• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

এক যে ছিল আহার দেশ

জিনিয়া স্তব্ধ হয়ে গেল। সে মনে করল, গত পরশু সে এক থালা ভাত ফেলে দিয়েছিল, এই ছেলেমেয়েরা পেলে নিশ্চয় ভাগ করে খেত।

কাল্পনিক চিত্র

চন্দ্রাণী বসু

জিনিয়ার বাড়িতে গত দুই প্রজন্মে কোনও কন্যাসন্তান নেই। ফলে বাবা, ঠাকুরদা, ঠাকুমা, কাকা, কাকিমা সবার ভীষণ আদরের মেয়ে সে।

Advertisement

তার জামাগুলো, রঙিন চুলের ক্লিপ, আর বিছানার উপরে সাজানো সব খেলনারা জানে এই বাড়ির রাজকন্যা জিনিয়া! আর সবার আদরে ছোট্ট জিনিয়া মাত্র ছ’বছর বয়সেই বাড়িতে বায়নার এক সাম্রাজ্য তৈরি করে রেখেছে।

Advertisement

তবে এই রাজকন্যা পরির গল্প শুনতে ভীষণ ভালোবাসে। রোজ সে ঠাকুমার কাছে পরির গল্প শুনেই ঘুমোতে যায়।

কিন্তু তার জীবনে যত ঝামেলা হল— খাওয়া!
মা যখন গরম গরম রুটি নিয়ে আসে, জিনিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলে, ‘আমি শুধু পাস্তা খাব!’
কাকিমা পাস্তা এনে দিলে, সে বলে, ‘পাস্তা কেন? আমি আজ পায়েস খাব!’
ঠাকুমা পায়েস বানিয়ে দিলেও, এক চামচ খেয়েই বলে, ‘ইইই… এত মিষ্টি! আমি ভাত খাব।’
তারপর প্লেট সরিয়ে দেয়, আর খাবার চলে যায় ডাস্টবিনে।
মা বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘জিনু, কতবার তোমায় বলেছি খাবার ফেলতে নেই! যারা রান্না করে, তাদের কষ্ট হয়, আর তোমার মতো অনেকেই না খেয়ে থাকে।’
কিন্তু জিনিয়া শুনেও শোনে না। তার জন্য রোজ কিছু না কিছু খাবার ফেলতে হয়। পাস্তা, পায়েস, খিচুড়ি, সব কিছুই।
মা হতাশ হয়ে মাঝে মাঝে বলেন, ‘পরিরা যদি সত্যি থাকত, তাহলে তোকে নিয়ে গিয়ে ঠিক একদিন শিক্ষা দিত!’

একদিন রাত তখন প্রায় এগারোটা। জিনিয়া নিজের বিছানায় গোলাপি চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। চারদিকে নীরবতা। হঠাৎ জানালার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক রঙিন আলো ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর।
আলো যেন জিনিয়ার চারপাশে ঝিকিমিকি করে নাচছে! তারপরই জানালার বাইরে ভেসে উঠল এক অপূর্ব দৃশ্য।

এক পরি! তার সোনালি চুল, সাদা পোশাক, নীল-রুপোলি পাখা, হাতে ছোট্ট একটা জাদুর ছড়ি।
পরি মিষ্টি গলায় বলল, ‘জিনিয়া, তোমার নাম আমি জানি। আমি আহার-দেশের পরি, আমার নাম পরিজা। তোমার জন্য সেই দেশ থেকে নিমন্ত্রণ নিয়ে এসেছি!’
জিনিয়া আনন্দে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘কোথায় নিমন্ত্রণ? কেন?’
পরি হেসে বলল, ‘তুমি পরিদের গল্প শুনতে ভালোবাসো বলে তোমাকে ‘আহার দেশে’ নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। সঙ্গে তিনটি জায়গা ঘুরে দেখারও আমন্ত্রণ আছে। ভয় পেয়ো না, এই আহার দেশে নানা খাবার তুমি দেখতে পাবে।’
জিনিয়া ভারি কৌতূহলে এগিয়ে গেল পরির দিকে।
‘চোখ বন্ধ করো,’ বলল পরি।
জিনিয়া চোখ বন্ধ করতেই চারপাশে আলোর ঝলকানি! যেন বাতাসে উড়ে যাচ্ছে সে। ধীরে ধীরে গন্ধ পেল পায়েস, লুচি আর চকোলেটের।
চোখ খুলতেই সে দেখতে পেল তার চারপাশে এক আজব রঙিন দেশ!
জিনিয়া এখন ‘আহার’ দেশে। যেখানে সব কিছু খাবারে তৈরি! গাছপালা চকোলেটের, নদী দুধ-সিরার, আর আইসক্রিমের পাহাড় কুয়াশার মতো দাঁড়িয়ে।
পায়ের নীচে নরম কেকের মতো মাটি। বাতাসে ভেসে বেড়ায় জিলিপির ঘ্রাণ।

