• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

আন্দামানের স্থান-নামের উৎস বৈচিত্র্য এবং বিকৃতি

স্বাধীনোত্তর দেশভাগের বলি হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত বাঙালি উদ্বাস্তুরা আন্দামানে পুনর্বাসন পান ১৯৪৯-৫০ সালে। আন্দামানে পুনর্বাসন পেয়ে বাঙালি তার নিজস্ব সংস্কৃতির যে প্রথম শিকড়টি মাটির গভীরে প্রোথিত করতে পেরেছিল, সেটি হল— তার নিজস্ব জনপদগুলির নামকরণ।

বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। ৮৩২টি ছোট-বড় ভূমিখণ্ড ও পাথরখণ্ডর সমাহার এই দ্বীপাঞ্চলটি, যার ক্ষেত্রফল ৮,২৪৯ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে ভারতের এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের লোকসংখ্যা ৩,৮০,৫৮১ জন। লোকবসতির ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটার আনুমানিক ৪৬ জন। কেন্দ্রশাসিত এই দ্বীপপুঞ্জ দু’টি গ্রুপে বিভক্ত— (১) আন্দামান গ্রুপ এবং (২) নিকোবর গ্রুপ।

নিকোবর গ্রুপের প্রধান দ্বীপগুলিতে মূলত উপজাতিদের বসবাস, তাই আন্দামান ও নিকোবর প্রশাসনের এই ‘নিকোবর গ্রুপ’কে ‘উপজাতিপ্রধান অঞ্চল’ (ট্রাইবাল এরিয়া) বলে চিহ্নিত করেছে, যেখানে যেতে হলে ভারতীয় নাগরিকদেরও দরকার হয় জেলাশাসক কর্তৃক জারি করা ‘পারমিট’-এর। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ‘বাঙালি উপনিবেশ’ বলতে যা বোঝায়, তা এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটির ‘আন্দামান গ্রুপে’ই আছে। প্রায় চার লক্ষ লোকসংখ্যার খুব বেশি হলে, শতকরা ২০-২১ জনই বাঙালি; তবে তা এখানে বসবাসকারী অন্যান্য ভাষাভাষীদের তুলনায়, এখনও অধিকসংখ্যক।

Advertisement

আন্দামান গ্রুপের মুখ্য ভূখণ্ডগুলি হল— (১) উত্তর আন্দামান, (২) মধ্য আন্দামান, (৩) দক্ষিণ আন্দামান, (৪) শহিদ দ্বীপ, (৫) স্বরাজ দ্বীপ এবং (৬) লিটল আন্দামান। নিকোবর গ্রুপের মুখ্য দ্বীপগুলির নাম— (১) কার নিকোবর, (২) টেরেসা, (৩) চাওরা, (৪) কাচাল, (৫) নানকৌরি, (৬) পিলোমিলো, (৭) পিলোপাঞ্জা, (৮) পিলপিলো, (৯) গ্রেট নিকোবর ইত্যাদি। গ্রেট নিকোবরের ‘ইন্দিরা পয়েন্ট’ই সমগ্র ভারতের দক্ষিণতম বিন্দু বলে চিহ্নিত।

Advertisement

আমার এই প্রবন্ধে আলোচিত হবে আন্দামানের বিভিন্ন দ্বীপ, অঞ্চল ও জনপদ-নামের উৎস, বৈচিত্র্য এবং লোকমুখে তার কালক্রমিক বিকৃতি / অপভ্রংশায়ন। তবে, বলে রাখা ভালো, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সব জায়গার নাম যে এখানে আলোচিত হবে, তা কিন্তু নয়। এই দ্বীপাঞ্চলে এমন এমন দ্বীপ / ভূমিখণ্ড আছে, যেগুলির নাম— স্বীয় অজ্ঞতা স্বীকার করেই বলব, এই নিবন্ধকারের আজও অজানা। যে জায়গাগুলি মোটামুটিভাবে পরিচিত এবং যে স্থান-নামগুলির ‘প্রামাণ্য’ ও ‘সম্ভাব্য’ উৎস-সূত্র জানা যায় ও সঙ্গত কারণে ধারণা করা যায়, সেগুলির কথাই আলোচিত হবে এই প্রবন্ধ-পরিসরে।

