শুধু পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরই নয়, কোন পড়ুয়া অঙ্কে কাঁচা? কে লাজুক? কেই বা চঞ্চল? আবার কে কোন বিষয়ে তুখোড়। এবার থেকে তা সবটাই জানা যাবে হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ডে। কোনও পড়ুয়ার রিপোর্ট কার্ডটি হাতে নিলেই, এক লহমায় বুঝে নেওয়া যাবে সেই পড়ুয়ার মনস্তত্ত্ব। জানা যাবে সার্বিকভাবে ওই পড়ুয়ার বিকাশ কতটা হয়েছে। কারণ, পড়ুয়াদের সার্বিক উন্নতি কেমন হচ্ছে, তা জানার জন্য পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ৩২ পাতার হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ড তৈরি করেছে রাজ্য সরকার। যা ২০২৫-এর শিক্ষাবর্ষ থেকে শুরু করা হবে বলেই সূত্রের খবর।
এবার এই হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ড তৈরি করার ব্যাপারে তোড়জোড় শুরু করেছে রাজ্য। ইতিমধ্যেই এই নিয়ে সমস্ত জেলার স্কুল পরিদর্শকদের সঙ্গে আলোচনাও সেরেছেন স্কুল শিক্ষা অধিদফতরের আধিকারিকরা। সূত্রের খবর, কীভাবে এই পরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে প্রণয়ন করা যায়, সেই নিয়েই মূলত আলোচনা করা হয়েছে।
যদিও গত বছর থেকেই এই নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিল রাজ্য সরকার। এমনকী, স্কুলে-স্কুলে এই হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ড বণ্টনও করে দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য তখন শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি সময় হওয়ায়, তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। তবে সেটা আগামী ২৫-এর শিক্ষাবর্ষ থেকে শুরু হতে চলেছে।
Advertisement
উল্লেখ্য, পঞ্চম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এই হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ড তৈরি করা হয়েছে। যা অবিকল স্কুলের ডায়েরির মতো দেখতে। স্কুলের প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের শুধুমাত্র অ্যাকাডেমিকই নয়, তাঁদের বৌদ্ধিক বিকাশ কতটা হচ্ছে, সেটার প্রতিফলনও থাকবে এই রিপোর্ট কার্ডে। কারণ, শিক্ষা দফতর মনে করছে, একজন পড়ুয়া শুধুমাত্র পড়াশোনায় ভালো হবে এমনটা নয়। তার আচরণও যাতে ঠিকঠাক থাকে, সেটা দেখাটাও শিক্ষকদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ছে। সেক্ষেত্রে কোনও ছাত্র বা ছাত্রী তার সার্বিক বিকাশ কেমন হচ্ছে, সেটা নিয়েই এই হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ড তৈরি করতে হবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের।
Advertisement
এই রিপোর্ট কার্ড এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে পড়ুয়াদের আচার-আচরণ নির্দিষ্ট কলামে উল্লেখ করা যায়। তাতে পড়ুয়াদের মনস্তত্ত্বের সমস্ত দিক ফুটে উঠবে এই রিপোর্ট কার্ডে। যেমন কোনও ছাত্র বা ছাত্রী হয়তো অঙ্কে ভয় পায় কিন্তু ইংরেজি তার খুব পছন্দের বিষয়। আবার কেউ হয়তো একটু একলা থাকতে পছন্দ করে। কারোর হয়তো কিছু খারাপ আচরণ রয়েছে বা কোথাও হয়তো সে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। এসবই বোঝা যাবে হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ডে। সেই মতো তাদের অভিভাবকরাও জানতে পারবেন যে, তাদের সন্তানদের কতটা মানসিক বিকাশ হচ্ছে। সেই মতো সকলে মিলে পদক্ষেপ নিতে পারবেন।
