সহযাত্রী

Written by SNS June 2, 2024 3:59 pm

অনির্বাণ চৌধুরী

দমক বেড়েই চলেছে বৃষ্টির৷ এখন প্রায় মুষলধারে বলা চলে৷ নাছোড় বৃষ্টির গুঁড়োরা কাঁচের গায়ে লেপটে থাকতে চাইছে৷ দৃষ্টিপথ আগলে ঝাপসা আড়াল৷ একজোড়া কাঁচ মোছার যন্ত্রের নিরন্তর বাঁয়ে ডানে চলাচল করে দুখানা স্বচ্ছ অর্ধবৃত্ত বানাবার বৃথা চেষ্টা৷ এ যন্ত্রকে শিক্ষিত বাঙালি ওয়াইপার নামে চেনে৷ লাল শালু দিয়ে উইন্ডস্ক্রিনের ভেতরের দিকটা মুছে নেয় মঙ্গল৷ মঙ্গল সোরেন৷ বাস চালায় বলে নিজের মহল্লায় তার খুব কদর৷ মানী মানুষ৷ আজ আর সন্ধে এল না৷ বৃষ্টির হাত ধরে ঝুপ করে রাত নামল৷ নিকষ৷ এমন বৃষ্টিদিনে সন্ধের আড়াল ডিঙিয়ে বিকেল আর রাত মুখোমুখি হয়৷ মেঘমেদুর বরষা৷ সব বাঁধের জল ছাড়া হয়েছে৷ কম বেশী৷ কূল ছাপিয়েছে অজয়ের৷ প্লাবন৷ জলের তলায় সুপুর, রায়পুর মৌজার বিস্তীর্ণ চর৷

সামনের দরজা দিয়ে উঠে বাঁ দিকে ড্রাইভারের পাশের টুইন সিটের জানলার ধারটা অনুপের একেবারে নিজস্ব৷ নিত্যযাত্রীরা এমন সুবিধা পেয়েই থাকে৷ সামনের রাস্তার দিকে বড় বড় চোখে নিস্পলক চেয়ে থাকে সে৷ পুরোটা পথ৷ চোখ সরাতে পারে না৷ অভ্যাস৷ কান ঘেঁষে চলে যায় সাইকেল, বাইক, পথচারী মানুষ, ছাগল, কুকুর৷ ইস্স্ করে ওঠে অনুপ৷ ব্রেক, স্টিয়ারিং কোনওটারই নিয়ন্ত্রণ তার হাতে নেই৷ তবু৷ স্বভাব৷ অনিষ্টের আশঙ্কা তার মুদ্রাদোষ৷ শুধু ওই একবার ছাড়া অনিষ্ট তার জীবনে হাত রাখেনি কখনও৷ তবু..৷ হেড লাইটের ধারালো আলো জমাট অন্ধকার ফুঁড়ে বেশি দূর এগোতে পারে না৷ এমন মেঘদিনে তার খোলা চুলের অন্ধকার ফিরে আসে৷ কোনও অন্ধকারই শাশ্বত নয়৷ কেটে যায়, ঠিক৷ বৃষ্টি মনকেমন বয়ে আনে৷ ভিজে যায় অনুপ৷ ব্যাগের মধ্যে ভাঁজ করে রেখে দেওয়া ছাতা৷ কত কাকভেজা দুপুর৷ ভেসে যাওয়া সন্ধে৷ যা ভেসে যায় তা যায়৷ যখন থাকে রোজ থাকে৷ আঁকড়ে থাকে অভ্যাসের মতো৷ আষ্টেপৃষ্ঠে থাকে৷ লেগে থাকে সব বাঁকে৷ দমবন্ধ জাপটে ধরে তবে শ্বাস নেওয়া৷ সেই যখন ভেসে যায়, একেবারে যায়৷ এতটুকু থাকে না৷ কোত্থাও না৷ আজকাল দম নিতে পারে অনুপ৷ বুকের মাঝের হুহু-টা হালকা হয়েছে খানিক৷