‘আন্দামান’ এবং ‘নিকোবর’ নামের উৎপত্তি
শুরু করা যায় ‘আন্দামান’ ও ‘নিকোবর’ নাম দু’টি নিয়ে। আন্দামানের ব্রিটিশ প্রশাসক (১৮৯৪ থেকে ১৯০৩) কর্নেল স্যার রিচার্ড টেম্পল-এর ভাষ্য-অনুসারে, প্রথমদিকে মালয়রা এই দ্বীপে এসেছিল ক্রীতদাসের সন্ধান করতে। ‘আন্দামান’ নামের উৎপত্তি মালয় শব্দ ‘অন্ডুমান’ বা ‘হন্ডুমান’ থেকে। মালয়দের বিশ্বাস ছিল, এই দ্বীপের বাসিন্দাদের অবয়ব খানিকটা হনুমানের মতো, তাই তারা এই দ্বীপের নামকরণ করে ‘হন্ডুমান’। আবার রোমানড সাম্রাজ্যর ভূগোলশাস্ত্রী টলেমির উল্লেখে পাওয়া যায় ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ ‘আগমাটে’ / ‘আগিনে’ নামের কথা। পঞ্চদশ শতাব্দীর নিকোলাস কোঁতি ব্যাখ্যা দিয়েছেন— ‘আন্দামান’ শব্দটির অর্থ হল ‘স্বর্ণদ্বীপ’। সপ্তদশ শতাব্দীর পরিব্রাজক সিজার ফ্রেডারিক এই দ্বীপকে উল্লেখ করেছেন ‘আন্ডামাওন’ নামে। আর খুব শস্তা একটি ‘অপ্রমাণ রসিকতা / গুজব’ প্রচলিত আছে এই মর্মে যে, কোনও তামিল নাবিক জাহাজে করে যেতে যেতে এই দ্বীপের কোনও একটিতে হরিণের পাল দেখে সঙ্গীদের ডেকে বলেছিলেন— ‘আনদামান’, তামিল ভাষায় যার অর্থ— ‘ওইখানে হরিণ’। কিন্তু এসব উল্লেখকে হারিয়ে দিয়ে, মালয়দের দেওয়া নাম ‘অন্ডুমান’ থেকেই যে ‘আন্দামান’ নামটির উৎপত্তি, এই মিথটিই চূড়ান্তভাবে সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছে।

এবারে খোঁজা যাক ‘নিকোবর’ নামটির উৎপত্তিস্থল। টলেমি কিন্তু তাঁর উল্লেখে ‘আন্দামান’ থেকে ‘নিকোবর’-কে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। তাঁর উল্লেখে ‘নাগাদিপা’ এবং ‘বারুসেয়া’ মিলে পঞ্চদ্বীপের কথা আছে, যার খানিকটা ধ্বনিগত মিল ‘নিকোবর’ এবং ‘টেরেসা’ (নিকোবর গ্রুপের দু’টি প্রধান দ্বীপ)-র সঙ্গে খুঁজে পাওয়া যায়। টলেমির মতে এই দ্বীপের বাসিন্দারা লাঙ্গুলবিশিষ্ট। একাদশ শতাব্দীর তাঞ্জোর লিপিতে, চোলসম্রাট দ্বিতীয় রাজেন্দ্র-কর্তৃক ‘নাগাদিপা’ ও ‘কারদিপা’ বিজয়ের উল্লেখ আছে, যা সম্ভবত বর্তমানের ‘গ্রেট নিকোবর’ ও ‘কার নিকোবর’। বিখ্যাত ইতালিয়ান সওদাগর-পরিব্রাজক মার্কো পোলো এই দ্বীপের উল্লেখ করেছেন ‘নেকাবারাম’ নামে। আবার রশিদউদ্দীন নামেরএকজন আরব পরিব্রাজকের সূত্রানুসারে এই দ্বীপের নাম ‘নেকুবেরাম’। ফ্রায়ার ওডোরিক-এর মতে এটির নাম ‘নিকোবেরান’। তবে শেষমেশ থেকে যায় ওই ‘নিকোবর’ নামটি।

ব্রিটিশ সভ্যতার ঊষালগ্নে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ
কালক্রমে এই দ্বীপসমষ্টি বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হয় ‘আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ’ নামে। তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক লেনদেন (করমণ্ডল উপকূল থেকে বার্মা)-এর সুবিধার্থে ব্রিটিশ শাসকদলের কাছে বঙ্গোপসাগরীয় এই দ্বীপপুঞ্জের গুরুত্ব চূড়ান্তভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৭ সালে বঙ্গোপসাগর সংক্ষিপ্ত জরিপ করেন জন রিচি এবং তিনি ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে পরামর্শ দেন এই দ্বীপগুলির দিকে নজর দিতে ও বিস্তারিতভাবে জরিপ করতে। ১৭৮৩ সালে ক্যাপ্টেন টম্স ফরেস্ট আন্দামানী আদিবাসীদের খোঁজে এই দ্বীপপুঞ্জে আসার জন্য তৎকালীন ভারতীয় গভর্নর জেনারেল (১৭৭৪-৮৫) ওয়ারেন হেস্টিংসকে একটি জাহাজ দেওয়ার অনুরোধ জানান। ১৭৮৮ সালে ক্যাপ্টেন বুকানন গভর্নর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া (১৭৮৬-৯৩) লর্ড কর্নওয়ালিসকে এই দ্বীপপুঞ্জর একটি বিস্তৃত জরিপ করার অনুরোধ জানান।

