প্রবীর মজুমদার
হিমালয় অঞ্চলের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ লাদাখ উপত্যকা। সম্প্রতি ভারত-চীন উত্তেজনার কেন্দ্রে ছিল এই উপত্যকা। বুধবার জেন-জি নেতৃত্বাধীন সহিংস বিক্ষোভের মাধ্যমে উত্তাল হয়ে উঠেছে অঞ্চলটি। বিক্ষুব্ধ তরুণরা বিজেপির আঞ্চলিক কার্যালয়ে আগুন দিয়েছে। লাদাখকে পৃথক রাজ্য গঠন, সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত করার দাবিতে ও চাকরিতে কোটার দাবিতে বুধবার পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত এবং ৮০ জনের বেশি আহত হয়েছে। সংঘর্ষে বহু সংখ্যক নিরাপত্তাকর্মীও আহত হয়েছেন।
Advertisement
বুধবারের গোলমালের জন্য সরকার যাঁকে ‘মাস্টার মাইন্ড’ ঠাউরেছে, ম্যাগসেসে পুরস্কারপ্রাপ্ত সেই শিক্ষাবিদ ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সোনম ওয়াংচুকের সংস্থার বিরুদ্ধে বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর লাইসেন্স বাতিল করে তাঁর সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তও শুরু করেছে। অর্থাৎ অশান্ত লাদাখ শান্ত করতে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার পরিচিত পথেই হাঁটছে।
Advertisement
লাদাখের স্বার্থে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে কয়েক বছর ধরে সোনম ওয়াংচুক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। এই প্রথম অশান্তি ছড়াল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, সোনমই জনতাকে সহিংস হতে উসকানি দিয়েছেন। যদিও এ যাবত তেমন আচরণের কোনো উদাহরণ নেই। লাদাখের প্রকৃতি, পরিবেশ, জনগণ, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবিদাওয়া পেশ করতে থাকেন ওয়াংচুক। উন্নয়ন ও পর্যটনের নামে নির্বিচার প্রকৃতি নিধনের প্রতিবাদে অনশন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। লাদাখের খনিজ সম্পদ শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার সরকারি উদ্যোগের বিরোধিতাও তিনি করতে থাকেন। এভাবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ও নেতাদের ছাপিয়ে একসময় সোনম ওয়াংচুকই হয়ে ওঠেন আপামর লাদাখি মানুষের প্রতিনিধি। দাবি আদায়ে দিল্লি অভিযানও তিনি করেছিলেন।
লাদাখের মানুষের মতে, একদিকে সরকারি ঔদাসীন্য, অন্যদিকে অনশনরত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজনের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় জনতার একাংশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বিজেপির একাংশ অবশ্য বলাবলি করেছে, সোনম পাকিস্তানের মদদ পাচ্ছেন। এ রটনার কারণ গত ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে আয়োজিত জলবায়ু সম্মেলন ‘ব্রিদ পাকিস্তান’–এ সোনমের যোগদান। পাকিস্তানি সংবাদপত্র ‘ডন’ ছিল সেই সম্মেলনের আয়োজক। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা প্রচার করছে, পাকিস্তান থেকে ফেরার পরই পৃথক রাজ্যের মর্যাদার দাবিতে নতুন আন্দোলন শুরু করেন সোনম ওয়াংচুক। এখন তাঁকে মদদ দিচ্ছে কংগ্রেসও। বিজেপি সরাসরি অভিযোগ করেছে, হিংসাত্মক ঘটনায় স্থানীয় কংগ্রেস নেতারাও যুক্ত।
পূর্বতন জম্মু–কাশ্মীর রাজ্যের অঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধপ্রধান লাদাখ কিন্তু বরাবর শান্তিপ্রিয় অঞ্চল। কাশ্মীর উপত্যকার অশান্ত হয়ে ওঠার শুরুও সেই ১৯৮৯ সালে। উপত্যকা থেকে হিন্দু পণ্ডিতদের বিতাড়নের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল অশান্তি। সেই অশান্তি ক্রমে জম্মুতে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮৯ সালেই বৌদ্ধ ও মুসলিমদের মধ্যে সামান্য কিছুদিনের ছোটখাটো সংঘর্ষ ছাড়া লাদাখের বিস্তীর্ণ এই অঞ্চল শান্তই থেকেছে। ৩৬ বছর আগের সেই সংঘর্ষ ছিল মুসলিমপ্রধান কাশ্মীরি আধিপত্য থেকে বৌদ্ধদের মুক্তিলাভের তাগিদে। যদিও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।ওই সময় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একাংশের প্রতিরোধের পাশাপাশি সরকার ও প্রশাসন হিংসা থামাতে উদ্যোগী হয়েছিল। আশ্চর্যজনকভাবে তা কিন্তু লাদাখের শিয়া মুসলিম অথবা বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রভাব ফেলেনি।তারপর থেকে লাদাখে অশান্তির আগুন জ্বলেনি।
এবার লাদাখের বৌদ্ধদের দাবিকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন কারগিলের মুসলিমরাও। পৃথক রাজ্য ও সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত হওয়ার দাবিতে তারাও সরব। বৃহস্পতিবার গোটা অঞ্চলের জনজীবন স্তব্ধ ছিল। সারার্থ, লাদাখের মুসলিম ও বৌদ্ধরা দাবি আদায়ে একজোট। গত ছয় বছর ধরে লাদাখের হাজার হাজার মানুষ স্থানীয় নাগরিক সংস্থাগুলোর নেতৃত্বে বৃহত্তর সাংবিধানিক সুরক্ষা ও ভারতের কাছ থেকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দাবি করে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল ও অনশন করছেন। লাদাখবাসী চান একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের ক্ষমতা। ২০১৯ সাল থেকে লাদাখ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। গত বুধবার ছিল লাদাখের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিন।