• facebook
  • twitter
Wednesday, 17 December, 2025

যক্ষ্মা কী? কেন একে ‘রাজরোগ’ বলা হয়?

এটা আশার কারণ, ফুসফুসের যক্ষ্মা নির্ণয় অনেক বেশি হচ্ছে। প্রতিরোধী যক্ষ্মা বার বার নিজেদের পরিবর্তন ঘটিয়ে ভয়ঙ্কর অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

যক্ষ্মা বা টিউবারক্যুলোসিসকে ‘রাজরোগ’ বলা হয়। মূলত এটি একটি ক্রনিক রোগ। কিন্তু একে ‘রাজরোগ’ নামকরণের পিছনে কোনও রাজার সম্পর্ক নেই। আসলে এটি রোগের রাজা। সেজন্যই এই নামকরণ করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আবার এই রোগের চিকিৎসার ব্যয়ও যথেষ্ট রাজোচিত হয়ে যায় বলেও এর এরকম নামকরণ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আগে এই রোগের চিকিৎসা বলতে শুধু পুষ্টিকর খাদ্য, নির্মল বাতাস ও পর্যাপ্ত সূর্যালোককে বোঝানো হতো। কিন্তু এই যক্ষ্মা বা টিউবারক্যুলোসিস আসলে কী?

চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী, যক্ষ্মা বা টিউবারক্যুলোসিস হল একটি ক্রনিক রোগ। একবার এই রোগটির আত্মপ্রকাশ ঘটলে, সারতে দীর্ঘসময় লেগে যায়। মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারক্যুলোসিস নামে একধরনের জীবাণু সংক্রমণের কারণে এই টিবি রোগটি হয়। যক্ষ্মা খুবই প্রাচীন অসুখ! প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো মিশরের মমিতেও এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গিয়েছে।

Advertisement

তবে কারও শরীরে যক্ষ্মার উপসর্গ দেখা দেওয়া মানে এই নয় যে মাত্র কয়েকদিন আগে যক্ষ্মার জীবাণু তার দেহে প্রবেশ করেছে। বিশেষত প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে দেখা যায় বহু আগেই হয়তো সংক্রমণ হয়েছিল। সেই সময় শরীরের রোগপ্রতিরোধক ব্যবস্থা জোরদার থাকায়, ব্যাকটেরিয়া বংশবৃদ্ধির সুযোগ পায়নি। এখন ওই ব্যক্তির কোনওভাবে সঠিক পুষ্টির অভাব হলে বা এইডস-এ আক্রান্ত হলে অথবা কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেই সুযোগে যক্ষ্মার ব্যাকটেরিয়া মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ। এই ধরনের যক্ষ্মাকে বলে সেকেন্ডারি টিউবারক্যুলোসিস। তবে বাচ্চাদের যেহেতু রোগপ্রতিরোধক ক্ষমতা কম থাকে, তাই তাদের ক্ষেত্রে প্রাইমারি বা প্রথমবারের সংক্রমণজনিত উপসর্গই বেশি হতে দেখা যায়।

Advertisement

শরীরের কোথায় এই ব্যাকটেরিয়া বাসা বাঁধে?
ফুসফুস, লিম্ফনোড, গ্যাস্ট্রোইনটেসটিনাল ট্র্যাক্ট থেকে শুরু করে ত্বক, স্নায়ুকোষ, ব্রেন— শরীরের যে কোনও অঙ্গকে এই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে। অবশ্য ফুসফুস ও লিম্ফ নোড, জিআই ট্র্যাক্ট-এ সংক্রমণ বেশি হতে দেখা যায়।

এই রোগে কাদের বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়?
বাচ্চা থেকে বুড়ো, মহিলা থেকে পুরুষ— যে কেউ টিবির শিকার হতে পারেন। এই প্রসঙ্গেই জানিয়ে রাখি, টিবির সংক্রমণ দু’ধরনের হয়। সেকেন্ডারি এবং প্রাইমারি ইনফেকশন।