অবশেষে, লর্ড কর্নওয়ালিস এই উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ ‘ইন্ডিয়ান নেভি’র লেফটেন্যান্ট আচির্বাল্ড ব্লেয়ারকে নিয়োগ করেন। তাঁকে দেওয়া হয় ‘এলিজাবেথ’ ও ‘ভাইপার’ নামের দু’টি জাহাজের ‘কমান্ড’। লর্ড কর্নওয়ালিস ব্লেয়ারকে তাঁর কর্মপন্থা ভালো করে বুঝিয়ে তো দেনই এবং সেই সঙ্গে এও স্মরণ করিয়ে দেন যে, তাঁর ভাই কমোডোর কর্নওয়ালিসের কথাও তাঁকে মেনে চলতে হবে এই অভিযান চলাকালীন। আর এই সঙ্গেই, ধারণা করা যায়, ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের নামকে যুক্ত করে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন স্থান-নামকরণ শুরু হয়।

আন্দামানের বিভিন্ন স্থান-নামের উৎস :
প্রামাণ ও সম্ভাব্য
‘এলিজাবেথ’ ও ‘ভাইপার’ নামের জাহাজ দু’টি কলকাতা থেকে রওনা হয় ১৭৮৮ সালের ২০ ডিসেম্বর এবং ওই মাসেরই ২৯ তারিখে আর্চিবাল্ড ব্লেয়ারের নেতৃত্বাধীন জরিপদল পৌঁছয় ইন্টারভিউ দ্বীপে। তারপর পোর্ট আন্দামান, পোর্ট ক্যাম্পবেল, রুটল্যান্ড ইত্যাদি জায়গা ঘোরার পর যে জায়গাটি আর্চিবাল্ড ব্লেয়ার-এর দৃষ্টিকে বেশি আকর্ষণ করে, সেটির নাম তিনি রাখেন ‘পোর্ট কর্নওয়ালিস’ (হয়তো তাঁর নিয়োগকর্তা ‘গভর্নর জেনারেল কর্নওয়ালিস’ ও গভর্নর জেনারেলের ভাই ‘কমোডোর কর্নওয়ালিস’— উভয়কে স্মরণ করে)। বর্তমানে যেটিকে ‘চাথাম’ দ্বীপ বলা হয়, সেটিই তৎকালীন ‘পোর্ট কর্ণওয়িালিস’। আন্দামানের ‘চাথাম’ নামক ব্রিটিশ-বাহিত হয়ে এসেছে ইংল্যান্ডের রাজধানী শহর লন্ডন এবং ক্যান্টারবেরি শহরের মধ্যবর্তী জনপদ ‘চাথাম’ নামের অনুকরণে।

১৭৮৯ সালে লেফটেন্যান্ট আর্চিবাল্ড ব্লেয়ার ও আলেকজান্ডার কিড-এর মাধ্যমে এবং কিছু কয়েদিদের শ্রম-সহযোগে পোর্ট-কর্নওয়ালিসেই জনপদ-স্থাপনের উদ্যোগ নেয় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান গভর্নর জেনারেল-ইন-কাউন্সিল। ১৭৯৪ সালে এখানে কিছু ইউরোপিয়ান কয়েদিকেও পাঠানো হয়, কিন্তু কিড তাতে তীব্র আপত্তি জানিয়ে সেই কয়েদিদের ফেরত পাঠান বোম্বাইয়ে। পরবর্তীকালে গভর্নর জেনারেল সিদ্ধান্ত নেন যে একমাত্র ভারতীয় কয়েদিদের ছাড়া কোনও ইউরোপিয়ান কয়েদিকে আন্দামানে পাঠানো হবে না। কালক্রমে এখানে বসবাসরত মানুষের মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক রূপে বেড়ে যাওয়ায় শেষমেশ ১৭৯৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারিতে কাউন্সিল আন্দামানের জনবসতি পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও, পুরোপুরিভাবে পাততাড়ি গুটিয়ে নিতে ইংরেজদের সময় লেগে যায় মে ১৭৯৬ পর্যন্ত। পরে, ১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহোত্তর সময়ে, কয়েদিদের ‘কালাপানি’ সাজা দেওয়ার উদ্দেশ্যে আবার এই দ্বীপপুঞ্জে ব্রিটিশদের আনাগোনা শুরু হয় এবং দ্বিতীয় দফার এই ব্রিটিশ আধিপত্য বজায়-বহাল থাকে ভারতের শাসনক্ষমতা হস্তান্তরকাল (১৯৪৭) পর্যন্ত।