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের ‘এক দেশ, এক নিশান, এক বিধান’ নীতি রূপায়ণের তাগিদে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট নরেন্দ্র মোদি সরকার জম্মু–কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেয়। খারিজ করে দেওয়া হয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ। সেই সঙ্গে রাজ্য ভেঙে গড়া হয় দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। জম্মু–কাশ্মীর ও লাদাখ। জম্মু–কাশ্মীরের বিধানসভা জিইয়ে রেখে সরকার প্রতিশ্রুতি দেয়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে জম্মু–কাশ্মীরকে ফের পূর্ণাঙ্গ রাজ্য করে দেওয়া হবে। কিন্তু লাদাখ থাকবে কেন্দ্রশাসিত। সরকারের সেই সিদ্ধান্তকে লাদাখের জনগণ স্বাগতও জানিয়েছিল। জম্মু ও কাশ্মীরের আধিপত্যমুক্ত হয়ে তারা খুশি হয়েছিল।
রাজ্যের মর্যাদার দাবি লাদাখের জনগণ এই বছরের গোড়াতেও কিন্তু জানায়নি। তারা চাইছিল, আঞ্চলিক সত্ত্বা রক্ষা করতে সরকার তাদের স্বশাসন দিক। সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় নিয়ে আসুক। বর্তমানে লেহ্ ও কারগিলের জন্য একটি আসনের পরিবর্তে দুটি লোকসভার আসন দিক এবং লাদাখের জন্য একটি পৃথক পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করুক। এসব দাবিদাওয়া নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। যদিও ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত করার বিষয়ে সরকার বরাবর নিরুত্তর থেকেছে। সংবিধানের ২৪৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য স্বশাসিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা বন্দোবস্ত করা যায়। লক্ষ্য সেই অঞ্চলের বৈশিষ্ট, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা। যেমনটি আছে আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম ও ত্রিপুরার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায়।
২০১৪ সালে বিজেপি প্রথমবারের মতো লাদাখ লোকসভা আসনে জয়ী হয়। ২০১৯ সালেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল। রাজ্য ভাগের পরের বছরেই ঘটে যায় পূর্ব লাদাখের গালওয়ানে ভারত–চীন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। সংঘর্ষের পর বিজেপি–দলীয় সংসদ সদস্য ভারতীয় জমি দখল করে নেওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন চীনের বিরুদ্ধে। অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য ছিল, কেউ এক ইঞ্চি জমিও দখল করেনি।
আলোচনা সত্ত্বেও দাবি না মেটায় লাদাখি মন যে কেন্দ্রের শাসক দলের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে। বিজেপি ও কংগ্রেসকে হারিয়ে জয়ী হন ন্যাশনাল কনফারেন্স ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী মুহাম্মদ হানিফা। মানুষ যে ক্রমেই বিজেপির ওপর অসন্তুষ্ট, তার প্রমাণও পাওয়া যায় গত বুধবারের সহিংসতায়।লেহতে বিজেপির দলীয় কার্যালয়ে আগুন দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। আন্দোলনকারী জনতা গণমাধ্যমকে বলেছেন, তাঁরা বুঝেছেন, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তাঁদের স্বশাসন দিতে চায় না। কেন্দ্র লাদাখকে মুঠোবন্দি করে রাখতে চায়।মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতারি গুরুতর বিষয় শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশের অধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক মহলে ইতোমধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়েছে। দমননীতি কোনো সমাধান নয় কংগ্রেসও বলছে ওয়াংচুকের গ্রেফতার সরকারের অক্ষমতা ঢাকার চেষ্টা। মনে রাখতে হবে , লাদাখের সাক্ষরতার হার ৯৭ শতাংশ, যা ভারতের জাতীয় গড়ের প্রায় ৮০ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, লাদাখের স্নাতকদের ২৬.৫ শতাংশ বেকার – যা জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ।
পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে এখন সেটাই বড় প্রশ্ন। বিশ্লেষকদের মতে, গ্রেফতার সাময়িকভাবে উত্তেজনা কমালেও সমস্যা সমাধান হবে না। লাদাখবাসীর দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় না বসলে পরিস্থিতি আরও অস্থির হয়ে উঠতে পারে। এখন লাদাখের মানুষ অপেক্ষা করছে সরকার সত্যিই আলোচনার পথে হাঁটবে নাকি কঠোর নীতি নিয়েই এগোবে। সোনম ওয়াংচুকের ‘স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ’–এর লাইসেন্স বাতিল করার মধ্য দিয়ে সরকার বুঝিয়ে দিচ্ছে, তাঁর অতিসক্রিয়তা ভালো চোখে দেখা হচ্ছে না। বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর কাশ্মীর উপত্যকা এখনো স্বাভাবিক নয়। কেন্দ্রীয় সরকার মোটেও চাইবে না এ পরিস্থিতিতে লাদাখও অশান্ত হোক। যাঁর ডাকে লাদাখের আপামর জনতা জোটবদ্ধ, আপাতত তাঁকে কোণঠাসা করে সরকার পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চাইছে। কিন্তু তাতে লাদাখি মন জেতা যাবে কি? জম্মু–কাশ্মীরের পাশাপাশি লাদাখ অশান্ত থাকলে দেশের অখণ্ডতার পক্ষে তা হবে বিপজ্জনক।
Advertisement



