নির্মল ধর
‘দঙ্গল’ এবং ‘তারে জমিন পর’ দু’টি ছবিই আমির খানের প্রযোজনায় তৈরি। ‘দঙ্গল’ এক কথায় স্পোর্টস ফিল্ম বলা যায়, যদিও গল্পের মধ্যে জাতীয়তা ও দেশাত্ম্যবোধের অনুপান ছিল। আর ‘তারে জমিন পর’ ছিল ডিমনেশিয়ায় আক্রান্ত এক কিশোরের গল্প। আমির খান তাঁর প্রযোজনায় এই নবতম ছবি ‘সিতারে জমিন পর’কে ‘তারে জমিন পর’-এর সিক্যুয়েল বলছেন! কথাটা সম্ভবত ঠিক নয়, এই নতুন ছবির কাহিনী ও চিত্রনাট্যে (দিব্য নিধি শর্মা) বাস্কেটবল খেলাকে যতটা প্রাধান্য দিয়েছেন, সমান গুরুত্ব পেয়েছে জনা আটেক ‘আত্মসংবৃতি’ অর্থাৎ অর্টিজমে আক্রান্ত তরুণ ও এক তরুণীও। এই বুদ্ধিবৃত্তিতে খামতি থাকা দলচি নিয়ে দিল্লির বাস্কেটবল কোচ গুল্লু অর্থাৎ গুলশন অরোরা কীভাবে একটি সুসংহত দল ‘সিতারে’ তৈরি করে তারই বৃত্তান্ত পেটনে তিন ঘণ্টার এই ছবি। পরিচালক আর এস প্রসন্নর নির্দেশ পেলে সম্পাদক চারুশ্রী রায় যদি অন্তত পনেরো মিনিট ছেঁটে ফেলতে পারতেন ছবির শরীর থেকে, তাহলে ‘সিতারে জমিন পর’ আগের দুটো ছবির মতই ‘হিট’ হওয়ার গ্যারান্টি দেওয়া যেত।
Advertisement
স্পোর্টস ফিল্ম আমাদের সিনে ব্যবসায়ীদের কাছে তেমন প্রিয় কিংবা ওজনদার ‘মশালা’ নয়। অথচ খেলা নিয়ে তৈরি অধিকাংশ যা সিনেমাই জনপ্রিয় হয়েছে, সেই ‘মেরি কম’ থেকে ‘কাই পো চে’, ‘নান সিং তোমার’, ‘এম এস ধোনি’, ‘ইকবাল’, ‘ভাগ মিলখা ভাগ‘, ‘জো জিতা ওহি সিকান্দর’— অনেক নাম করা যায়। তবে আমির খানের এই ছবির বিশেষত্ব হল ‘অর্টিজম’-এ আক্রান্ত ছেলেমেয়েরা সংসারের বাইরে তো বটেই, এমনকি নিজের বাবা-মায়ের সংসারেও ‘বোঝা’ বলে পরিগণিত হয়। কিন্তু স্বাভাবিক বুদ্ধি-বৃত্তির পুনর্বিকাশ না ঘটলেও ওইসব ছেলেমেয়ের মধ্যে মানসিক বোধ ও অনুভূতির কোনও খামতি থাকে না। খামতি থাকে সেটি প্রকাশ করতে না পারার অক্ষমতায়। আর আমরা তাদের ক্রোমোজোমজনিত কারণে সেই জন্মগত ত্রুটিকে বিদ্রূপ করি, বুঝতেই চাই না।
Advertisement
আর এস প্রসন্নর এই ছবি সৎবির, লোটাস, গুড্ডু, সুনীল, গোসুদের সেই অব্যক্ত যন্ত্রণাকে এক ভাষা দিয়েছে। গল্পটি সাজিয়েছেন পারিপার্শ্বিক কিছু সাধারণ নর্মাল মানুষের মধ্যেও অ্যাবনর্মাল কিছু কাজের ঘটনা দিয়ে ছবির প্রধান চরিত্র গুলশন একবার লিফটে যাওয়ার দর্ঘটনার জন্য আর কোনও দিনই লিফটে না উঠে সিঁড়ি ভেঙে বহুতল হোটেলেও ওঠে। বয়স্কা মা ওই বয়সেও একজন মনের সঙ্গী পান, যেটা স্বাভাবিক ধারণায় অ্যাবনর্মাল বলেও জীবনের ‘অদৃশ্য’ ঘটনায় নর্মাল বই কি! কিংবা স্ত্রীর সঙ্গে গুলশানের আলাদা থাকার কারণটাও গুলশানের কাছে নর্মাল হলেও সুনীতার কাছে অ্যাবনর্মাল। সেজন্যই তো সর্বোদয় মিশনের সিংজী বলেন, সবকা আপনা আপনা ‘নর্মাল হোতা হ্যায়!’ আর্টিজমে আক্রান্ত ছবির প্রতিটি চরিত্রই তার নিজের মতো নর্মাল। তাদের নর্মালসিকে আমাদের ছবিতে দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়। দেখতে হবে তাঁদের দৃষ্টিতেই।
