হাত-পায়ের গিরা ব্যথা ও ফোলা রোগ

Written by SNS January 15, 2024 3:13 pm

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস একটি বাত রোগ, যা শরীরের গিরা ও অন্যান্য অঙ্গকে আক্রান্ত করে৷ এ রোগ লঘুমাত্রা থেকে তীব্রমাত্রা পর্যন্ত হতে পারে৷ লঘুমাত্রায় সামান্য কষ্ট হলেও তীব্রমাত্রায় অঙ্গবৈকল্য বা বিকলাঙ্গতা পর্যন্ত গড়াতে পারে৷ বাত রোগের সম্পূর্ণ আরোগ্য হয় না, তবে আধুনিক ও যথার্থ বা উপযুক্ত চিকিৎসায় ব্যথার উপশমসহ শারীরিক বিকলাঙ্গতা ঠেকানো সম্ভব৷ এ বিষয়ে বিস্তারিত  জানালেন অর্থোপেডিক্স ও ট্রমাটোলজিস্ট ডা. মিজানুর কল্লোল পাল৷
সচরাচর ২৫ থেকে ৫০ বছর বয়সের লোকদের বেশি গিরা ব্যথা বা বাত হয়৷ বৃদ্ধ বয়সেও এর প্রকোপ তেমন কম নয়৷ তবে বাত শিশুদেরও আক্রান্ত করে৷ এটি পুরুষের তুলনায় মহিলাদের ক্ষেত্রে তিনগুণ বেশি এবং ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সে বেশি পরিলক্ষিত হয়৷
কারণ
বাত কেন হয় এর সঠিক কারণ সাধারণত আজও জানা যায়নি৷ তবে জন্মগতভাবে কেউ এ রোগ হওয়ার কারণ বহন করলে এবং শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রাকৃতিক কোনো কারণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে উসকে দিলেই কেবল এ রোগের সূত্রপাত হতে পারে৷
বাতে শরীরে কী হয়
শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাজ করা শুরু করে তখনই এ রোগের সূত্রপাত হয়৷ এ রোগে ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজের শরীরের অঙ্গ তথা গিরা বা জয়েন্ট এবং গিরার আশপাশের কোষ বা কলাকে আক্রমণ করে৷ আক্রমণের ফলে গিরা বা জয়েন্টের পাতলা আবরণী বা সাইনোভিয়াল মেমব্রেন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ প্রদাহ জয়েন্টে অতিরিক্ত রস নিঃসরণ করে, ফলে জয়েন্ট ফুলে যায়৷ ফুলা ও প্রদাহ দুই-ই ব্যথার জন্য দায়ী এবং চলমান প্রদাহ সময়ে অস্থি বা কার্টিলেজ ধ্বংস করে, যা গিরা বা জয়েন্ট বিকলাঙ্গ করতে পারে৷
উপসর্গ
* হাত-পায়ের গিরা, হাঁটু, কাঁধ, কনুই ও হিপ জয়েন্টসহ আশপাশে ব্যথা হওয়া৷ শরীরের ডান ও বাম পাশ সমভাবে আক্রান্ত হয়৷
* সকালবেলা বা বিশ্রামের পর গিরা বা জয়েন্ট শক্ত হয়ে থাকে৷
* গিরা বা জয়েন্ট ফুলে যাওয়া৷ বিশেষভাবে হাত-পায়ের গিরা ও হাঁটু৷
* সব সময় ক্লান্তি বা অবসাদ ভাব৷
* পেশিতে বল কম পাওয়া এবং গিরা শক্ত হয়ে ধরে থাকায় শারীরিক কার্যক্ষমতার অবনতি৷
* ব্যথার জন্য রাতে ঘুমাতে না পারা৷
শুধু গিরা বা জয়েন্টই কি আক্রান্ত করে
জয়েন্ট ছাড়াও ত্বক, ফুসফুস, হার্ট, রক্ত, স্নায়ুতন্ত্র, চোখ, পরিপাকতন্ত্রসহ অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গকেও আক্রান্ত করে৷ তীব্রমাত্রায় ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষেত্রে এ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি৷
রোগ নির্ণয়ের উপায়
প্রথমত দরকার যথোপযুক্ত শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা৷ কিছু ক্ষেত্রে এ রোগ নির্ণয় বা ডায়াগনোসিস সহজ নয়৷ তাই রক্ত পরীক্ষা করতে হতে পারে৷ এ রোগে রক্তের ইএসআর এবং সিআরপি বেশি হয়৷ প্রায় ৮০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে রিউমাটয়েড ফ্যাক্টর পজিটিভ বা বেশি পাওয়া যায়৷ এক্স-রে এ রোগ নির্ণয়ের জন্য আবশ্যিক নয়, তবে এটা যেমন রোগ নির্ণয়ে সহায়তা করে তেমনি কার্টিলেজ বা অস্থিসন্ধির ক্ষতি হয়েছে কি না বা গিরা বিকল হচ্ছে কি না তা নির্ণয় করতেও সাহায্য করে৷