অনুপ জানত, এমনটা হবার নয়৷ হতে নেই৷ অমন পরীর মতো মেয়ে কখনও কেরানির বউ হয়? বাবা মায়ের কত স্বপ্ন৷ সমাজের নখ, দাঁত, জিভ৷ মাথার আশঙ্কা মন মানেনি৷ অলৌকিকের আশা মানুষ কবে আর ছাড়তে পেরেছে! হোয়াট্সঅ্যাপের হূদয় এফোঁড় ওফোঁড় লাল তির ইমোজিরা সত্যি৷ ঘাসের উপর বসে, জিকস’ পাজল মিলিয়ে তৈরি করা রঙিন স্বপ্নেরা সত্যি৷ ফেলে রেখে আসা অনর্গল, অকারণ কত সত্যি না হতে পারা কথা সত্যি৷ অনুপের কন্ঠে ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’ শুনে তার আনন্দাশ্রু সত্যি৷ লেকের পাড়ে, তার কোলে মাথা রেখে প্রাণ ভরে শোনা ‘অধরা মাধুরী’, ‘তুমি মোর পাও নাই’ সত্যি৷ সব সত্যি৷ এত সত্যি, মিথ্যে হয়ে যাবার দিনটাও সত্যি৷ সেদিন আকাশে মেঘ নেই৷ যাই-যাই করছে আলো৷ কনে দেখা আলো৷ সরাসরি না বলেছিল সে৷ ছলনা করেনি৷ ছলনা জানত না সে৷ একেবারে৷ বাবা, মা, জ্যাঠামশাইকে দোষ দেয়নি৷ হবু বরের নাম, দেশ, পেশা, প্যাকেজ সব বলেছিল৷ অকপট৷ খুব সৎ মনে হয়েছিল তাকে সেদিন, বরাবরের মতো৷ শেষের সে দিন অবিকল দেবীর মতো লাগছিল তাকে৷ শেষবারের মতো, কোলে মাথা রেখে একটিবার শুতে চেয়েছিল অনুপ৷ আপত্তি করেনি সে৷ মানুষ এত উদারও হতে পারে! নরম ঘাসের চেনা বিছানা রুক্ষ হয়েছিল সেদিন৷

তারপর শুধুই ভেঙে যাবার গল্প৷ মড়মড় করে ওঠে জীবন৷ কেউ কেউ ভেঙেচুরে যায়৷ আগাগোড়া৷ আপাদমস্তক৷ কেউ বা আবার হয়তো সাজানো বহিরঙ্গের আড়াল৷ ঘাপটি মেরে অপেক্ষায় থাকা৷ ফাঁদ৷ অনেকেই ফাঁদ চেনে৷ কেউ বা চেনেও না৷ ফাঁদ চিনেও তাতে পা দেবার মানুষ কম৷ বোকামির মধ্যে যে আনন্দ তা পাবার সৌভাগ্য ক’জনের হয়? অনুপের হয়েছিল৷ ভেঙে গেছে তার পর৷ ভাঙা মন টেনে এনেছে এত দূর৷ বোলপুর৷

পাড়ুই পার হল মুসাফির৷ বাসের নামটা অনুপের বড় প্রিয়৷ তার এই জীবনটার মতো৷ শুধুই পথ চলা৷ বৃষ্টির দমক ক্রমেই বেড়ে চলেছে৷ এসব লাল মাটির দেশ৷ ল্যাটেরাইট৷ পিচের রাস্তার পাশের ভেজা মাটি নাছোড় কাদা তৈরি করে রাস্তা পিছল করে তোলে না৷ গাড়ি স্কিড করার ভয় কম৷ তবু মঙ্গল অ্যাক্সিলারেটারে সাবধানী পা রাখে৷ একবার কৃষ্ণনগর থেকে তেহট্ট যাবার পথে রাস্তার কাদায় চাকা পিছলে গিয়ে পাশের কাঁঠাল গাছে সজোরে ধাক্কা মেরেছিল তাদের বাস৷ অনেকের হাত পা ভেঙেছিল৷ মাথা ফেটেছিল কয়েকজনের৷ সেসব পুরনো দিন৷ স্টিয়ারিংয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বের বয়েস কম৷ পেটের টানে অন্য জেলা৷ নদিয়া৷ বছর দেড়েক পর ফিরে এসেছিল নিজের জায়গায়৷ অন্য দিনের তুলনায় আজ এখনই চল্লিশ মিনিট লেট৷ উসখুস করছে যাত্রীরা৷ সব স্থানীয় লোক৷ সোনাঝুরির হাটে যাবার তাড়া নেই কারও৷ বাড়ি ফেরার আছে৷ অনুপের তাড়া নেই৷ রাস্তায় যতটা সময় কেটে যায়, ভালো৷ রাতে ফাঁকা ভাড়াবাড়িতে ফিরে এসে নিঃস্পন্দ একাকিত্ব৷ ঘরময় ভূত-ভূত গন্ধ৷ বাইরে হিলহিলে অন্ধকারের চাদর৷ অনুপের নাগরিক কানে মামদো হুমদোদের কোরাস৷ স্বেচ্ছায় নেওয়া এ নির্বাসন৷ সয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে৷ সিউড়িতে পোস্টিংটা সেধে নিয়েছিল অনুপ৷ নিজের শহরটা যেন গিলে খেতে আসছিল৷ কলকাতা ছেড়ে কেউ জেলায় যেতে চাইলে উপরওয়ালার সম্মতি পেতে অসুবিধে হয় না৷ শান্তিনিকেতনের কাছে প্রান্তিকে থাকার সিদ্ধান্তটা নিতে ভাবতে হয়নি এতটুকু৷ যাতায়াতের পথেই কেটে যায় অনেকটা সময়৷ সপ্তাহের শেষ দিনটা ছুটি৷ কবিগুরুর ছায়া৷ শালবীথি, ছাতিমতলা, শিরীষের সারি… সবাই তাঁর প্রতিভূ যেন৷ গাছেরা কথা বলতে জানলে ইতিহাসে জল মেশানোর সুযোগ পেত না মানুষ৷ শান্তিনিকেতনের ছায়ায় একটা মায়া ভেসে বেড়ায়৷ বড় আরাম৷ আর কোনও মায়ার বাঁধনে জড়াতে চায় না অনুপ৷ বাস এখন ধনাই, বুধুরা ছাড়িয়ে হেদোডাঙা৷ আড়াই মাসেই জায়গাগুলোর নাম মুখস্থ হয়ে গেছে৷

