অন্তর্যামী

শ্যামলী রক্ষিত

লোহার বড়ো বালতি করে জল বয়ে আনতে বড্ড কষ্ট৷ এক বালতি জল কম ভারী তো নয়৷ কল পাম্প করতেই তো হাঁফিয়ে গেছে মিনি! হাঁফাতে হাঁফাতে নিজের উপরই বিরক্ত হচ্ছিল সে৷ আর বিড় বিড় করছিল, দিন দিন চেহারা যা হচ্ছে৷ এত ভারী চেহারা নিয়ে কেউ কাজ করতে পারে! কি করে যে এত ফুলছে কে জানে! এইভাবে যদি ভুঁডি় বাড়তেই থাকে, তাহলে তো পঙ্গু হয়ে যাবে৷ তবু একদণ্ড বসে থাকে না! সারাদিন কাজ তার কম নেই৷ কিন্ত্ত কলতলা থেকে বালতি ভর্তি জল টেনে আনা খুব কষ্টের! কালঘাম ছুটে যাচ্ছে তার! অবশ্য ভোম্বল যতদিন বড় হয়েছে, ততদিন এসব ভারীভুরি কাজে তাকে হাত দিতে দেয় না! ওই করে দেয় এসব! কিন্ত্ত ছেলেটা ক’দিন বাডি় নেই৷ তাই মুশকিলে পডে়ছে সে৷ যত কাজ এখন তাকেই সামলাতে হচ্ছে! তার তো মুখ চাইবার কেউ নেই৷ পৃথিবীতে যার মা বাপ নেই, তার আর মুখ চাইবে কে! এত কাজ কী করে সামলাবে তাই ভাবছে মিনি৷ সংসারে তো কাজ কম নয়৷ গুয়াল কাড়ো, গোবর নেদে দাও৷ কাঁথ থেকে ঘুঁটে খুলে রোদে দাও৷ এসব সারতে সারতেই তো বেলা দুপুর হয়ে যায়৷ রান্না-বাড়া করা৷ আর পেরে উঠছে না সে৷ এমন মানুষের পাল্লায় পডে়ছে, জ্বলিয়ে পুডি়য়ে খাক করে দিল জীবনটা! কোনোদিন সংসারের কুটো কেটে দুটো করে না৷ মুখে রক্ত উঠে মরে গেলেও বলবে না দাও, আমি করছি৷ রাগে মনে মনে এই সব আওড়ালেও মুখ ফুটে কিছু বলল না, একবার আড়চোখে দেখল বিশুকে৷ দেখেই গা পিত্তি আরো জ্বলে গেল তার৷ হাসি হাসি মুখ করে বসে আছে বাবু সেজে৷ দেখে তার গজগজানি বেডে় গেল৷ জোরে জোরে বলতে শুরু করল মিনতি, বাডি়তে তো আর কেউ বাস করে না৷ তাদের তো কোনো দায় নেই৷ যত দায় তো এই মিনি বাগদির৷ সংসারটা তো একা তার৷ বাকিরা তো ভাড়া এসেছে৷ তাদের আর কি? ফুরনের কাজ সেরে দিয়েছে, হয়ে গেছে৷ এখন বসে বসে মজা দেখছে! চোখে লংকার গুঁড়ো দিয়ে দিতে পারলে গায়ের জ্বালা মেটে৷ বুড়ো মিনসে কোথাকার, মুঁয়ে আগুন অমন স্বামীর৷

বিশু কিন্ত্ত কিছুই শুনতে পায়নি৷ সে তখন একটা ঘোরের মধ্যে আছে! নিজের মনে বসে বসে ভাবছে, আর হাসছে! মিনির দিকে তার নজর ছিল না৷ তা দেখে মিনির গা-পিত্তি জ্বলে গেল৷ রাগে মাথার চাঁদি চিন চিন করছিল তার৷ তবু গজগজ করতে করতে, চোখ ফিরিয়ে কাজে মন দিতেই হল তাকে৷ হাতে তার একদম সময় নেই৷ এখন এক এক করে সব ক’টার মুখে জল ধরতে কম সময় লাগবে না! তার পর সন্ধে ধোঁয়া দেওয়া৷ চা চাপানো৷ সে অনেক কাজ৷ এসব একবার মনে মনে ঝালিয়ে নিয়ে খুব দ্রুত কাজ সারতে শুরু করল সে!