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ’র বর্তমান যে রাজধানী শহর ‘পোর্ট ব্লেয়ার’, সে নামটিও অবধারিতভাবে এসেছে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ‘ইন্টেসিভ সার্ভেয়ার’ লেফটেন্যান্ট আর্চিবাল্ড ব্লেয়ারের স্মরণে। শহর পোর্টব্লেয়ার-এর কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক এলাকাটির নাম ‘অ্যাবার্ডীন বাজার’। এই ‘অ্যাবার্ডীন’ নামটিও কিন্তু সংযুক্ত রাজ্য (ইউনাইটেড কিংডম)- অন্তর্ভুক্ত স্কটল্যান্ড থেকে আমদানি-কৃত। একটি মজার তথ্য— আন্দামানে যখন প্রদেশ কাউন্সিল প্রথা চালু ছিল, তখন নিকোবরী উপজাতিদের একজন প্রতিনিধি-কাউন্সিলর ছিলেন— যাঁর নামটি ছিল ‘অ্যাবার্ডীন বাজার’ ও ‘পোর্ট ব্লেয়ার’-এর সংযুক্ত রূপে— অ্যাবার্ডীন ব্লেয়ার।

এবার আসা যাক আন্দামানে ব্রিটিশের বিখ্যাত প্রশাসনিক হেড কোয়ার্টার্স ‘রস দ্বীপ’ (এটির বর্তমান নাম— নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস দ্বীপ)-এ, যেটি এখন এই দ্বীপপুঞ্জের পর্যটনকেন্দ্রগুলির মধ্যে অন্যতম একটি। আজও এই দ্বীপে রয়ে গেছে কিছু ব্রিটিশ ধ্বংসাবশেষ— গির্জাঘর, টেনিস কোর্ট, ছাপাখানা, অফিসারদের প্রমোদকক্ষ, সমাধিস্থল ইতোদি। এই ‘রস দ্বীপ’-এর নামকরণ করা হয়েছে ব্রিটিশ মেরিন সার্ভেয়ার ‘স্যার ড্যানিয়েল রস’-এর নামে। আর রস দ্বীপ ও পোর্টব্লেয়ার শহরের মধ্যবর্তী যে সি-প্যাসেজটি রয়েছে, তার নাম ‘সিসোস্ট্রিস বে’. ‘সিসোস্ট্রিস’ ব্রিটিশের একটি জাহাজের নাম, যেটি এই অঞ্চলে এসেছিল তার পূর্ববর্তী অন্তর্হিত জাহাজ ‘লেডি ন্যুজেন্ট’-এর খোঁজে।

আন্দমানের ব্রিটিশ প্রশাসকদের নামে বেশ কিছু জনপদের নাম
১৭৮৯ সাল থেকে ১৭৯৬ সাল— এই প্রথম পর্বে আন্দামানের ব্রিটিশ শাসনকর্তা ছিলেন আর্চিবাল্ড ব্লেয়ার (সেপ্টেম্বর ১৭৮৯ থেকে মার্চ ১৭৯৩) এবং আলেকজান্ডার কিড (মার্চ ১৭৯৩ থেকে মে ১৭৯৬)। দ্বিতীয় পর্বর ব্রিটিশ শাসন শুরু হয় ‘সুপারিন্টেডেন্ট অফ পোর্টব্লেয়ার’ পদটি দিয়ে— যাতে প্রথম নিযুক্তি পান ক্যাপ্টেন হেনরি স্টুয়ার্ট মান। সম্ভবত, এই ‘মান’ সাহেবের নাম থেকেই এসেছে দক্ষিণ আন্দামানের বাঙালি অধ্যুষিত জনপদ (বর্তমানে) ‘মানপুর’।

এ প্রসঙ্গে বলে রাখা যাক, মান সাহেবের নিযুক্তির আগে ‘পেনাল সেট্লমেন্ট’-এর উদ্দেশ্য নিয়ে ‘আন্দামান কমিটি’ গঠিত হয়েছিল (২০ নভেম্বর ১৮৭৫), যার সভাপতি হয়েছিলেন বেঙ্গল আর্মির সার্জন ডা. ফ্রেডারিক জন মৌআট। এই ডাক্তার মৌআটের নাম থেকেই উৎপত্তি হয়ে থাকবে দক্ষিণ আন্দামানের আর একটি জনপদ ‘পোর্ট মৌআর্ট-এর; বর্তমানে যা লোকমুখে ‘পোর্টমোট’ নামে উচ্চারিত হয়। আন্দামানের নাম-বিকৃতির জোর এমনই (শুধু স্থান-নাম নয়; মানুষের নামও) কেউ কেউ আবার এই জায়গাটিকে ‘কোর্টমোট’ও বলে থাকেন।
‘পোর্ট মৌআট’ থেকে ‘মানপুর’-এর দিকে মাত্র চার-পাঁচ কিলোমিটার এগোলেই একটি জনপদ— লোকমুখে যা

