• facebook
  • twitter
Saturday, 6 December, 2025

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

আমার আশা নাই যে, আপনি আর আমাকে আপনার নিকট রাখিবেন।’ আমি হাসিয়া বলিলাম, ‘তোমার ভয় নাই, আমি তোমাকে ক্ষমা করিলাম তুমি যেমন আমার কাছে ছিলে, তেমনি আমার কাছে থাক।’

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতের পর

উপর হইতে অগ্নিবাণের ন্যায় নক্ষত্র বেগে শত সহস্র বিস্ফুলিঙ্গ পতিত হইয়া নদীতীর পর্য্যন্ত নিম্নস্থ বৃক্ষ সকলকে আক্রমণ করিল। ক্রমে একে একে সমুদায় বৃক্ষ স্বীয় রূপ পরিত্যাগ করিয়া অগ্নিরূপ ধারণ করিল, এবং অন্ধ তিমির সে স্থান হইতে বহু দূরে প্রস্থান করিল। অগ্নির এই অপরূপ রূপ দেখিতে দেখিতে, যে দেবতা অগ্নিতে তাঁহার মহিমা অনুভব করিতে লাগিলাম। আমি পূর্ব্বে এখানকার অনেক বনে দাবানলের চিহ্ন দগ্ধ বৃক্ষসকল দেখিয়াছি, এবং রাত্রিতে দূরস্থ পর্ব্বতের প্রজ্বলিত অগ্নির শোভাও দর্শন করিয়াছি; কিন্তু এখানে দাবানলের উৎপাত্ত, ব্যাপ্তি উন্নতি, নিবৃত্তি প্রত্যক্ষ করিয়া আমার বড়ই আহ্বাদ হইল। সমস্ত রাত্রি এই দাবানল জ্বলিয়াছিল। রাত্রিতে যখনই আমার নিদ্রাভঙ্গ হইয়াছে, তখনি তাহার আলোক দেখিয়াছি। প্রাতঃকালে উঠিয়া দেখি যে, অনেক দগ্ধ দারু হইতে ধূম নিগ4ত হইতেছে, এবং উৎসব-রজনীর প্রভাতকালের অবশিষ্ট দীপালোকের ন্যায়, মধ্যে মধ্যে সর্ব্বভুক্ লোলুপ অগ্নিও ম্লান ও অবসন্ন হইয়া জ্বলিত রহিয়াছে।

Advertisement

আমি সেই নদীতে যাইয়া স্নান করিলাম। ঘটি করিয়া তাহা হইতে জল তুলিয়া মস্তকে দিলাম। সে জল এমনি হিম যে, বোধ হইল যেন মস্তকের মস্তিষ্ক জমিয়া গেল। স্নান ও উপাসনার পর কিঞ্চিৎ দুগ্ধ পান করিয়া এখান হইতে প্রস্থান করিলাম। প্রাতঃকাল অবধি আবার এখান হইতে ক্রমিক আরোহণ করিয়া দু’প্রহরের সময় ‘দারুণ ঘাট’ নামক দারুণ উচ্চ পর্ব্বতের শিখরে উপস্থিত হইয়া দেখি যে, সম্মুখে আর এক নিদারুণ উচ্চ পর্ব্বতশৃঙ্গ তুষারাবৃত হইয়া উদ্যত বজ্রের ন্যায় মহদ্ভয় ঈশ্বরের মহিমা উন্নত মুখে ঘোষণা করিতেছে। আমি আথাঢ় মাসের প্রথম দিবসে দারুণ ঘাটে উপস্থিত হইয়া সম্মুখস্থিত তুষারাবৃত পর্ব্বত শৃঙ্গের আশ্লিষ্ট মেঘাবলী হইতে তুষার বর্ষণ দর্শন করিলাম। আথাঢ় মাসে তুষার বর্ষণ সিমলাবাসিদিগের পক্ষেও আশ্চর্য্য, যেহেতু চৈত্র মাস শেষ না হইতে হইতেই সিমলা পর্ব্বত তুষারজীর্ণ বসন পরিত্যাগ করিয়া বৈশাখ মাসে মনোহর বসন্তবেশ ধারণ করে।