প্রসঙ্গত টিউবারক্যুলোসিস নামটি বিজ্ঞানের দেওয়া। শরীরে অসংখ্য যে ক্ষত তৈরি হয়, তাদের আকার থেকে। সভ্যতার প্রাচীন লগ্ন থেকে এই রোগ মানুষের শত্রু— রামায়ণের কুব্জা থেকে মিশরের মমিতে তার চিহ্ন রেখে গেছে। সঠিক অর্থে ওষুধ আবিষ্কার হল ১৯৪৪ সাল থেকে। পরে আরও শক্তিশালী ওষুধ এল। কিন্তু অসাধারণ বিবর্তনশীল এই জীবাণু মানুষের অবহেলার সুযোগ নিয়ে ওষুধের বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ গড়ে তুলল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি ক্যান্সারের থেকেও মারাত্মক।

এই জীবাণুটির গায়ে একটা বর্ম থাকে। সেটি ভেদ করে ওষুধ সহজে ভেতরে ঢুকতে পারে না। সেজন্য নিজের ভোল বদল করে পুনরায় এই জীবাণু মানব শরীরে সংক্রমণ শুরু করে। শরীরে যখন আক্রমণ শানায় তখন পরিস্থিতি বুঝে বছরের পর বছর মৃতের ভান করে দেহের ভিতরে সুপ্ত অবস্থায় লুকিয়ে থাকে। বয়স বৃদ্ধি বা স্বাস্থ্যের অসচেতনতার কারণে শরীরের রাশ আলগা হলেই আবার নিজের মূর্তি ধারণ করে রোগীকে শেষ করে দেয়।

এই রোগ প্রতিরোধে বিজ্ঞানীরা উপায় বার করলেন— অনেকগুলো ওষুধ একসঙ্গে অনেকদিন ধরে খেলে সব জীবাণুকে মারা সম্ভব। কিন্তু নিয়ম মেনে অনেকদিন ওষুধ খাওয়া মানুষের ধাতে নেই। সেই অনিয়মের ফাঁকেই তৈরি হয় প্রতিরোধী যক্ষ্মা।

রোগটি মূলত কাশি-হাঁচি থেকে ছড়িয়ে পড়ে। সেজন্য ফুসফুসের যক্ষ্মা সমাজের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক। কারণ ফুসফুসই এই জীবাণুর সবচেয়ে অনুকূল বিচরণক্ষেত্র। মানব শরীরের এমন কোনও অঙ্গ নেই, যেখানে যক্ষ্মা হয় না। কিন্তু কিডনির বা ব্রেনের অসুখ শুধু এই রোগীর পক্ষে ক্ষতিকর। ফুসফুসের অসুখের একজন রোগী বছরে দশ থেকে পনেরোজন সুস্থ মানুষের শ্বাসনালীতে হাওয়ায় ভাসমান কণার মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

বোঝা গেল সকলের মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই জীবাণুকে পর্যুদস্ত করা যাবে না। সরকারি ও বেসরকারি যুগ্ম উদ্যোগ চাই। পৃথিবী এখন একটি বড় যৌথ পরিবার। এই জীবাণু দেশের সীমানা মানে না, ধনী-দরিদ্রে প্রভেদ করে না। এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাই সকলকেই অংশীদার হতে হবে। একে বলা হয় পাবলিক প্রাইভেট মিক্স।

হাঁচি-কাশির সময় রুমালে মুখ চাপা দিলে সংক্রমণ অনেকটা আটকানো সম্ভব হয়। ওষুধ শুরু করলে কখনওই মাঝপথে অনিয়মিত হওয়া বা বন্ধ করা যায় না। রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা— পুরোটাই সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে হয়। সচেতনতার আরও প্রসার চাই।

এটা আশার কারণ, ফুসফুসের যক্ষ্মা নির্ণয় অনেক বেশি হচ্ছে। প্রতিরোধী যক্ষ্মা বার বার নিজেদের পরিবর্তন ঘটিয়ে ভয়ঙ্কর অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। সেজন্য শুধু নতুন ওষুধ আবিষ্কারই যথেষ্ট নয়। এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। তার সঠিক সামাজিক ব্যবহারও জরুরি। সদ্য স্বাধীন দেশ অশক্ত কাঁধে ন্যাশনাল টিউবারক্যুলোসিস প্রোগ্রাম (১৯৬২) শুরু করেছিল। তার ভুল-ত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে নব্বইয়ে পাল্টে হল রিভাইসড ন্যাশনাল টিউবারক্যুলোসিস কন্ট্রোল প্রোগ্রাম (১৯৯৩)। এবারে দেশ যক্ষ্মা নির্মূলের দিকে আরও এক পা বাড়িয়েছে। লড়াই চলছে। সেই লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে।

Advertisement