এখন ‘তুষনাবাদ’ নামে উচ্চারিত হয়ে থাকে। এ-ও তো তবু সহনীয়, কিন্তু যখন তামিলভাষী মালিক-পরিচালিত বাসের গায়ে ‘ডুষ্ণাবাদ’ লেখা হয়ে থাকে, তখন নাম-বিকৃতিটা কোন পর্যায়ে আসে তা সহজেই অনুমান করা যাবে, যখন জানা যাবে এই জায়গাটির প্রকৃত নাম হল— ‘টিউসনাবাদ’। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জর ষষ্ঠ ব্রিটিশ ‘চিফ কমিশনার’ (১৯০৩-১৯০৪)-এর নাম ছিল এফ ই টিউসন। সম্ভবত তাঁর নামেই এই জায়গাটির নামকরণ করা হয়েছিল।

টিউসন সাহেবের ঠিক পূর্ববর্তী (পঞ্চম) চিফ কমিশনার (১৮৯৪-১৯-০৩)-এর নাম ছিল কর্নেল স্যার রিচার্ড সি টেম্পল। এই টেম্পল নামানুসারে দক্ষিণ আন্দামানের আর একটি জনপদ ‘টেম্পলমিও’র সৃষ্টি। জায়গাটি পড়বে পূর্বোক্ত মানপুর থেকে ‘হারবার্টাবাদ’ যাওয়ার রাস্তায়, ‘কলিনপুর’ জনপদটি পার হওয়ার পর। এখানে লক্ষ্য করুন, আরও দু’টি জনপদের নাম উচ্চারিত হয়েছে— (এক) হারবার্টবাদ; এবং (দুই) কলিনপুর। এ দু’টি জনপদও, অনুমান করা যায়, ‘হার্বাট’ ও ‘কলিন’ / ‘কলিন্স’ নামের দুই সাহেব ব্যক্তিত্বর নাম থেকে এসে থাকবে।

মেজর (পরবর্তীকালে জেনারেল) ডোনাল্ড মার্টিন স্টুয়ার্ট ছিলেন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রথম ব্রিটিশ চিফ কমিশনার (১৮৭১-১৮৭৫)। তাঁরই নামানুসারে উৎপত্তি ‘স্টুয়ার্টগঞ্জ’-এর, যা দক্ষিণ আন্দামানেই অবস্থিত। আন্দামানের তৃতীয় ব্রিটিশ চিফ কমিশনার (১৮৭৯-১৮৯২) চিলেন টমাস ক্যাডেল, যাঁর নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে দক্ষিণ আন্দামানের আর একটি জনপদ ‘ক্যাডেলগঞ্জ’-এর। টমাস ক্যাডেল-এর আগে, দ্বিতীয় ব্রিটিশ চিফ কমিশনার চার্লস্ আর্থার বারওয়েল-এর কাছ থেকে কিছুদিনের জন্য (২৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৬ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৮ পর্যন্ত) চিফ কমিশনার-এর দায়িত্ব পেয়েছিলেন ক্যাপ্টেন এম প্রোথ্রো। এঁরই নামানুসারে রাজধানী পোর্টব্লেয়ার-লাগোয়া একটি জনপদের নাম হয় ‘প্রোথ্রোপুর’। তবে লোকমুখে এখন সে নাম হয়ে গেছে ‘পাথরাপুর’ কিংবা বড় জোর ‘প্রোথেরাপুর’।

১৯২০ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ব্রিটিশ চিফ কমিশনার (নবম) ছিলেন কর্নেল হেনরি সেসিল বিডোন। তাঁরই নামানুসারে দক্ষিণ আন্দামানের আর একটি জনপদ-এর নাম হয়েছে ‘বিডোনবাদ’; যদিও বর্তমানে কেউই আর ‘বিডোনাবাদ’ বলে না— বলে ‘বিড্নাবাদ’ বা ‘বিদ্নাবাদ’। এই ‘বিডনোবাদ’-এর পার্শ্ববর্তী একটি জনপদের নাম ‘বার্ড লাইন’— যার সম্ভাব্য উৎপত্তি হিসেবে ধরে নেওয়া যায় মেজর বার্ড-এর নাম। মেজর বার্ড ছিলেন আন্দামানের শেষ চিফ কমিশনার ও জাপানি-শাসন পরবর্তী আন্দামানি প্রথম ব্রিটিশ গভর্নর চার্লস্ ফ্রান্সিস ওয়াটারফল-এর ডেপুটি, যাঁকে জাপানিরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। এই বার্ড লাইনেরই কাছেপিঠে দক্ষিণ আন্দামানের যে জায়গায় সেনাছাউনি রয়েছে, সেটির নাম লোকমুখে এখন ‘ব্রিজগঞ্জ’ হয়ে গেছে। কিন্তু এই জায়গাটির প্রকৃত নাম হ’ল ‘বার্চগঞ্জ’— ‘বার্চ’ নামক একজন ব্রিটিশ অফিসারের নাম থেকে সৃষ্ট।

