• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

বাঙ্গালীর সংস্কৃতি

এই প্রকারের বিভিন্ন বস্তু ও বিষয় অবলম্বন করিয়া, ইংরেজদের আগমন পর্য্যন্ত বাঙ্গালার নিজস্ব সংস্কৃতি গড়িয়া উঠিয়াছিল। অধুনা ইহার কতকগুলি বিষয় একেবারে লোপ পাইয়াছে, কতকগুলি লোপ পাইতে বসিয়াছে এবং কতকগুলির আমরা পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় আছি।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। ফাইল ছবি।

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মেয়েদের আলিপনা-আঁকা, কাঁথা-সেলাই ও অন্যান্য গৃহ-শিল্প।
বাঙ্গালার লাঠিখেলা ও ক্রীড়া-কসরৎ, রায়বেঁশে’ নাচ; পূজার সময় ঢাকি-ঢুলিদের নাচ; পূর্ব-বঙ্গের আরতি-নৃত্য; মেয়েদের ব্রত-নৃত্য; অন্য নানা প্রকারের নৃত্য।
বাঙ্গালার মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত ঈদের উৎসব, মহরমের ও শাহ-মাদারের অনুষ্ঠান; নানাবিধ নৃত্য ও কসরৎ।
(৩) বাঙ্গালার মানসিক ও আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি—
টোল-চতুস্পাঠী; বাঙ্গালার সংস্কৃত বিদ্যা— জয়দেব হইতে আরম্ভ করিয়া বাঙ্গালার সংস্কৃত কবি, দার্শনিক ও পণ্ডিতের কীর্তি; বৃন্দাবনের গোস্বামিগণ; নবদ্বীপ, ভাটপাড়া, বিক্রমপুর, কোটালিপাড়া, ত্রিপুরা, চট্টল, বিষ্ণুপুর প্রভৃতি বিভিন্ন কেন্দ্রের সংস্কৃত পণ্ডিতদের পরম্পরা; নৈয়ায়িক ও স্মার্তগণ; আগমবাগীশ কৃষ্ণানন্দ প্রমুখ তান্ত্রিক আচার্য্যগণ; মধুসূদন সরস্বতী প্রমুখ বৈদান্তিকগণ; বাঙ্গালার আধ্যাত্মিক পদ; বৌদ্ধ চর্য্যাপদ; বড়ুচণ্ডীদাস, শ্রীচৈতন্যদেবের ব্যক্তিত্ব; কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্য-চরিতামৃত’; ব্রজবূলী ভাষায় সৃষ্টি ও ব্রজবুলি সাহিত্য; বৈষ্ণব পদকর্তৃগণ; শাক্ত পদ— রামপ্রসাদ; রামায়ণ মহাভারতের বাঙ্গালা রূপ; বাঙ্গালা দেশে রাধাকৃষ্ণ-কাহিনীর বিশিষ্ট অভিব্যক্তি; শাক্ত, শৈব ও বৌদ্ধ মঙ্গল-কাব্যের উপাখ্যান— বেহুলা-রশিন্দরের কথা, কালকেতু-ফুল্লরা ও ধনপতি-খুল্লনার কথা; লাউসেন-কথা (অধুনা কম প্রচারিত); পশ্চিমবঙ্গের ধর্মপূজা; বাঙ্গালার কথকতা; কীর্তনগান—কীর্তনের অভিব্যক্তি-গড়েরহাটি বা গরানহাটি, মনোহরশাহী, রানীহাটি, প্রভৃতি বিভিন্ন রীতির কীর্তন; বাউল ও ভাটিয়াল গান; বাঙ্গালার শ্লোক-পড়ার সুর; কবি, ঝুমুর, তরজা ও অন্য গ্রাম্য গীত; পাঁচালি; বাঙ্গালার ‘যাত্রা’; জারি গান; মুসলমান মারফতি গান, মর্সিয়া গান; বাঙ্গলার হিন্দু ও মুসলমান পুঁথিপাড়ার সুর; বাঙ্গালার পয়ার; পশ্চিমাঞ্চলের হিন্দীগানের বাঙ্গালায় প্রচার—বাঙ্গালার ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরি, ঢপ, খেমটা।
বাঙ্গালার সাহিত্যে—‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, চৈতন্য ও বৈষ্ণবগুরুগণের চরিত্রবিষয়ক পুস্তক, পদাবলী-সাহিত্য, প্রাচীন বাঙ্গালার কাব্যবলী (মঙ্গলকাব্য ইত্যাদি); ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ; বাঙ্গালা-সাহিত্যের বিশিষ্ট বস্তু—গীতিকবিতা।
এই প্রকারের বিভিন্ন বস্তু ও বিষয় অবলম্বন করিয়া, ইংরেজদের আগমন পর্য্যন্ত বাঙ্গালার নিজস্ব সংস্কৃতি গড়িয়া উঠিয়াছিল। অধুনা ইহার কতকগুলি বিষয় একেবারে লোপ পাইয়াছে, কতকগুলি লোপ পাইতে বসিয়াছে এবং কতকগুলির আমরা পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় আছি। ইংরেজ-আমলে বাঙ্গালা কতকগুলি নূতন জিনিসে, তথা এই প্রাচীন জিনিসগুলির অনেকগুলিতে, সমগ্র ভারতের দ্বারায় স্বীকৃত বিশেষ কৃতিত্ব প্রকাশ করিতে সমর্থ হইয়াছে। আধুনিক কালের বাঙ্গালী সংস্কৃতির পরিচয়-স্বরূপ বিভিন্ন বিষয় ও বস্তুর মধ্যে উল্লেখ করা যায়—
(১) বাঙ্গালার ব্রাহ্ম ধর্ম— রামমোহন, দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, কেশবচন্দ্র, শিবনাথ শাত্রী।
(২) বাঙ্গালায় হিন্দুধর্মের নবীন জাগৃতি— রামকৃষ্ণ পরমহংস, বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, ভূদেব, বিজয়কৃষ্ণ, হীরেন্দ্রনাথ। ধর্মকে অবলম্বন করিয়া জনসেবা— ব্রাহ্ম সমাজ, রামকৃষ্ণ মিশন, হিন্দু মিশন।
(৩) আধুনিক বাঙ্গালার সংস্কৃত-চর্চা— রাধাকান্ত দেব, তারানাথ তর্কবাচস্পতি, কালীপ্রসন্ন হিংস, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ, চন্দ্রকান্ত তর্কালংকার, রাখালদাস ন্যায়রত্ন, কামাখ্যানাথ তর্কবাগীশ, শিবচন্দ্র সার্বভৌম, অজিতনাথ ন্যায়রত্ন, পঞ্চানন তর্কতর্ন, দুর্গাচরণ সংখ্যাবেদান্ততীর্থ, ফণিভূষণ তর্কবাগীশ, প্রমথনাথ তর্কভূষণ, বিধুশেখর শাস্ত্রী প্রমুখ পণ্ডিতগণ।
(ক্রমশ)

Advertisement

Advertisement

Advertisement