চিকিৎসা
এ রোগ সম্পর্কে শিক্ষা, সঠিক ওষুধ প্রয়োগ, ব্যায়াম, পরিমিত বিশ্রাম ও কীভাবে জয়েন্ট বা গিরাকে রক্ষা করা যায় তার শিক্ষাই কেবল দিতে পারে যথার্থ চিকিৎসা ব্যবস্থা৷ এটি একটি সমন্বিত কার্যক্রম, ঔষধি চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত রিউমাটোলজিস্ট বা বাত ব্যথা রোগ বিশেষজ্ঞ, ফিজিওথেরাপিস্ট, রিহেবিলিটেশন বিভাগ এবং কিছু ক্ষেত্রে অপারেশন প্রয়োজন হয়৷
শিক্ষার মূল বিষয়
* ব্যথার উপশম কিভাবে করা যায়, তথা গরম ও ঠান্ডা প্যাকের ব্যবহার৷
* অশান্তি উপশম, বিবেচনা বোধ ও দৃঢ় প্রত্যয়ী হওয়ার শিক্ষা৷
* নিজেকে নিরুদ্বেগ করা বা বিনোদন শিক্ষাসহ গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার শিক্ষা ও বিশেষ ব্যায়াম সম্পর্কে জানা৷
ওষুধ বা মেডিকেশন
প্রথম সারির ওষুধ, যেমন- ননস্টেরয়ডাল অ্যান্টিইনফ্লামেটরি মেডিকেশন যা ব্যথা, ফোলা ও গিরার জ্যাম কমাতে সাহায্য করে৷
প্রচলিত ওষুধ
* ন্যাপ্রোক্সেন ৫০০ মিলিগ্রাম থেকে ১০০০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন৷
* ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম ৫০-১০০ মিলিগ্রাম দৈনিক ২/৩ বার৷
* ইনডোমেথাসিন ২৫ মিলিগ্রাম দু-তিনবার প্রতিদিন৷
* পাইরক্সিক্যাম ১০ থেকে ২০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন৷
এ ওষুধগুলো জ্বালাপোড়া, বুকজ্বলা, পাতলা পায়খানা বা পায়ে জল নামার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া করতে পারে৷ আহারের মাঝে বা আহারের পরপরই খেলে আন্ত্রিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হয়৷ তবে কারো এ সমস্যা হলে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত৷ গ্যাস্ট্রিক বা আলসার আছে, এমন রোগীদের বেলায় অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন প্রয়োজন৷ কেননা এ ক্ষেত্রে অন্ত্রে ছিদ্র হতে পারে৷ এসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণমাত্রায় প্যানটোপ্রাজল ব্যবহার করা যেতে পারে৷
বিশ্রাম ও ব্যায়াম
ওষুধের পর বিশ্রাম ও ব্যায়াম জরুরি৷ বিশ্রাম ফোলা, ব্যথা ও অবসাদ দূর করতে সাহায্য করে৷ কাজের মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিতে হবে৷ কতটুকু বিশ্রাম প্রয়োজন তা রোগের তীব্রতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত৷ কেননা প্রয়োজনাতিরিক্ত বিশ্রাম ভালোর চেয়ে মন্দ করতে পারে৷ প্রতিদিন নিয়মিত শেখানো বিশেষ ব্যায়াম করা প্রয়োজন, যা পেশি শক্তকরণসহ অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টের বিকলাঙ্গতা প্রতিরোধে সাহায্য করে৷ গরম জলে ব্যায়াম বিশেষ উপকারী৷
গিরা বা জয়েন্ট রক্ষার উপায়
অসুস্থ গিরার ওপর অযাচিত চাপ গিরার আরও ক্ষতি করে৷ তাই গিরার ওপর চাপ বা ভর কমাতে হবে৷ বিশ্রাম বা হাঁটার সময় লাঠি বা ক্র্যাচ ব্যবহার করা যেতে পারে৷ বর্তমানে গিরা রক্ষার জন্য বিভিন্ন সহায়ক ডিভাইস ব্যবহার করা হয়৷
খাদ্য
সুষম খাদ্য খাওয়া জরুরি৷ কেননা তা শরীর রক্ষা ও অবসাদ দূর করতে সাহায্য করে৷ যদিও কদাচিৎ কিছু খাদ্যে কোনো কোনো বাত রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে, কিন্ত্ত অনেক রোগীর ক্ষেত্রেই বাতের ওপর খাদ্যের কোনো বিরূপ প্রভাব দেখা যায়নি৷