বেহিসেবি গাড়ি চালানোর শাস্তি হিসেবে গুলশন (আমির) তিন মাসের কমিউনিটি সার্ভিস দিতে কাজ পায় আর্টিস্টিক ছেলেদের নিয়ে একটি বাস্কেটবল খেলার দল তৈরির। পরিচালক প্রসন্ন হাসি-মজায় নবাগত কোচ গুলশনের সঙ্গে ছেলেগুলোর ধীরে ধীরে সখ্যতা তৈরি এবং একটি সফল দল তৈরির কাহিনীই দেখিয়েছেন। ‘তারে জমিন পর’ ছবিতে শিক্ষক ও ছাত্র দু’জনের মধ্যে যে মধুর সম্পর্কের রসায়ন তৈরি হয়েছিল, নান্দনিকতার মাপকাঠিতে, এই ছবিতে তেমনটি ঘটেনি, সম্ভবত এতগুলো চরিত্রের উপস্থিতিতে। উপরন্তু গুলশন-সুনীতা (জেনেলিয়া), মা ও তাদের কাজের মানুষের সম্পর্ক গড়ে ওঠা, ওই সর্বোদয় সেন্টারের সিংজী এতগুলো চর্তিরকে সামাল দিতে গিয়ে চিত্রনাট একাধিকবার দিগভ্রষ্ট হয়েছে। অর্থাভাবে ফাইনাল খেলতে যাওয়ার অর্থ জোগাড় করতে যে মিষ্টি মার্কা অসৎ উপায়নি নিল, সেটাও কি এই ছবির ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য? সেই অপরাধের কোনও ফলোআপ নেই।
তবে ‘যো জিতা ওহি সিকান্দর’ প্রবাদ বাক্যটি এই ছবির ক্ষেত্রে না মেনে চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক ‘বাস্তব’কেই গুরুত্ব দেওয়ায় ছবিটি এক অন্যতর মাত্রা পেয়ে যায়। ফাইনাল খেলার পর পরাজিত এবং বিজিত দল প্রিয় বন্ধুর মতো আনন্দে মেতে ওঠে। আর বিদায়ক্ষণে আবার আমির খান দেখিয়ে দেন তাঁর অস্তিনে লুকিয়ে রাখা আবেগপূর্ণ মুহূর্তের অভিনয়। আরও মজার ব্যাপার শংকর এহসান লয়ের সুরে পুরনো সুপারহিট গান ‘পাপা কহতে হ্যায়…’কে একটু বদলে ‘পাপা বকতে থে অ্যায়সা কাম করেগা, বড়া হোকে ধুমকো তু বদনাম করে গা’ বা ‘দিল্লি বেলি’ ছবির ‘ভাগ ডি কে কোন’-এর ব্যবহার বেশ মজাদার।
আমির তাঁর অধিকাংশ ছবিতেই বিনোদনের সঙ্গে ব্লেন্ড করে দেন একটি সামাজিক বার্তা। এখানেও করেছেন। এবার সেই কাজটি করতে গিয়ে একদম ‘ডিফারেন্টলি অ্যাবেলড আর্টিস্টিক শিল্পীকে দর্শকের কাছে উপহার দিলেন। যেমন দীপক রানা, আরুষ দত্ত, সোপীয় ভার্মা, বেদান্ত শর্মা, নমন মিশ্র। এবং জেনেলিয়া দেশমুখ, ব্রিজেন্দ্র কালা, জিনত, ডলি অলুওয়ালিয়ারাতে আছেনই! তবে সবার ওপরে থেকেই যাচ্ছেন আমির খান নিজে ষাট ছুঁয়ে ফেলা এই অভিনেতা আবারও প্রমাণ করে দিলেন বয়স একটি সংখ্যা মাত্র। আবেগপূর্ণ মুহূর্তে তখনও তিনি যেমন নীরবতা ব্যবহার করেন—আবার আনন্দঘন দৃশ্যে তেমন সজীব। ওঁর আগের ছবিগুলোর মতই আমির খান-ই তুরুপের তাস।
Advertisement