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দশম ব্রিটিশ চিফ কমিশনার (১৯২৩-১৯৩১) ছিলেন মাইকেল লয়েড ফেরার, যার নামানুসারে ‘ফেরারগঞ্জ’ নামটির উৎপত্তি। ফেরারগঞ্জ দক্ষিণ আন্দামান জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ; এই জেলার তহশীলগুলির একটি এবং পঞ্চায়েত সমিতিগুলির একটি এই ফেরারগঞ্জেই আছে। একাদশ ব্রিটিশ চিফ কমিশনার (১৯৩১-১৯৩৫) জন উইলিয়াম স্মিথ-এর নামে নামাঙ্কিত হয়েছে স্মিথ আইল্যান্ড। পোর্টব্লেয়ার শহর-সংলগ্ন মনোরম সমুদ্রসৈকত ‘কর্বাইন্স কোভ’-এর উৎপত্তি ‘কর্বাইন্স’ নামের এক ধর্মযাজকের নামানুসারে। তবে, ‘কর্বাইন্স কোভ’ কেউ আর বলে না; জায়গাটির নাম লোকমুখে এখন হয়ে গেছে— ‘কার্বোন স্কোপ’।

আন্দামানের আরও কিছু স্থান-নাম রয়েছে, যেগুলির নামকরণ অনুমান করা যায়, উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীদের নামানুসারেই হয়ে থাকবে। যেমন— হারবার্টাবাদ (হারবার্ট নাম থেকে), ব্রুক্সাবাদ (ব্রুকস নাম থেকে), অস্টিনাবাদ (অস্টিন নাম থেকে), টেলরাবাদ (টেলর নাম থেকে), হামফ্রেগঞ্জ (হামফ্রে নাম থেকে), হবডেপুর (হবডে নাম থেকে) ইত্যাদি। ইংরাজি মূল ছেঁায়া আন্দামানের আরও কিছু স্থান-নাম হলো— শোল বে, মিনি বে, ক্যাম্পবেল বেল, এরিয়াল বে, বাম্বুফ্ল্যাট, শোর পয়েন্ট, হোপ টাউন, লং আইল্যান্ড, উইম্বার্লিগঞ্জ, ডালিগঞ্জ ইত্যাদি।
মিশ্র সংস্কৃতির স্থান-নামে ভরা আন্দামান

ব্রিটিশদের কথা অনেক বলা হলো। এবার আসা যাক মিশ্র সংস্কৃতির পরিচয়-বহনকারী আন্দামানী স্থান-নামগুলির কথায়। ব্রিটিশ শাসনকাল থেকেই বর্মার সঙ্গে আন্দামানের একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ফলে, তৎকালীন বর্মা (বর্তমান মায়ানমার)-এর স্থান-নামের সঙ্গে (যেমন, কেনটং, ম্যানটং, মোয়কাং, বুটিটাং) আন্দামানী বহু জনপদ-নামের ধ্বনিগত মিল রয়েছে। যেমন— ফোঙ্গি কুয়াং, বারাটাং, থোরাটাং, জিরকাটাং, কার্মাটাং, পোটাটাং, মংলুটাং, কাড়াকাচাং, রাঙ্গাচাং, বিম্বলিটাং (ন) ইত্যাদি। দক্ষিণ ভারতীয় স্থান-নামের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে যেসব আন্দামানী জনপদ-নামের, সেগুলির মধ্যে আছে— কালিকট, কেরালাপুরম, শিবপুরম, কন্যাপুরম, পুদুমাদুরাই ইত্যাদি। যেসব আন্দামানী জনপদ-নাম উত্তর ভারতীয় (হিন্দি) সংস্কৃতির পরিচয়দ্যোতক, সেগুলির মধ্যে আছে— চৈনপুর, হংসপরী, নিম্বুবাগিচা, বেটাপুর, নমুনাঘর, নয়াশহর, লখনউ, বহলগাঁও, গান্ধীনগর, শাস্ত্রীনগর, যোগিন্দরনগর, মগরনালা ইত্যাদি। কিছু আন্দামানী জনপদ-নাম আছে, যা থেকে ছোটনাগপুরী সংস্কৃতির ছটা আসে, যেমন— জগন্নাথ ডেরা, পোকা ডেরা, কুর্মা ডেরা, মহুয়া ডেরা, বিচ ডেরা, সুন্দরগড়, নীলাম্বুর ইত্যাদি। আন্দামানের নিজস্ব রুচির স্বাক্ষর রাখে সিপিঘাট, মানারঘাট, জংলিঘাট, কড়িয়াঘাট, মিঠাখাড়ি, শয়তানখাড়ি, ধানিখাড়ি, কোরাংনালা, ধানিনালা, ছোলাদারি ইত্যাদি জায়গাগুলির নাম।

