• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

টিনার গল্প

চোরকে তো ছেড়ে দেওয়া হলো, বাবা বললেন লোকটা ভয়েই আধমরা হয়ে গেছে, মনে হয় না আর কখনো চুরি-টুরি করবে, সুতরাং ওকে আর শাস্তি দেবার দরকার নেই।

কাল্পনিক চিত্র

মিষ্টিবৃষ্টি রায়

টিনার নাম রাখা হয়েছিলো সেই সময়ের এক ফিল্মস্টারের নামে।
টিনা বিলিতি কুকুর, জাতে পমিরেনিয়ান, দেখতে ধবধবে সাদা, ছোট্টো মাপের, লোম-ঝুমঝুমে সুন্দরী।
হলে হবে কি, সে মোটেই অহঙ্কারী ছিলো না, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসতো।
তার একমাত্র দোষ ছিলো নাগালের মধ্যে নিচু হলেই মুখ চেটে দেওয়া। এমনিতে আমার মায়ের খুব ন্যাওটা ছিলো, মা সোফায় কি চেয়ারে বসলেই, মায়ের পায়ের কাছে এসে বসতো, যতোটা সম্ভব গা ঘেঁষে, মায়ের হাঁটুতে পিঠ হেলান দিয়ে। মা ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, লোম আঁচড়ে দিতেন ।
মা যেহেতু কুকুর ভালোবাসতেন, টিনার গা ঘেঁষে বসা তাঁর ভালোই লাগতো, কিন্তু সবাই তো আর কুকুর ভালোবাসে না, বরং অনেকেই ভয় পায়। টিনা এটা বুঝতো না, ও সবার সঙ্গেই ভাব করতে চাইতো, ভাবতো সবাই ওকে মায়ের মতো সমানভাবে ভালোবাসবে— কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়, টিনা ছোটো মাপের, নিরীহ, এবং জীবনে কাউকে
না-কামড়ানো কুকুর হলেও, অনেকেই ওকে ভয় পেতো।
আমাদের বাড়িতে এক বয়স্ক মুড়িওয়ালা আসতেন, বাড়ি-বাড়ি মুড়ি বিক্রি করতে, তিনি দরজার সামনে এসে বসলেই টিনাও প্রচণ্ড খুশি হয়ে লেজ নাড়তে-নাড়তে তাঁর গায়ে হেলান দিয়ে যথাসম্ভব তাঁর গা-ঘেঁষটে বসতো। তিনি ভয় পেয়ে যতোই দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেন, সেও ততোই আরো খুশি হয়ে তাঁর কাছে ঘেঁষে আসতো এবং মুখ চেটে দেবার চেষ্টা করতো।
তিনি শেষকালে ভয় পেয়ে চিৎকার করে বলতেন, ‘ওরে, আমি গরিব মানুষ, আমায় কামড়াস না! এই যে, আপনারা ওকে একটু সরিয়ে নিন না, আমার ভয় করছে!’
আমরা যতোই বলতাম ভয় পাবেন না, ওর আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছে, ভালোবাসছে, উনি ততোই আরো ভয় পেতেন।
শেষকালে আমাদের বাড়ি আসাই ছেড়ে দিলেন, বাবাকে তখন দূরের বাজার থেকে মুড়ি আনতে যেতে হতো।
একবার এক দিদা আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসে ওকে বেঁধে রাখতে বললেন। এমনিতে ও ছাড়াই থাকতো, তবে উনি খুব ভয় পাচ্ছিলেন বলে আমরা উনি থাকাকালীন টিনাকে নিচের বারান্দায় শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে বাধ্য হলাম।
