গৌতম মণ্ডল
ভারতবর্ষের উত্তরে হিমালয় ও কারাকোরাম-পর্বতমালা দ্বারা বেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি অনবদ্য ভূখণ্ড হল লাদাখ। লাদাখ শব্দটি তিব্বতি শব্দ লা (La) এবং দাখ (Dag) শব্দের সমন্বয়ে উৎপন্ন হয়েছে। তিব্বতি ভাষায় লা শব্দের অর্থ গিরিপথ এবং দাখ শব্দের অর্থ বহু। অর্থাৎ বুৎপত্তির দিক থেকে লাদাখ হল বহু গিরিপথের দেশ। সিন্ধু নদীর একটি সেতুর নীচে পাওয়া একটি খরোষটি লিপি থেকে জানা যায় প্রথম শতকে লাদাখ ছিল কুশান বংশের অধীনে। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে ডোগরা রাজা হরি সিং ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর সংযুক্তি দলিলে সই করে জম্মু কাশ্মীরকে ভারতবর্ষে অন্তর্ভুক্ত করেন। জম্মু কাশ্মীর খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। কিন্তু ২০১৯ সালের ৩১ অগাস্ট ভারতের কেন্দ্র সরকার জম্মু কাশ্মীর থেকে লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্র কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের স্বীকৃতি দেয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত এই অঞ্চলের মানুষদের অনেকদিনের দাবিও ছিল এইরকম। এখানের বৌদ্ধরা এমনিতেই শান্তিপ্রিয় মানুষ, তারপর তাঁদের দাবি প্রায় তেমন বড় কোনো আন্দোলন ছাড়াই পূরণ হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় আবার লাদাখ কেন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল? কেন কার্ফু জারি? ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ ?
Advertisement
তাহলে নেপালের মতো এও কি জেন জি-র অভ্যুদয়স্পৃহা? নাকি কেন্দ্রসরকারের চূড়ান্ত অপদার্থতা এবং সেটাকে ঢাকতে চূড়ান্ত দমনপীড়নমূলক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ? নাকি এও ডিপ স্টেটের কারসাজি?
এইসব প্রশ্নের উত্তর পেতে বিগত পঁচিশ বছর যাঁকে ঘিরে লাদাখ সংহত হয়ে উঠেছে তাঁর কার্যপ্রণালীর উপর আমাদের নজর রাখতে হবে। সোনম ওয়াংচুক (জন্ম : ১৯৬৬) কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখের পরিবেশ আন্দোলনের একজন অন্যতম মুখ এবং একজন নিরীক্ষাধর্মী শিক্ষাব্যবস্থার উদ্ভাবক। প্রকৌশলী। তিনি একবিংশ শতাব্দীর প্রায় শুরুর দিক থেকে জম্মু কাশ্মীর বা লাদাখ পার্বত্য পরিষদের শিক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি চেয়েছেন গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার । শিক্ষাকে যতখানি সম্ভব বাস্তবমুখী ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার বাহক করে তুলেছেন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার ব্যাপারেও তিনি অগ্ৰণী ভূমিকা নিয়েছেন। হিমবাহ রক্ষা, সৌরবিদ্যুতের প্রসার, জলসংকটের সমাধান ও বহুজাতিক কোম্পানির প্রকৃতি দখলের বিরুদ্ধে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে অহিংস পদ্ধতিতে আন্দোলন করে আসছেন। তিনি তাঁর সারাজীবনের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৮ সালে পেয়েছেন এশিয়ার সবচাইতে বড় ও মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার রামোন ম্যাগসেসে-সহ বহু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার। তাঁর কর্মকাণ্ড থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বলিউডের বিশিষ্ট অভিনেতা ও পরিচালক আমির খান ‘থ্রি ইডিয়টস’ চলচ্চিত্রের র্যাঞ্চোডদাস শ্যামলডাস চাঞ্চাড চরিত্রটি নির্মাণের প্রেরণা পান।