বাস থেকে নামার লোক বিশেষ নেই৷ বেশির ভাগের গন্তব্য বোলপুর৷ ওঠার লোক তো আরও কম৷ এ ভরা বাদল মাথায় নিয়ে কেই বা আর বাড়ি থেকে বার হবে৷ এতক্ষণে একটা খ্যাপা হাওয়া যোগ হয়েছে বৃষ্টির সঙ্গে৷ আঁচল যার উড়ে যাবার ছিল সে পাশে নেই আর৷ সামনে হয়তো বড় দুর্যোগ৷ সহযাত্রীদের টুকটাক কথা কানে আসছে৷ কন্ডাক্টর রাজু ভাড়া নিচ্ছে৷ দু’একজন খিচখিচ করে উঠল৷ ‘পাঁচ টাকা বেশি কেন? যাবার সময় তো ভাড়া কম নিল’৷ রাজু বুঝিয়ে উঠতে পারে না ভাড়া সে ঠিকই চেয়েছে৷ আবহাওয়ার পূর্বাভাসে যথেষ্ট সাবধানবাণী ছিল৷ অনুপ জানতে পারেনি৷ বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে এনেছে৷ নিঃসঙ্গ দ্বীপের মতো এ বেঁচে থাকা৷ উদ্দেশ্যহীন, নির্বান্ধব৷ টেনে হিঁচড়ে পার করে দেওয়া সময়টুকু৷ বাস সরপুকুরডাঙ্গায় ঢোকার ঠিক আগে বৃষ্টির জোরটা একটু কমে এল৷ জোরে চালানোর অনুরোধ ভেসে আসছে যাত্রীদের কাছ থেকে— ‘টেনে চালাও ভাই, আর তো মাত্র চার-পাঁচ কিলোমিটার৷ রাস্তা তো পুরো ফাঁকা’৷ অ্যাক্সিলারেটারে চাপ দেয় মঙ্গল৷ সাঁ-সাঁ দৌড়োয় মুসাফির৷ সরপুকুরডাঙ্গা ছাড়িয়ে অল্প গেলেই শিয়ালা৷ এখান থেকে খঞ্জনপুর হাঁটা পথ৷ বিখ্যাত গ্রাম৷ বোলপুরের অনেক গ্রামের মতোই রবীন্দ্র-অনুষঙ্গ৷ শোনা যায়, দেবেন্দ্রনাথের বজরা এসে ভিড়ত খঞ্জনপুরে কোপাই নদীর ঘাটে৷ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির গেরস্থালি আর বৃদ্ধ বাবার স্নেহ পৌঁছে যেত কবির কাছে৷ এসব গত শতাব্দীর একেবার প্রথম দিককার কথা৷ চার পাঁচজন ছাত্র আর অনেক স্বপ্ন চোখে নিয়ে শান্তিনিকেতনে স্কুল শুরু করেছেন রবীন্দ্রনাথ৷ ছেলেরা বাবার কাছে বড় হয় না কখনও৷ শাশ্বত শৈশব৷ এসব খবর ইতিহাস রাখে না৷ বাড়িওয়ালার জোরাজুরিতে এক রবিবার আসতে হয়েছিল এখানে৷ তাই এসব সবিস্তারে মনে আছে অনুপের৷
গাড়ি ফিফথ গিয়ারে ফেলল মঙ্গল৷ পিছুটানহীন মুসাফির উড়ে চলল, পঙ্খীরাজ৷ হঠাৎ দূরে আবছা একটা অবয়ব৷ যতটুকু দেখা যায় মিশকালো গায়ের রং৷ ধবধবে শনের নুড়ির মতো সাদা চুল উড়ছে বেয়াড়া হাওয়ায়৷ রোগা শরীরে লেপ্টে আছে ভেজা শাড়ি৷ দুহাত নেড়ে মানুষটা থামাতে চাইছে বাসটাকে৷ ধু-ধু বাসস্টপ৷ দ্বিতীয় জনপ্রাণী নেই৷ বাসভর্তি লোক, তবু বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে ওঠে অনুপের৷ অশুভ শক্তির সঙ্গে কালো রং সমার্থক করে নিয়েছে বাঙালি৷ মহিষাসুরের মুখ থেকে সাম্রাজ্যবাদের হাত৷ আবলুশ রং লেপে এসেছে চিরকাল৷ বাঙালি নিখাদ আর্যদের উত্তরাধিকার বয়ে চলে না৷ কালো, সাদা, বেঁটে লম্বা মিলে মিশে এক সঙ্কর জাতি৷ তবু৷ সামনের কাতর হাত নেড়ে বাস থামাতে চাওয়া মহিলাকে তেঁনাদের প্রতিনিধি ভেবে ফেলে এক-বাস মানুষ৷ মঙ্গলের উদ্দেশে নির্দেশের বন্যা বয়ে যায়৷
—কিছুতেই বাস থামাবে না ড্রাইভার৷
—একে ভর সন্ধ্যাবেলা, তাতে শনিবার৷
—নিশ্চয়ই মতলব খারাপ৷ নাহলে এই বৃষ্টির রাতে ফাঁকা বাসস্ট্যান্ডে একা বুড়ি দাঁড়িয়ে থাকে কখনও! ব্রেকে পা দিও না৷ হুশ করে বেরিয়ে যাও৷

