পরিবর্তন

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়

ক্লাসে মৌসুমী মিস পড়াচ্ছে সেটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল ধৃতিমান৷ অনেকক্ষণ নি ডাউন হয়ে আছে বলে তার গা হাত পা ব্যথা করছে৷ প্রতিদিনের মতো আজও মৌসুমী মিস ধৃতিমানকে পানিশমেন্ট দিয়ে নি ডাউন করে দাঁড় করিয়ে রেখেছে৷অবশ্য এই নি ডাউন হয়ে থাকার ব্যাপারটা এখন রীতিমতো গা সওয়া হয়ে গেছে ধৃতিমানের৷ শুধু মৌসুমী মিস নয় ধৃতিমান প্রায় প্রতিটা মিস এবং স্যারেরই এই কয়েকদিন ধরে চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে৷ এর পিছনে কারণ রয়েছে অনেক, ধৃতিমানের অমনোযোগীভাব পড়াশোনার প্রতি চরম অনিহা, স্কুলে অনুপস্থিতি, ক্লাসে আসার নাম করে বাইরে ঘুরে বেড়ানো, ক্লাসে দেরি করে ঢোকা, পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ করা আরো যে কত তার হিসেব মেলা ভার৷ ধৃতিমানের বয়স এখন ১২ বছর কিন্ত্ত এই বয়সেই তার হাবভাব ও আচরণ শুধু স্কুলের সবাই কেন বাডি়র পরিবার আত্মীয়-স্বজন সকলকেই বিতস্রদ্ধ করে তুলেছে৷ ছোটবেলা থেকেই তার দুষ্টুমির জন্য পর পর দুটো স্কুল বদল করে এই স্কুলে ভর্তি হয়েছে ধৃতিমান তবুও তার স্বভাব আচরণে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন নেই৷ এই স্কুলে বছর দেডে়ক হলো সে ভর্তি হয়েছে এরই মধ্যে পাঁচবার গার্জেন কল হয়েছে তার৷ স্কুল থেকে বাডি় ফিরেই ভিডিও গেম নিয়ে বসে গেল ধৃতিমান৷ সারাটা দুপুর থেকে রাত গডি়য়ে গেল ভিডিও গেম খেলে গেল সে৷ পড়াশোনা একেবারে শিকেয় উঠেছে৷ বাডি়র সবাই তার কাছে অনুরোধ করলো পড়তে বসার জন্য, শুধরে যাবার জন্য কিন্ত্ত সে কোন কিছুরই ধার ধারে না৷ ইদানিং সে কোচিং যাওয়াটাও একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে৷ কোচিং এর স্যার বাডি়তে ফোন করে বেশ কয়েকবার খবর নিয়েছে ধৃতিমানের৷ বাডি়র লোক আত্মীয়-স্বজন সবাই ধৃতিমানকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্ত্ত কোন ফল হয়নি৷ দিন দিন আরো অবনতি হতে থাকে তার৷ ইউনিট টেস্টের একেবারে জঘন্য রেজাল্ট আর তার ফলস্বরূপ অ্যানুয়াল পরীক্ষায় ফেল করে যায় ধৃতিমান৷ কিছুদিন পর ধৃতিমানদের স্কুলে নতুন স্যার আসে ৷ সেই স্যারের যেদিন প্রথম ক্লাস সেই দিনও যথারীতি ধৃতিমান করে ক্লাসে ঢোকে৷ কিন্ত্ত নতুন স্যার ধৃতিমান দেরি করে ঢুকলেও তাকে কিছু না বলেই ঢুকতে দিয়ে দেয়৷ এরপর সেই স্যার ধৃতিমানকে পড়া জিজ্ঞেস করলে ধৃতিমান কোন উত্তর দিতে পারেনা, যেখানে ক্লাসের অন্যান্য সহপাঠীরা সমস্ত প্রশ্নের প্রায় অনায়াসে উত্তর দিয়ে দিচ্ছে৷ নতুন স্যার তবুও ধৃতিমান কে কিছু বলল না৷ ছুটির শেষে সকল ছাত্র-ছাত্রী বেরিয়ে যাওয়ার পর ওই স্যার ধৃতিমান কে ডাকলো৷ সে কাছে যেতেই তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “তোমার নাম ধৃতিমান?”
“হ্যাঁ স্যার”৷
“আমার নাম পরাগ৷ পরাগ পালিত৷ মন দিয়ে পড়াশোনা কর কেমন৷ যাও”৷