এদিকে মুগলি জলের জন্যে ছটফট করছে তখন৷ গলা বাডি়য়ে এমন টানাটানি করছে, দডি় ছিঁডে় ফেলবার জোগাড়! মিনি তাড়াতাডি় জলের বালতিটা নিয়ে গিয়ে, ওর মুখের গোড়ায় বসিয়ে দিল! জলের বালতিতে মুখ ডুবিয়ে এক টান দিয়েই, তার দিকে গলা তুলে দাঁডি়য়ে থাকল মুগলি৷ ওকে রোজ আগে গলা চুলকে আদর করতে হবে৷ তারপর জল খাবে৷ ওর সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল মিনতি৷ পেটে হাত দিতেই মুগলি চোখ বুজে চুপ করে, লেজ তুলে দাঁডি়য়ে থাকল৷ খুব মায়া হল মিনির৷ আহা ভরা পুয়াতি বলে কথা৷ খুব কষ্ট পাচ্ছে মুগলি৷ ভারি পেট নিয়ে হাঁসফাঁস করছে৷ জানটা তো ওদেরও মানুষেরই মতো৷ ওরা অবলা জীব তাই মুখ ফুটে ওদের কষ্টের কথা বলতে পারে না৷ বড় মায়া হল মিনতির৷ সারাটা জীবন তো এদের সঙ্গেই ঘরকন্না তার! এরাই তার আপনজন৷ নিজের জীবনের সুখ দুঃখ মিনি তো এদের সঙ্গেই ভাগ করে নেয়৷ এই মুগলি, কালি, ভোলা এরা তার সংসার মাথায় করে রেখেছে! দু’বেলা দু’মুঠো মুখে তুলতে পারছে তো এদের জন্যেই! এক কাঠা জমিজমা নেই, কোনো ব্যবসা পত্তর নেই৷ থাকার মধ্যে আছে শুধু এরা৷ দুধ বেচে, ঘুঁটে বিক্রি করে, হাঁস মুরগির ডিম বিক্রি করে তার সংসার চলে! তার স্বামী ছেলে মেয়ে সবাইকে বাঁচিয়ে রেখেছে৷ তাই তার জীবনের সব কিছু, এদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে, পরম শান্তিতে বেঁচে আছে মিনতি!

দুঃখ হলে, কষ্ট পেলে মানুষ যেমন আপনজনের স্নেহের স্পর্শ পেতে চায়৷ ভালোবাসা আর আদর পেতে চায়৷ একটু ভালোবাসা পেলেই যেমন, মনের সব জ্বালা যন্ত্রণা দূর হয়ে যায়, মুগলিও তো তাই চাইছে তার কাছে৷ ভর-ভরন্ত সময় এখন! খুব কষ্ট পাচ্ছে মুগলি তাই স্পর্শ পেতে চাইছে! মুগলিকে অবাক হয়ে দেখে মিনতি৷ এতক্ষণ জল খাবার জন্যে ছটফট করছিল! আর এখন দেখো খাবার কোনো গা-ই নেই! এদিকে অন্যরা হামরাচ্ছে! মিনি বলল, দেখ মুগলি আর নয়৷ এবার জলে মুখ দে শিগগির৷ ওদিকে লালি হাঁই ফাই করছে জলের জন্যে৷ তুই আগে খা৷ তারপর ওকে দিই৷ শুধু লালি নয়৷ ততক্ষণে সবাই হুটোপুটি করছে৷ কারুর সবুর সইছে না আর! জলের বালতি হাতে নিয়ে আসতে দেখে সবাই ঘাড় তুলে দেখছে!

বাঁ-বাঁ করছে আর কান ঝাপটা দিয়ে অপেক্ষা করছে, কখন জলের বালতিটা আসবে তাদের মুখের গোড়ায়৷ সবারই তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে৷ যাবে না কেন, যা রোদ উঠছে! তেমনি গরম পডে়ছে কদিন৷ মিনি এবার তাড়া দিল, খা তাড়াতাডি়৷ তোর মা-বোন সব তেষ্টায় মরে যাচ্ছে৷ তুই আগে খেয়ে নে মুগলি৷