স্থান-নামে বাঙালি সংস্কৃতির ছাপ
স্বাধীনোত্তর দেশভাগের বলি হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত বাঙালি উদ্বাস্তুরা আন্দামানে পুনর্বাসন পান ১৯৪৯-৫০ সালে। আন্দামানে পুনর্বাসন পেয়ে বাঙালি তার নিজস্ব সংস্কৃতির যে প্রথম শিকড়টি মাটির গভীরে প্রোথিত করতে পেরেছিল, সেটি হল— তার নিজস্ব জনপদগুলির নামকরণ। এখানে এরকম কিছু জনপদ-নামের উল্লেখ করলেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে পাঠকদের কাছে।

শুরু করা যাক আন্দামান গ্রুপের সর্বদক্ষিণ দ্বীপ লিটল আন্দামান দিয়ে। সবচেয়েপরে পুনর্বসিত-প্রাপ্ত এই দ্বীপের যেসব অঞ্চল বাঙালিপ্রধান, সেই জনপদগুলির নাম বাঙালি মনীষীদের স্মরণে— নেতাজিনগর, রামকৃষ্ণপুর, বিবেকানন্দপুর, রবীন্দ্রনগর ইত্যদি। পোর্টব্লেয়ারের নিকটবর্তী ছোট্ট নীল দ্বীপ (বর্তমান নাম— শহিদ দ্বীপ)-এর জনপদগুলির নামকরণ হয়েছে রামায়ণের চরিত্র-স্মরণে— রামনগর, লক্ষ্মণপুর, ভরতপুর, সীতাপুর ইত্যাদি। তারই পার্শ্ববর্তী হ্যাভলক দ্বীপ (বর্তমান নাম— স্বরাজ দ্বীপ)-এর স্থান-নামগুলি আবার একটু বৈষ্ণব ঘেঁষা— শ্যামনগর, গোবিন্দপুর, কৃষ্ণনগর, রাধানগর, বিজয়নগর ইত্যাদি।

উত্তর আন্দামানের প্রধান জনপদটির নাম ডিগলিপুর হলেও, তার পার্শ্ববর্তী জনপদগুলির নাম কিন্তু বিশুদ্ধ বাঙালি-সংস্কৃতির পরিচায়ক— শিবুর, কালিপুর, দুর্গাপুর, গণেশনগর, লক্ষ্মীপুর, মধুপুর, রাধানগর, শ্যামনগর, কিশোরীনগর, রামনগর, সীতানগর, দেশবন্ধুগ্রাম, ক্ষুদিরামপুর, বিদ্যাসাগরপল্লী, রামকৃষ্ণগ্রাম, সুভাষগ্রাম, পশ্চিমসাগর, তালবাগান, কালীঘাট ইত্যাদি।

উত্তর আন্দামানের সীমা ছাড়িয়ে এবার যদি মধ্য আন্দামানে আসা যায়, তাহলে আবার ফিরে যেতে হবে সেই রামায়ণে, যার শুধু চরিত্রই নয়, স্থান দিয়েও নামকরণ করা হয়েছে এই অঞ্চলের। রামায়ণের চরিত্র নাম স্মরণে এই অঞ্চলের যে জনপদগুলি চিহ্নিত হয়েছে তার মধ্যে আছে রামপুর, লক্ষণপুর, ভরতপুর, সীতাপুর, দশরথপুর, জনকপুর, উর্মিলাপুর, কৌশল্যানগর ইত্যাদি। এছাড়াও আছে— মিথিলা, পর্ণশালা, শবরী, পঞ্চবটী, শ্যামকুণ্ড, হরিনগর, শান্তিপুর, স্বদেশনগর, বাসন্তীপুর, কদমতলা, বকুলতলা ইত্যাদি। মহাভারত-চরিত্রনামে আছে উত্তরা ও শান্তনু নামের গ্রাম দু’টি। দক্ষিণ আন্দামনের রয়্ছে— বৃন্দাবন, মথুর ইত্যাদি নামের জনপদ।