Advertisement
লাদাখের র্যাঞ্চো সোনম ওয়াংচুকের আরও একটি ব্যাপারে বেশ কিছুদিন ধরে অহিংস পদ্ধতিতে আন্দোলন করছেন। সেটা হল, লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে রাজ্যসদৃশের (Statehood) স্বীকৃতির দাবি। সেইসঙ্গে সরকারি চাকরিতে স্থানীয়দের সংরক্ষণ। এবং আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোর স্বশাসন। গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি চার দফা দাবিতে লাদাখের সবচাইতে বড় শহর লেহ-তে লাগাতার অনশন করছেন। কিন্তু অনশনরত দুই আন্দোলনকারীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় এই আন্দোলন ২৪-২৫ সেপ্টেম্বর হঠাৎই হিংসাত্মক রূপ ধারণ করে। ছাত্র, যুব ও জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ নির্বিচারে লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে। এতে নিহত হয় অন্ততপক্ষে চারজন এবং আহত হন একশোর কাছাকাছি। এঁদের কারো কারো আঘাত অত্যন্ত গুরুতর।
এদিকে হিংসা থামাতে ওয়াংচুক অনশন স্থগিত রাখার ঘোষণা দেন এবং আন্দোলনকারীদের শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানান। কিন্তু আজ ২৬ সেপ্টেম্বর হঠাৎই সুনির্দিষ্ট কারণ না দেখিয়েই NSA (National Security Act) আইনের আওতায় এনে গ্ৰেফতার করা হয়েছে। তাঁর অপরাধ? তিনি নাকি একজন রাষ্ট্রদ্রোহী। বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি জনগণকে হিংসাত্মক হয়ে উঠতে প্ররোচনা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকাও নাকি তাঁর NGO তে ঢুকেছে। এইকারণে সোনম প্রতিষ্ঠিত Students Educational and Cultural Movement of Ladhak এর লাইসেন্স সরকার বাতিল করে দিয়েছে। পাশাপাশি তাঁর প্রতিষ্ঠিত আরও একটি প্রতিষ্ঠান Himalayan Institute of Alternative Ladhak-সহ অন্যান্য প্রকল্পে অবৈধ বৈদেশিক আর্থিক লেনদেন হয়েছে এই অভিযোগে সিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওয়াংচুক সম্ভবত কিছুটা আঁচ আগেই পেয়েছিলেন। সম্ভবত সেকারণেই আগেই সংবাদমাধ্যমের কাছে বিবৃতি দিয়ে রেখেছিলেন ‘একজন সোনম ওয়াংচুক জেলে গেলেও লাদাখের আন্দোলন ঠেকানো যাবে না।’
এখন প্রশ্ন, লাদাখের আন্দোলন এই মুহূর্তে কীরকম জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে? সত্যিই কি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিবেশ আন্দোলনকারী ও ওয়াংচুক রাষ্ট্রদ্রোহীতার সঙ্গে যুক্ত? বৈদেশিক শক্তির সঙ্গে তাঁর গোপন আঁতাত আছে?
এটা ঠিকই, আমেরিকার ডিপ স্টেট ভারতবর্ষকে অস্থিতিশীল করার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। ভারতের চারপাশে যেসমস্ত প্রতিবেশী দেশ রয়েছে সেগুলোর কোনোটাই আজ আর কূটনৈতিকভাবে ভারতের বন্ধুরাষ্ট্র নয়। এদিকে লাদাখের অবস্থান এমন এক স্পর্শকাতর জায়গায় যার একপাশে রয়েছে পাকিস্তান আর অপর পাশে চীনের মতো আগ্ৰাসী এক রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র আবার লাদাখের স্বীকৃত যে বর্ডার লাইন রয়েছে তাকেই স্বীকার করে না।
এইরকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র যদি সমস্ত শক্তিও প্রয়োগ করে তাহলেও এই আন্দোলনকে দমানো যাবে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্রকে অনুধাবন করতে হবে এই অসন্তোষের মূল কারণ কী কী ?