ধৃতিমান বড্ড অবাক হল৷ কি ব্যাপার পরাগ স্যার বকলো না৷ হিসাব মতো তো স্যার এর তাকে বকা উচিত যে সে কেন ভালো করে পড়াশোনা করতে পারছে না তাতে দেরি করে ঢুকছে৷ এসব তো কিছুই জিজ্ঞাসা করলে না৷ সেদিন বাডি় ফিরে সে আবার সারাটা দিন ফাঁকি মেরে কাটিয়ে দিল৷ কিন্ত্ত সে অবাক হয়ে দেখল তার বাডি়র লোক তাকে কোন কিছুতেই আর বাধা দিল না উল্টে তার সাথে এমন ব্যবহার করতে লাগলো যেন মনে হচ্ছে সে খুব ভালো কাজ করছে এবং সে খুব ভালো ছেলে হয়ে গেছে৷ স্কুলেও তাই ঘটতে লাগলো এরপর থেকে কোন স্যার বা ম্যাডাম তাকে আর বকাবকি করল না উল্টে তার সাথে ভালো ব্যবহার করতে শুরু করল৷এমন ব্যবহার যেন সে কোন অন্যায়ই করছে না৷ এক মাস পর প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষায় আবার রেজাল্ট যেই কে সেই৷ তবে রেজাল্ট দেখে স্কুল এমনকি রীতিমনের বাডি়র লোক কেউ তাকে কিছু বলল না সবাই যেন নির্বাক নির্বিকার৷ যেন কিছুই হয়নি৷ ওদের ক্লাসে ফাস্ট হলো গৌরব নামে একটা ছেলে৷ ছেলেটিকে সকল ছেলেমেয়েরা অভিনন্দন জানালো৷ স্কুলের প্রত্যেকটা ম্যাডাম থেকে শুরু করে স্যার এবং হেডমিস পর্যন্ত গৌরবের অনেক প্রশংসা করল৷ ধৃতিমান এগুলো দেখে যাচ্ছিল৷ সেদিনকে স্কুল ছুটির পর ধৃতিমান দেখলো গৌরবের বাবা-মা গৌরব কে স্কুলে আনতে এসে সকলকে গর্ব করে বলছে গৌরবের কথা৷ আর প্রত্যেকটা স্টুডেন্ট এবং তাদের গার্জেন গৌরব কে বাহবা দিচ্ছে৷ হঠাৎ আচম্বীতেই ধৃতিমানের মনের ভেতর গৌরবকে দেখে কেমন একটা লোভ হল৷ গৌরবের মতো সকলের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়ানোর লোভ৷


স্কুল থেকে বাডি় ফিরে এসে ভিডিও গেম নিয়ে বসে পড়লো ধৃতিমান৷ সে জানে এখন তাকে বাধা আর কেউ দেয় না৷ ভিডিও গেম খেলার টেবিলে একটা খবরে কাগজ দেখতে পেল সে কাগজটার উপর লেখা আছে এ বছরের মাধ্যমিকের কয়েকজন কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের নাম৷ ধৃতিমান ভালো করে খবরের কাগজটা দেখে তারপর হঠাৎই খবরে কাগজটা রেখে ভিডিও গেম খেলা বন্ধ করে দিয়ে দিয়ে বই খাতা নিয়ে বসে যায়৷ সেদিন রাত্রি বেলায় স্বপ্ন দেখে ধৃতিমান৷ সে অনেক বড় হয়েছে৷অনেক উন্নতি করেছে জীবনে ৷তার জন্য সবাই গর্ব করছে৷ পরদিন থেকে ধৃতিমান সকলকে অবাক করে দিয়ে সময়ের আগে স্কুলে পৌঁছে যায়৷ প্রতিটা ক্লাসে এসে শান্ত হয়ে থাকে মন দিয়ে পড়ানো শোনে৷ চলে আসে সেকেন্ড ইউনিট টেস্ট৷ সকলকে অবাক করে দিয়ে সেকেন্ড ইউনিট টেস্টে গোটা ক্লাসে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে ধৃতিমান৷ তার এমন চমৎকার চোখ জুরানো রেজাল্ট দেখে সকলেই অবাক হয়৷ একদিন যখন ধৃতিমান কোচিং এ পড়তে গেছে তখন ধৃতিমানদের বাডি়তে পরাগ স্যার ও মৌসুমী মিস আসে৷ বাডি়তে সেই সময় ধৃতিমানের মা আর বাবা ছিল৷ পরাগ স্যার কে ধৃতিমানের মা কৃতজ্ঞতার সুরে জানায়,“ধন্যবাদ স্যার৷ আপনার পরিকল্পনার জন্যই আমার ছেলেটা আবার সঠিক পথে ফিরে এলো৷ আপনি বলেছিলেন যে ওকে কোন কিছু বাধা না দিতে৷ ওর মন যা চায় ওকে করতে দিতে৷ আমরা সকলে মিলে আপনার কথা শুনি এমন কি স্কুলেও সমস্ত টিচাররাই আপনার কথা শোনে৷আর সত্যিই ফল হয়৷ ও নিজে থেকেই পরিবর্তন হয়ে গেছে এখন৷ অন্য লোকের প্রশংসা দেখে ও নিজে নিজেই ও ভালো হওয়ার ইচ্ছাটা জেগে উঠেছে৷ আপনার কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ স্যার৷“

মৌসুমী মিস বলল,“সত্যি ধৃতিমান এখন অনেক পাল্টে গেছে৷ ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করছে৷ এইভাবে চলতে থাকলে আমার বিশ্বাস আসন্ন অ্যানুয়াল পরীক্ষায় ও এইবার ক্লাসে একেবারে ফাস্ট হবে”৷
ইতিমধ্যেই কোচিং থেকে ফিরে এসে ধৃতিমান বাইরে আড়াল থেকে সমস্ত কথা শুনছিল৷ সে ভেতরে এসে পরাগ স্যার এবং মৌসুমী মিস কে প্রণাম করল৷ তাদের বুকটা যেন আনন্দে ভরে গেল৷ তারা লক্ষ্য করল ধৃতিমানের মা-বাবার চোখ দুটো আনন্দে চিক চিক করছে৷