দু মিলেমিশে একাকার ব্রাত্য বসুর ভাবনায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটো ছোটগল্প ‘দ্রবময়ীর কাশীবাস’ আর ‘দাদু’, মিলেমিশে ব্রাত্য বসুর পরিচালনায় তৈরি হচ্ছে ‘শেকড়’। অভিনয়ে লোকনাথ দে, সীমা বিশ্বাস, চঞ্চল চৌধুরী, অনসূয়া মজুমদার, ঋদ্ধি সেন, অনুজয় চট্টোপাধ্যায়, অঙ্গনা রায়, জয়তী চক্রবর্তী প্রমুখ। প্রযোজনায় ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশন আর উলকি এন্টারটেইনমন্ট প্রাইভেট লিমিটেড।
Advertisement
শুটিং চলছে জমিয়ে। গ্রামবাসীদের ঔৎসুক্য দেখে আড্ডা জমাতেই খোঁচা লাগল মনের স্পর্শকাতর অংশে। ‘আমাদের গ্রামের কথা বলছে গো! এখন আর কেউ বলেনি! সব বড়লোকদের বই।’ আমরা তো সত্যিই আর সেভাবে গ্রামের ছবি বানাই না। মেঠো আদরে সিনেমাকে বই বলাও উধাও। ভাবতে ভাবতেই পৌঁছলাম সেটে। ব্রাত্য শট বুঝিয়ে দিচ্ছেন চিত্রগ্রাহক সৌমিক হালদারকে। চোখ গেল বাড়ির গায়ে প্রেমিকার খোলা চুলের মতো অবিন্যস্ত বটের ঝুরির দিকে। সিনেমার সেটে বাইরের কেউ গেলে অদ্ভুত পরিস্থিতি। হঠাৎ বোঝা যায় না কতটা অংশ ক্যামেরায় ধরা পড়ছে, তাই প্রায়ই ভুল জায়গায় দাঁড়ানো হয়। টেকনিশিয়ানদের ব্যস্ততা বাড়ে। শুটিংয়ের আকর্ষণে সেই ভুল লজ্জা দিলেও মন উঁকি দিতে চায়। ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করছেন প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়, পোশাক পরিকল্পনায় সাবর্ণী দাস, সম্পাদনা করবেন সংলাপ ভৌমিক। এর মধ্যেই, সাইকেলে চেপে শট দিতে প্রস্তুত চঞ্চল। পরিচালকের চোখ মনিটরে। আমার অপেক্ষা, শট শেষে পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে নেওয়ার জন্য।
পরিচালকের কথায়, ‘দুটো গল্পের কাঠামো নিয়ে মিলিয়ে মিশিয়ে এই সময়ের ভিয়েনে রান্না করা। রেসিপি প্রাচীন, খাবার এই সময়ের।’
আগে ‘ডিকশনারি’ ছবিতেও বুদ্ধদেব গুহর দুটো গল্প এক জায়গায় এনেছিলেন। কতটা চ্যালেঞ্জিং? পরিচালকের জবাব, ‘ভীষণই চ্যালেঞ্জিং। দুটো গল্প আলাদা সময় এবং লোকেলে লেখা। সেটাকে একটা লোকেলে এনে সাবটেক্সট তৈরি করে নতুন চরিত্রের আমদানি করতে হয়েছে। এখানে গল্প তিন প্রজন্ম পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে ‘একটা’ ন্যারেটিভে পরিণত হয়েছে। যারা গল্পটা পড়েছেন তারাও বুঝতে পারবেন না দুটো আলাদা গল্প ছিল।’
দর্শক যখন ক্লাসিক সাহিত্যের সঙ্গে ছবি মেলাতে পারবেন না, তখন? পরিচালকের বক্তব্য, ‘সাহিত্য আর চলচ্চিত্রের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। সাহিত্যকে একটা আধার হিসেবে দেখাই ভালো।’
ইতিমধ্যেই সাইকেল ছেড়ে কিছুটা ফাঁকা চঞ্চল চৌধুরী। ওঁর প্রথমবার শান্তিনিকেতন আসা। মেঠো পথে সাইকেল চালাতে গিয়ে তাঁর মননে দুই বাংলা মিশে যাচ্ছে। বললেন, ‘আমার মন প্রায়ই আমার সঙ্গে থাকে না। শহুরে যাপনের ইট-কাঠ ছেড়ে চলে যায় আমার বেড়ে ওঠার গ্রামে।’
শিল্প নির্দেশক কৌশিক দাসের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে এল আরেক বিরল গল্প। কৌশিক বললেন, ‘১০ কিলোমিটার দূর থেকে ছবির প্রয়োজনে ৩০ ফুট নারকেল গাছকে শেকড় সহ তুলে এনে আরেক জায়গায় বসানো হয়েছে।’ কৌশিক শুরুতে বলেছিলেন, ‘চিত্রনাট্য ঘটনাবহুল নয়’। চিত্রনাট্য ঘটনাবহুল না হলে শুটিং ঘটনাবহুল হবে না কে বলল! বলতে ইচ্ছে করছে: শেকড়ের প্রয়োজনে শেকড়ের আসা; অনুভূতি ছুঁয়ে যায়, শুধু ভালবাসা।
লোকনাথ দে এই সময়ের অপরিহার্য একজন অভিনেতা। চঞ্চলের চরিত্রের বাবা তিনি। অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র। ওঁর কথায়, ‘ব্রাত্যদার সঙ্গে কাজের সুবিধা, অবাধ স্বাধীনতা। ‘হুব্বা’র সময়ে চিত্রনাট্যও দেননি। এবার দিয়েছেন। অনেকগুলো দৃশ্যে অভিনয় করে ফেলেছি, কীভাবে করতে হবে বলেননি। প্রয়োজন হলে বলবেন, না হলে নয়।’
মেকআপের দায়িত্বে সোমনাথ কুণ্ডু। লোকনাথের যে লুক দিয়েছেন তাতে বলা যায়, চর্চা হবেই। সোমনাথ বললেন, ‘আমার কাছে অভিনেতা ক্যানভাস। লোকনাথদা স্থির হয়ে বসে থাকছেন দেড়-দু ঘণ্টা। আমার কাজ মনের মতো ফুটিয়ে তুলতে পারছি।’
ভালবাসার গল্প হিসেবেই এই ছবিকে দেখছেন ব্রাত্য। ওঁর কথায়, ‘সারা পৃথিবী জুড়ে ক্যাকোফনি, সোশ্যাল মিডিয়ায় বাড়তে থাকা হিস্টিরিয়া, ট্রোলিং, বাড়ছে সাব-হিউম্যান এলিমেন্ট। মানুষ অন্য প্রাণীর থেকে আলাদা সেটা মানুষ নিজেই প্রমাণ করেছে। নতুন করে মানবিকতার গল্প বলে আবার প্রমাণ করতে হবে, সে আলাদা।’
আমাদের অনেক অনুভূতি যেমন ক্ষয়ে গেলেও রয়ে গেছে, তাকেই উদ্যাপন করবে এই ছবি। ‘শেকড়’ আসলে ব্রাত্য বসুর সিনেমাভাষ্যে এক ভালবাসার উজ্জীবন।
Advertisement