টিনা যে এতে ওঁর ওপরে রাগ করেছে সেটা তখুনি বোঝা যায়নি, উনি গল্প-টল্প করে চলে যাবার সময় যতোই নিজের পায়ের চটিতে পা গলাবার চেষ্টা করেন, কিছুতেই পা গলে না। এতোক্ষণ উনি চটি পরতে-পরতে মায়ের সঙ্গে সমানে গল্প করছিলেন, নিচে তাকাননি, এবার নিচে তাকাতেই আক্কেল গুড়ুম! চটিজোড়ার শুধু সুকতলা দুটো পড়ে আছে, ওপরের পা-গলাবার জায়গাটা নেই!
টিনা কাছেই বাঁধা ছিলো, বাঁধা অবস্থাতেই কী করে যেন দিদার চটিজোড়া কাছে টেনে নিয়ে ওপরগুলো বেমালুম খেয়ে হজম করে ফেলেছে! আবার আধ-খাওয়া এঁটো চটিজোড়া ঠেলে যথাস্থানে ফেরৎও দিয়েছে।
আর কী করা যায়, সেই দিদা তো মায়ের পুজোয় কেনা নতুন চটি পরে বাড়ি চলে গেলেন, ওঁরগুলো বেশ পুরনো ছিলো। টিনাকে বকাবকি করতে ও জিভ বার করে হাসি-হাসি মুখ করে বসে থাকলো, বোঝা গেলো ও বেশ খুশি হয়েছে, কুকাজ করার জন্যে একটুও অনুতপ্ত নয়।
এর থেকেও বেশি রোমহর্ষক ঘটনা হলো, টিনার চোর ধরা। নিরীহ আর হাসিখুশি ধরনের স্বভাব ছিলো বলে আমরা কেউ ভাবিনি ও কখনো সত্যি-সত্যি চোর ধরতে পারবে, কিন্তু ধরেছিলো।
গরমের ছুটির মধ্যে একদিন রাত্রে আমরা দেরি করে খেতে বসেছি, এমন সময়ে টিনা খুব জোরে জোরে ডাকতে লাগলো।
ও রোজ রাত্রে ঘুমোবার আগে একটু বাগানে বেড়াতে যেতো। আমরা ওর ডাক শুনে ভাবলাম ও হয়তো কিছু বিপদে পড়েছে, বাগানে সাপ-খোপ বেরিয়ে থাকতে পারে।
সবাই ছুটে গেলাম, গিয়ে তাজ্জব হয়ে দেখি আমাদের ছোট্টো টিনা একটি রীতিমতো আস্ত-মস্ত মুশকো চেহারার চোর ধরেছেন।
লোকটা বোধহয় ফলমূল চুরি করতে এসেছিলো, এখন টিনার প্রতাপে কাবু। এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। হাত থেকে চুরি করা ফলমূল সব পড়ে গেছে, ভয়ে কাঁদো-কাঁদো হয়ে গেছে।
টিনা ওর সামনে দাঁড়িয়ে ওকে বকছিলো, এখন আমাদের দেখে বিজয়গর্বে লেজ নাড়তে লাগলো, তারপর সটান গিয়ে চোরটার পায়ের ওপর গা-ঘেঁষটে, চোরের হাঁটুতে পিঠ হেলান দিয়ে বসে পড়লো। বোঝা গেলো চোরটিকে তার বড্ডোই পছন্দ হয়েছে, নাগাল পেলে চোরের মুখ চেটে দেয়!
চোর অবশ্য সেটা বুঝতে পারেনি, সে তো ভয়ে প্রায় অজ্ঞান।
যাই হোক, চোরকে তো ছেড়ে দেওয়া হলো, বাবা বললেন লোকটা ভয়েই আধমরা হয়ে গেছে, মনে হয় না আর কখনো চুরি-টুরি করবে, সুতরাং ওকে আর শাস্তি দেবার দরকার নেই।
এই ঘটনার পর থেকে সবার কাছে টিনার খুব কদর বেড়ে গেলো, আমরাও জানলাম সে মাপে ছোট্টো হলেও ভীষণ সাহসী! দেখতে পুতুলের মতো সুন্দর হলেও আসলে একটি খুব ভালো জাতের ওয়াচ ডগ বা পাহারাদার কুকুর।

Advertisement

Advertisement

Advertisement