ঠিক সেই সময় আবার চোখ পড়ল বিশুর দিকে৷ তখনও সেই একই রকম করে বসে আছে৷ মিনির কেমন সন্দেহ হল৷ কী এমন ঘটল! অমন হাসি হাসি মুখ করে আকাশের দিকে চেয়ে বসে আছে যে লোকটা! ব্যাপারটা মোটেই সুবিধের লাগছে না মিনতির৷ কেমন সন্দেহ হচ্ছিল তার৷ ক’দিন ধরেই এই রকম পরিবর্তন লক্ষ করছে! সেই যে একদিন বিকেল দিকে সাজগোজ করে বেরোলো৷ কোথায় গেসল, কী বিত্তান্ত সেসব মনে নেই আর কিন্ত্ত তারপর থেকেই দেখছে এমন উড়ু-উড়ু ভাব বিশুর৷ কী যে ফন্দি আঁটছে কে জানে! বুড়ো মিনসের স্বভাব তো ভালো নয়৷ এখনও পর্যন্ত মেয়ে দেখলেই হ্যাংলামো করে বেড়ায়৷ এই সেদিন বর্ধমানে ডাক্তার দেখিয়ে ফিরছিল ট্রেনে৷ নিজের মেয়ের বয়েসি একটা মেয়েকে দেখে এমন ছুঁকছুঁক করছিল, লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল মিনতির৷ গরিব মানুষ বলে কী বাডি়র মেয়েদের মান ইজ্জত নেই নাকি৷ বাডি় এসে কি না বলেছে বিশুকে! কিন্ত্ত তার কি লজ্জা আছে নাকি! আবার দেখো কার সঙ্গে কোথায় কী করে এসে, এখন বাডি়তে এসে সেসব ভাবছে বসে বসে! অমন হাসি-হাসি মুখ করে যে সংসারের চিন্তা করেনি মুখপোড়টা, একথা আর কাউকে বলে দিতে হবে না৷ রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল তার, তবু চুপচাপ দেখল৷ এখন তার অনেক কাজ বাকি৷ বিকেল বেলায় মাঠ থেকে গরু আনার পর, একে একে খুঁটোতে বাঁধা, রাস্তার সিলিন্ডার কল থেকে জল এনে সবাইকে জল দেখানো, পাক্কা ঘন্টা খানেক সময় লেগে যায়৷

লোকে তো শুধু পয়সাটাই দেখে৷ হিংসায় বুকে তেলে জলে দেয় সব৷ সেদিন তো ঘোষ কাকিমা মুখের উপর বলেই দিল, মিনি বাগদির কপাল ভালো৷ গরুতে এত এত দুধ দিচ্ছে৷ পন পন ঘুঁটে বিক্রি করছে! অমন ভাগ্য কি আর সবার হয়৷ বলে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কটকট করে তাকিয়ে দেখেছিল তাকে৷ মিনতি রেগে লাল হয়ে গিয়েছিল, কিন্ত্ত কিছু বলেনি৷ বয়স্ক মানুষ তাই ছেডে় দিয়েছে৷ লোকের চোখ কি কম খারাপ নাকি৷ কখন কে কোথা থেকে কী করবে, তখন সব যাবে৷ এই তো গেল বছর কালি পেসব হবার পর, এমন শুকনো বাণ মারলে, গায়ের দুধ সব গায়েই শুকিয়ে গেল! বাছুরটা পর্যন্ত একফোঁটা দুধ খেতে পায় নি৷ গয়লার থেকে দুধ কিনে ফিডিং বোতলে করে দুধ খাইয়ে তবে বাঁচিয়েছে বাছুরটাকে৷ কত কাণ্ড করে বিজলের হামিদ রোজা কালিকে বাঁচিয়েছে৷ হামিদ এসে যেই কালির গায়ে হাত দিয়েছে, অমনি বাঁই করে এমন চাট ছুঁডে়ছে, লাগলে দাঁত কপাটি ভেঙে গুঁডি়য়ে যেত চাচার৷ দেখে শুনে হামিদচাচা বলল, গরুর মোর একবারে ভেরে রেখেছে রে বিশু৷ দেখি কী করা যায়৷ আগে একটু সরষের তেল দে তো মা৷ তেলটা পডে় ওর বাঁটে লাগিয়ে দিয়ে ঝেডে় দিই আগে৷ হাতের তালুতে এক খাবলা সরষের তেল নিয়ে, মন্ত্র পড়ছিল আর ফুঁ দিচ্ছিল হামিদ চাচা৷ তারপর সেই তেল, কালির বাঁটে লাগিয়ে অনেকক্ষণ ধরে মালিশ করল৷ কালি লেজ তুলে চুপটি করে দাঁডি়য়ে থাকল তখন৷ এতক্ষণ যে লাফালাফি করছিল, বাঁটে কাউকে হাত দিতেই দিচ্ছিল না৷ কাছে গেলেই চাট ছুঁড়ছিল৷ সেসব বন্ধ হয়ে গেল তার৷ এক শিশি সরষের তেল পডে় দিয়ে বলল, তিনবার করে তিনদিন পীরবাবার নাম করে বাঁটে মালিশ করে দিবি৷ শিংয়ে লাগাবি৷ সারা গায়ে এই তেল পীরবাবার নাম করে লাগাবি ভালো হয়ে যাবে৷ আবার আগের মত দুধ দেবে দেখবি! আর এক কাজ কর বিশু৷ এক কেজি খোল নিয়ে আয়৷ আমি খোলটা পডে় দিয়ে যাই৷ দু’বেলা জাবনার সঙ্গে দিবি ডাবায়৷ কিন্ত্ত দেখিস মিনি, এই খোল যেন ভুলেও আর কাউকে দিবি না৷