জিনিয়ার সামনে একটা গাড়ি এসে থামল, গাজরের তৈরি। ড্রাইভার এক হাঁস, যার টুপি আবার কচুরির মতো!
হাঁস ড্রাইভার বলল, ‘ম্যাডাম জিনিয়া, দয়া করে উঠুন! আপনাকে রানির প্রাসাদে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে।’
জিনিয়া গাড়িতে উঠতেই গাড়ি চলতে শুরু করল। আশেপাশে নানা ধরনের খাবার জীবন্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে… লাড্ডু হাত ধরে হাঁটছে, পাঁউরুটি দোলনায় দুলছে। জিনিয়ার ভারি মজা লাগল।

পরি বলল, ‘এই দেশের শাসক রানি পেঁয়াজু মা। তার ঝাঁঝালো আদেশেই এই দেশের সবাই নিয়ম মানে।’
প্রাসাদে পৌঁছতেই জিনিয়া দেখল এক বিশাল চকোলেটের বাড়ি, সামনে লেখা, ‘আহার দেশ: রানি পেঁয়াজু মা।’
বাড়ির ভিতরে রানি পেঁয়াজু মা বসে আছেন এক বিরাট কাঁসার সিংহাসনে। মাথায় গয়নাবড়ির মুকুট, গলায় সবুজ মটরশুঁটির মালা, কানে সবুজ লঙ্কার দুল।

তিনি হেসে বললেন, ‘জিনিয়া! এসো, আমি সব জানি। তোমার কোনও খাবার পছন্দ হয় না, তাই খাবার নষ্ট করো, ফেলে দাও। আজ তোমাকে তাই তিনটি জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাব।’
জিনিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে। রানির চোখ দুটো নরম হলেও গম্ভীর।
জিনিয়া জানতে চাইল, ‘কোথায় কোথায়?’
—‘খাবারের জঙ্গল, ক্ষুধার উপত্যকা, বিশুদ্ধ রাঁধুনির রান্নাঘর। এই তিন জায়গা ঘুরে এলে তবেই তুমি ঘরে ফিরতে পারবে।’
পরিজা বলল, ‘আমি সঙ্গে থাকব। ভয় পেয়ো না, জিনিয়া।’
জিনিয়া কিছুটা ভয় আর কিছুটা কৌতূহলে চুপচাপ মাথা নাড়ল।
পরি তার জাদুকাঠি ঘোরাল, আবার চারপাশে এক ঝলক আলো ছড়িয়ে পড়ল।

জিনিয়ার চারপাশে এক ভয়ানক খাদ্য-জঙ্গল। গন্ধে টেঁকা দায়! গাছগুলো বাসি লুচির মতো, পাতায় মাছের কাঁটা, মাটিতে পচা ভাত আর ফেলে দেওয়া আলু।
একটা পচা ডিম এগিয়ে এসে জিনিয়াকে বলল, ‘তুই তো আমায় ফেলে দিয়েছিলি! পচে যাওয়ার আগেই! আমি মোটেই খারাপ ছিলাম না!’
একটা শুকনো রুটি কাঁদতে কাঁদতে এসে বলল, ‘জিনিয়া, আমি তো তোমার সেদিনের ব্রেকফাস্ট। খেতে পারতে, কিন্তু ফেলে দিলে।’

জিনিয়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। সে বলল, ‘আমি তো বুঝিনি! আমি তো ভাবতাম ওগুলো খারাপ।’
একটা ছোট পেঁয়াজ বলল, ‘সব খাবার খারাপ হয় না। কখনো খেতে একটু সময় বা মনোযোগ লাগে।’
জিনিয়া নাক চেপে দাঁড়িয়ে, আর বুঝতে পারছে এদের তাচ্ছিল্য করেই সে ফেলেছিল। কিন্তু পচা গন্ধে সে আর থাকতে পারছিল না।