অন্য দিকে, একাংশ শিক্ষকদের তরফে এই হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ড তৈরি করা এবং সংরক্ষণের ক্ষেত্রে স্কুলের পরিকাঠামোর উপর জোর দিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, এই হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ড তৈরি করার জন্য স্কুলে পর্যাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীর অভাব রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চে সাধারণ সম্পাদক কিংকর অধিকারী বলেন, ‘হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ড যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, তাতে একটি ছাত্রের শুধু শিক্ষাগত দিক নয়, সার্বিক দিকগুলি উঠে আসবে। ছাত্র-ছাত্রীদের সার্বিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত উপযোগী। শিক্ষাদানের কাজ ছাড়াও ছাত্র-ছাত্রীদের এই সার্বিক দিক তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হবে শিক্ষকদের। কিন্তু তার জন্য সবচেয়ে আগে যেটা প্রয়োজন, সেটা হল স্কুলগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী এবং উপযুক্ত পরিকাঠামো। তার জন্য স্কুলগুলিতে শিক্ষা বহির্ভূত অন্যান্য হাজার কাজ থেকে শিক্ষকদের সম্পূর্ণ অব্যাহতি দিতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষক ও গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি কর্মী নিয়োগ করতে হবে। তা না-হলে, হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ডের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। এই দিকগুলি শিক্ষা দফতর এবং রাজ্য সরকারকে ভেবে দেখতে হবে।’
আবার অনেক শিক্ষকরাই চাইছেন যে, হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ড বাংলা শিক্ষা পোর্টালে আনা হোক। কারণ তাঁরা মনে করছেন, যেহেতু এটা পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত একসঙ্গে রয়েছে, সেকারণে রিপোর্ট কার্ডগুলো স্কুলেই সংরক্ষণ করতে হবে। এমনকী, বছর-বছর সেই সংখ্যা বাড়বে। সেক্ষেত্রে বহু স্কুলে জায়গার অপ্রতুলতার কারণে সংরক্ষণের সমস্যা রয়েছে। যদি এই হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ড অনলাইনে করে দেওয়া হয় তাহলে, হার্ড কপিগুলো সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়বে না। প্রয়োজনে শিক্ষকরা যে কোনও পড়ুয়ার যে কোনও বছরের রিপোর্ট অনলাইনেই দেখতে পারবেন।
এই হলিস্টিক রিপোর্ট কার্ডে পড়ুয়াদের প্রাপ্ত নম্বরের পাশাপাশি তাঁদের আচার-আচরণ ছাড়াও বৌদ্ধিক দিকও তুলে ধরার জায়গা করা হয়েছে। প্রথমত এখানে দেখা হবে পড়ুয়ারা কতটা আত্ম সচেতন। একত্রে তারা কীভাবে চিন্তাভাবনা করছে। তারা কতটাই বা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছে। তাঁদের শিক্ষণের দক্ষতা কতটা। এমনকী, কতটা গভীরভাবে তারা চিন্তা ভাবনা করতে পারছে। এবং সেই চিন্তা ধারা কতটা বিশ্লেষণমূলক। তাঁরা সমস্যার সমাধান করতে পারছে কি না। তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে কি না। কতটা সৃজনশীল উপস্থাপন করতে পারছে তাঁরা। তাঁদের নান্দনিক বোধ কতটা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এছাড়াও শ্রবণ ক্ষমতা, সংযোগের দক্ষতা, সহানুভূতির দক্ষতা, সহযোগিতার দক্ষতা, কথোপকথন, বন্ধুত্ব স্থাপনের দক্ষতা, দ্বন্দ্ব নিরসনের ক্ষমতা, মানসিক চাপ মোকাবিলা, পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষার দক্ষতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের দক্ষতা, মত প্রকাশের দক্ষতা, ইতিবাচক মনোভাব এবং সর্বশেষে নেতৃত্বদানের দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে কি না, তাছাড়া এই সমস্ত দিকে পড়ুয়াদের কতটা বিকাশ ঘটল, তার উল্লেখও থাকবে এই রিপোর্ট কার্ডে।
Advertisement