উফ্ কত কাণ্ড করে তারপর কালি দুধ দিল৷ সব্বনেশেরা কম পেছনে লেগেছে! খেটে খেটে মুখে রক্ত উঠে যায় সেটা দেখে না চোখে! শুধু পয়সাটাই দেখতে পায়! তাই দেখ তোরা৷ তোদের চোখে আগুন লাগুক৷ আমি যেন ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখে থাকি৷ তোরা জ্বলে পুডে় মর সব৷ এই সব নানান ভাবনায় দুলতে দুলতে মিনি হাতের কাজ সারছিল৷ মাঠ থেকে এসে রাত পর্যন্ত খামারেই, জলশিরীষ গাছের নিচে খুঁটোতে বাঁধা থাকে গরু বাছুর সব৷ দুধ দোয়া হয়ে গেলে, জল দেখিয়ে ঘরে ধোঁয়া দিয়ে একে একে দডি় খুলে ঘরে ঢুকিয়ে নেয়৷ এইসব সারতে সারতে অনেক সময় লাগে৷ মিনতি দেখল সেই থেকে মুখ রগডে় মরে যাচ্ছে সে, আর ওদিকে বুড়ো মিনসেকে দেখো৷ বসে বসে কেমন মসকরা করছে! কিছু বলব না বলব না করেও কাছে এসে থমকে দাঁডি়য়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, বুড়ো ভাম, তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, এখনো এত রস! লজ্জা করে না তোমার? আজ তোমার ব্যবস্থা ভালো করেই করছি দাঁড়াও৷ আগে হাতের কাজগুনি সারি, ছেলে মেয়েরা খেয়ে ঘুমাগ তারপর তোমার ব্যবস্থা হবে৷

বিশুর মাথার চাঁদি গরম হয়ে গেল! দিলে ঘোরটা ভেঙে! খান্ডারনি বউ তাকে একটু নিশ্চিন্তে বাঁচতে দেবে না! দিনরাত গালাগালি দিচ্ছে৷ মরণ ডেকে বসে আছে তার! একটু যদি গল্প করতে দেখেছে কারুর সঙ্গে, অমনি বলবে তার সঙ্গে জুটে আছি৷ এমন সন্দেহ বাতিক মেয়েছেলের সঙ্গে ঘর করতে পারে কেউ? সংসারের মাথায় খ্যাংড়া মারি৷ জ্বলে পুডে় মল্লুম৷ দাঁড়া এবার মজা দেখাবো তোকে৷ তোর পায়ে ধরে আর পডে় থাকব না! এতদিন তোর সব অত্যাচার আমি সয়েছি৷ আর নয়৷ আমি আমার রাস্তা দেখে নোবো! কত ধানে কত চাল বুঝবি তখন৷ ব’লে চুপ করে বসে থাকল বিশু৷ এদিকে মিনির কেমন সন্দেহ হচ্ছে৷ ক্রমশ সন্দেহ আরও বেডে় চলেছে তার৷ বিশুকে বিড়বিড় করতে দেখে থমকে দাঁডি়য়ে পড়ল৷ চোখ খাড়া করে এমন তাকিয়ে ছিল তার দিকে৷ মনে হচ্ছিল যেন বুক চিরে দেখে নিচ্ছে তার বুকের ভেতরের সমস্ত গোপন নকশা৷ সেই দৃষ্টির সামনে ঝলসে যাচ্ছিল বিশু৷ ভালো করে দেখে নিয়ে বলল, কার কথা ভাবছ শুনি৷ বিশু চমকে উঠে আমতা আমতা করছিল৷ কী বলবে বুঝতে পারছিল না৷ হঠাৎ করে কে যেন তার মুখ দিয়ে বলিয়ে নিল, বলল, কার কথা আর ভাবব বল? তুই তো অন্তর্যামী৷ সবই তো দেখতে পাচ্ছিস৷ তুইই বল না মিনি!