Advertisement

২রা আষাঢ়ে এই পর্ব্বত হইতে অবরোহণ করিয়া সিরাহন নামক পর্ব্বতে উপস্থিত হই। সেখানে রামপুরের রাণার একটি অট্টালিকা আছে, গ্রীষ্মকালে রামপুরে অধিক উত্তাপ হইলে কখনো কখনো শীতল বায়ু সেবনার্থে রাজা এখানে আসিয়া থাকেন। গ্রীষ্মকালে পর্ব্বত তলে আমাদিগের দেশ অপেক্ষাও অধিক উত্তাপ হয়; পর্ব্বত চূড়াতেই বারো মাস শীতল বায়ু বহিতে থাকে। ৪ঠা আষাঢ় এখান হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া ১৩ই আষাঢ়ে ঈশ্বর প্রাসাদাৎ নির্ব্বিঘ্নে আমার সিমলায় প্রবাস-ঘরের রুদ্ধ দ্বারে আসিয়া ঘা মারিলাম।

কিশোরী দরজা খুলিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল। আমি বলিল, ‘তোমার মুখ যে একেবারে কালি হইয়া গিয়াছে।’ সে বলিল, ‘আমি এখানে ছিলাম না। যখন আপনার আজ্ঞা অবহেলা করিলাম, এবং আপনার সঙ্গে যাইতে পারিলাম না, তখন আমি অনুশোচনা ও অনুতাপে একেবারে ব্যাকুল হইয়া পড়িলাম। আমি আর এখানে তিষ্ঠিয়া থাকিতে পারিলাম না আমি পর্ব্বত হইতে নামিয়া জ্বালামুখী চলিয়া গেলাম। জ্বালামুখীর অগ্নির তাপে, জ্যেষ্ঠ মাসের রৌদ্রের তাপে, আমার শরীর দগ্ধ হইয়া গেল। আমি তাই কালামুখ লইয়া এখানে ফিরিয়া আসিয়াছি। আমার যেমন কর্ম্ম তেমনি ফল হইয়াছে। আমি আপনার নিকট বড় অপরাধী ও দোষী হইয়াছি। আমার আশা নাই যে, আপনি আর আমাকে আপনার নিকট রাখিবেন।’ আমি হাসিয়া বলিলাম, ‘তোমার ভয় নাই, আমি তোমাকে ক্ষমা করিলাম তুমি যেমন আমার কাছে ছিলে, তেমনি আমার কাছে থাক।’ সে বলিল, ‘আমি নীচে যাইবার সময় একটা চাকর বাসায় রাখিয়া গিয়াছিলাম। আসিয়া দেখি যে, সে চাকর পলাইয়া গিয়াছে, দরজা সব বন্ধ। আমি দরজা খুলিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখি, আমাদের কাপড় ও বাক্স পেটরা সকলই আছে, কিছুই লইয়া যায় নাই। আমি তিনদিন মাত্র পূর্ব্বে এখানে আসিয়াছি।’ আমি তাহার এই কথা শুনিয়া চমকিয়া উঠিলাম। যদি আমি তিনদিন পূর্ব্বে এখানে আসিতাম, তবে বড্ডই বিভ্রাটে পড়িতে হইত!

এই বিংশতি দিবসের পর্ব্বতভ্রমণে ঈশ্বর আমার শরীরকে আধিভৌতিক কত বিপদ হইতে রক্ষা করিলেন, আমার মনকে ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা, বিবেক ও বৈরাগ্যের কত উচ্চ শিক্ষা দিলেন, তাঁহার সহবাসসুখে আমার আত্মাকে কত পবিত্র ও উন্নত করিলেন, ইহার জন্য কৃতজ্ঞতা আমার হৃদয়ে ধরিল না। আমি তাঁহাকে ভক্তিভরে প্রণাম করিয়া ঘরে গিয়া তাঁহার প্রেম গান করিতে লাগিলাম। (ক্রমশ)

Advertisement