আন্দামানের মানচিত্রে উজ্জ্বল দুটি বাঙালি জনপদের নাম : তার ইতিহাস
নীরস প্রবন্ধ ছেড়ে এবার একটি গল্প শোনাই। ১৯৬৯ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি। কলকাতার প্রিন্সেপ ঘাট নিকটবর্তী ম্যান অব ওয়ার জেটি থেকে ‘কনৌজি আংরে’ নামাঙ্কিত একটি ২০ ফুট লম্বা, ৫ ফুট চওড়া এবং সাড়ে চার ফুট উচ্চতার দেশি নৌকায় সওয়ার হয়েছিলেন দুই অসমসাহসী যুবক পিনাকীরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ও জর্জ অ্যালবার্ড ডিউক। এই নৌকোটির বৈশিষ্ট্য ছিল এর দু’পাশের দু’টি কাঠের বাক্সপোরা হাওয়া; ব্যস আর কিছু নয়। ডিউক ও পিনাকীর লক্ষ্য ছিল — এই দেশি নৌকোয় করে দাঁড় বেয়ে বেয়ে হাজার মাইল দূরবর্তী আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জয় পৌঁছনো। এ যেন গ্যাসভরা বেলুনে চড়ে চাঁদে যাওয়ার দুঃসাহস। কিন্তু তাঁদের মনে হয়তো ছিল রবিঠাকুরের সেই অভয়মন্ত্র, ‘… এখন বাতাস ছুটুক তুফান উঠুক, ফিরব না তো আর…।’ না, পিনাকী আার ডিউক কিন্তু ফেরেননি, অর্থাৎ পিছিয়ে আসেননি তাঁদের লক্ষ্য থেকে। দীর্ঘ তেত্রিশ দিন ধরে ওই নৌকো বেয়ে বেয়ে ৬ মার্চ ১৯৬৯ তারিখে তাঁরা পৌঁছে যান আন্দামানে। তাঁদের এই বীরত্বগাথা যে আন্দামান চিরভাস্বর করে রেখেছে, তার উজ্জ্বলর উদাহরণ, মধ্য আন্দামানের দু’টি গ্রামের নাম রাখা হয়েছে তাঁদের নামে— পিনাকীনগর এবং ডিউকনগর।
এই যুগান্তকারী ঘটনাটির ‘আফটার-ইফেক্ট’ শুধুমাত্র বাঙালির আয়ত্ত্বের মধ্যে ছিল, তাই আন্দামানে এটা হয়ে আছে চিরস্মৃতি।

‘শহিদ’-‘স্বরাজ’ দ্বীপ
এবার আর একটি গল্প বলি; কিন্তু এটা একটু অন্যরকম। ১৯৪৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর। সমগ্র ভারতবর্ষর মধ্যে প্রথম ব্রিটিশমুক্ত অঞ্চলে দাঁড়িয়ে, অঞ্চলটিকে ‘স্বাধীন’ ঘোষণা করে একজন বিশুদ্ধ বাঙালি সেনানায়ক আন্দামানের মুখ্য শহর পোট ব্লেয়ারের জিমখানা গ্রাউন্ডে সেদিন উত্তোলন করেছিলেন ভারতীয় ত্রিবর্ণ পতাকা। সেই সঙ্গে তাঁর মনোবাঞ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে ‘আন্দামান’ ও ‘নিকোবর’ নাম দুটিকে বদলে, এর নাম রাখা হবে ‘শহিদ’ ও ‘স্বরাজ’ দ্বীপ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তাঁকে দেশছাড়া হতে হয়েছে; বিশ্ববাসী জেনেছে তাঁর রহস্যময় মৃত্যুগুজব।
তারপর, আন্দামান-সহ সমগ্র ভারত ব্রিটিশমুক্ত হয়েছে ১৯৪৭ সালে। ব্রিটিশের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর কেটেও গিয়েছিল পঁচাত্তরটা বছর; কিন্তু নেতাজির সেই স্বপ্নপূরণের কথা কোনও দেশপ্রেমিকের মাথায় আসেনি এই ৭৫ বছরে। অবশেষে, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, আংশিকভাবে হলেও, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সেই স্বপ্নকে রূপ দিয়েছেন— পূর্বতন হ্যাভলক দ্বীপের নাম বদলে ‘স্বরাজ দ্বীপ’ এবং পূর্বতন নীল দ্বীপের নাম বদলে ‘শহিদ দ্বীপ’ করে। এখানেই থেমে থাকেননি তিনি; পূর্বতন ‘রস দ্বীপ’-এর নামও বদলে করা হয়েছে ‘নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু দ্বীপ’। ‘দের আয়ে, দুরস্ত আয়ে’— এটাই আমাদের মতো নেতাজীভক্তদের কাছে বড় প্রাপ্তি।

Advertisement