সে বলল, ‘এরা খুব দুঃখী। আমি না খেয়ে এদের ফেলে দিয়ে খুব খারাপ কাজ করেছিলাম।’
এরপর জিনিয়া পরির সঙ্গে গেল একটা ফাঁকা ধূ-ধূ উপত্যকায়। কোথাও কিছু নেই। না গাছ, না নদী, না খাবার। শুধু পাথরের মতো ধুলো-মাটি।

তবে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কিছু ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। কারও পেটে হাত, কারও চোখে জল।
তারা বলল, ‘আমরা ক্ষুধার্ত। কতদিন কিছু খাইনি, যদি একটা রুটি পেতাম…।’
একজন বলল, ‘মা বলেছিল কাল ভাত আনবে, কিন্তু কিছু পেল না।’

জিনিয়া স্তব্ধ হয়ে গেল। সে মনে করল, গত পরশু সে এক থালা ভাত ফেলে দিয়েছিল, এই ছেলেমেয়েরা পেলে নিশ্চয় ভাগ করে খেত।
ধীরে ধীরে পরির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি যদি ওদের কিছু খাবার দিতে পারতাম। আমি যে সব ফেলে দিয়েছিলাম।’
পরি বলল, ‘প্রতিদিন তুমি খাবার ফেলো। অথচ এই শিশুরা একটুকরো খাবার পায় না।’
জিনিয়ার চোখে জল এসে গেল।
—‘আমি এখন বুঝেছি। আমি বদলাতে চাই।’
পরি মাথা নেড়ে বলল, ‘তবে চলো, শেষ জায়গায়— রাঁধুনির রান্নাঘর।’

এই ঘর ছিল ভীষণ ঝকঝকে। চারদিকে ধোঁয়া উঠছে হাঁড়ি থেকে, রাঁধুনিরা ঘেমে নেয়ে কাজ করছে।
একজন বৃদ্ধা রাঁধুনি এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমি সেই মা, যে পায়েস বানায়। কেউ না খেয়ে ফেলে দিলে, আমার মন ভেঙে যায়।’

আরেকজন বলল, ‘আমরা রান্না করি ভালোবাসা দিয়ে। কেউ যদি এক চামচ না খেয়ে ফেলে দেয়, তখন মন কাঁদে।’

জিনিয়ার মনে পড়ল তার মায়ের মুখের ক্লান্তি। সে কতবার বলেছে, ‘তুই বুঝিস না, রান্না করতে কত কষ্ট।’
সে ধীরে ধীরে বলল, ‘আমি কথা দিচ্ছি, আর কখনও খাবার ফেলব না। প্রতিটা খাবার ভালোবেসে খাব।’
রাঁধুনিরা হাসলেন। পরি মাথায় হাত রেখে বলল, ‘এবার তোমার ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে।’
পরি তাকে আহার দেশ থেকে পছন্দের খাবার বেছে নিতে বলল। কিন্তু সে কিছুই নিতে চাইল না। বলল, ‘মায়ের হাতের খাবারই তার পছন্দের খাবার।’

মায়ের ডাকে চোখ খুলে জিনিয়া দেখল, সে তার বিছানায়! জানালার বাইরে রোদ উঠেছে। মা ডাকছে, ‘জিনু, ওঠ আজ স্যান্ডউইচ দিয়েছি!’

জিনিয়া দৌড়ে খাবার ঘরে গেল। দেখল, টেবিলে স্যান্ডউইচ আর ডিমের পোচ।
সে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মা, তুমি এত কষ্ট করে রাঁধো! আমি সব খাব। আর কখনও ফেলব না।’
মা থতমত খেয়ে বলল, ‘তুই ঠিক আছিস তো?’

জিনিয়া হাসিমুখে খেতে বসল। আর মনে মনে ভাবল, তুমি তো জানো না মা, পচা খাবারের জঙ্গল, ক্ষুধার উপত্যকা, রান্নাঘরের রাঁধুনিরা আমাকে একদম বদলে দিয়েছে। আমি এখন খাবারের গুরুত্ব আর তোমার কষ্ট সবটাই জানি।

Advertisement