দূর থেকে আমার যা মনে হয়, মূল কারণ হল অবশ্যই সাধারণ জনগণের প্রতি প্রশাসনের তীব্র ও নির্বিকার উদাসীনতা। সেখানের শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধ জনগণ সম্ভবত উপলব্ধি করেছেন, লাদাখকে জম্মু কাশ্মীর থেকে রাজনৈতিক কারণে আলাদাই করা হয়েছে কিন্তু জনগণের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করা হয়নি। অপরপক্ষে কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাণিজ্য করার ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। লাদাখের জনঘনত্ব খুব কম, মোট জনসংখ্যা ৩ লাখের কিছু বেশি কিন্তু আয়তনের দিক থেকে জম্মু ও কাশ্মীরের মিলিত পরিমাণে তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। লাদাখ এমনিতেই প্রাকৃতিক দিক দিয়ে ভূস্বর্গ তারপর এর মাটির নীচে রয়েছে কিছু বিরল প্রজাতির মৌল। এইসব মৌল অত্যাধুনিক স্মার্ট ফোনসহ আধুনিক প্রযুক্তিতে ব্যবহ্নত হয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাকিয়ে রয়েছে মাটির নীচে থেকে এগুলো উত্তোলন করার জন্য। এগুলো ব্যাপক হারে উত্তোলন হলে লাদাখের স্থানীয় সংস্কৃতি ও পরিবেশবৈচিত্র্য, লাদাখবাসীরা ভাবছেন, বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। খুবই সঙ্গত এই উদ্বেগ। এর মধ্যে যদি ডিপ স্টেট থেকেও থাকে তাহলে আইনানুগ পথে তা তদন্ত করতে হবে। ওয়াংচুক ছাড়াও আন্দোলনের নেতৃত্বে আর যাঁরা রয়েছেন তাঁদের সঙ্গে সংলাপে যেতে হবে। সংলাপের দিন অবশ্য একটা ধার্য হয়েছিল। ৬ অক্টোবর। কিন্তু তার আগেই এই গণ্ডগোল।
কেন্দ্র সরকারের মনে রাখা দরকার, উত্তর পূর্বে মণিপুরের মতো ছোট্ট একটি রাজ্যের হিংসাকে তাঁরা বল প্রয়োগ করেও থামাতে পারেনি। তাই এক্ষেত্রেও সমস্যার গভীরে না গিয়ে বল প্রয়োগ করলে হিতে বিপরীত হবে। মাঝখান থেকে এর ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে চীন।
মনে রাখতে হবে, সোনম ওয়াংচুক একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, লাদাখে তাঁর অবদান আছে, তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই সেখানের জনগণের উপর তাঁর প্রভাবও রয়েছে । এইরকম একজন ব্যক্তিত্বকে কোনো রকম যথেষ্ট যুক্তিগ্ৰাহ্য কারণ না দেখিয়েই একেবারে রাতারাতি NSA আইনের আওতায় এনে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে গ্ৰেফতার করা অত্যন্ত অন্যায়। এই NIA বা UAPA এমনই এক কালা আইন, রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে এই আওতায় এনে যে কাউকেই বিচার না করে দীর্ঘদিন হেফাজতে বন্দি অবস্থায় রাখতে পারে। যেভাবে প্রখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কাফিল খানকে সম্পূর্ণ বিনা কারণে এই আইনের আওতায় এনে বন্দি করে রেখেছে উত্তরপ্রদেশ সরকার। লাদাখকে শান্ত করতে এবং কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে অবিলম্বে যা প্রয়োজন তা হল, সোনমের মুক্তি।
পাশাপাশি তাঁর আচরণের মধ্যে কোথাও প্রকৃতই যদি অসঙ্গতি আছে বলে মনে হয় তাহলেও তা আইনানুগ পথে তদন্ত করে আসল সত্য দ্রুত উন্মোচিত করা হোক। যদি দেখা যায় সত্যিই বৈদেশিক শক্তির সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তিনি শান্ত লাদাখকে অশান্ত করে তুলতে চাইছেন তখন আইনানুগ পথে তাঁর সর্বোচ্চ সাজা হোক। তার আগে নয়। এটাই সম্ভবত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দায় ও দায়িত্ব।
Advertisement