মঙ্গলের হাতে স্টিয়ারিং থাকলে সে রাজা৷ নিছক হুকুম তামিল করার পাত্র নয়৷ তাতে বয়স কম৷ তাজা চোখ৷ অনেক দূর থেকে জাসিন্তা হিলিকে ঠিক চিনতে পারে সে৷ কোন ছোটবেলা থেকে সম্পর্ক৷ গ্রামের সুপাই দাদা আর জাসিন্তা হিলির বাপলার সময় মঙ্গলের প্রাইমারি স্কুল৷ তখন জাসিন্তা হিলির গায়ের আর মাথার চুলের রং আলাদা করা যেত না৷ কী ভাব দুজনে৷ কর্মা পুজোর দিন নাচ, গান… একদম মাতিয়ে দিত হিলি৷ পুজোর প্রসাদ খেতে আসা অতিথিদের পা ধুইয়ে, মুছিয়ে দিত৷ শনিবারের খোয়াইয়ের হাটে যেত নাচতে৷ ধামসা, মাদল, কলকাতার বাবুরা… সে এক স্বপ্নের জগত৷ লোকের মুখে কত গল্প শুনেছে মঙ্গল৷ তারপর কী যে হল! কুসবির প্রেমে পড়ল সুপাই দাদা৷ ছেড়ে দিল হিলিকে৷ হিলি নাকি তার কথা শোনে না৷ বাপের বাড়ি বেশি থাকে! সে এক মাঠ লোক! সিং বোঙ্গার দিকে তাকিয়ে এক পায়ে দাঁড়াল সুপাই দাদা৷ ছিঁড়ে ফেলল তিনটে শাল পাতা৷ উলটে ফেলে দিল পিতলের ঘড়ার সব জল৷ খুব কেঁদেছিল হিলি৷ শাল পাতাগুলো ছিঁড়তে গিয়ে থেমে যাচ্ছিল হাত৷ ঘড়ার সবটা জল ফেলে দিতে পারেনি প্রাণে ধরে৷ সুপাই দাদার ফিরে আসার পথটা বন্ধ না হতে দেবার চেষ্টা৷ আজও মঙ্গল চোখ বন্ধ করলে সব দেখতে পায়৷ ফিরে আসেনি দাদা৷ হিলিও আর গ্রামে থাকেনি৷ হারিয়ে গেছিল৷ অনেক দিন কোনও খবর পায়নি মঙ্গল৷ এখন তার বাসেই প্রতি শনিবার সকালে বোলপুর যায়৷ হিলি বুড়ো হয়েছে৷ একাই থাকে৷ মাদলের তালে পা পড়ে না আর৷ নাচের দল থেকে বাদ পড়েছে কবেই৷ বাঁশের ঝুড়ি, ধামা, কুলো বানায়৷ নিজে হাতে৷ শনিবার শনিবার হাটে গিয়ে বিক্রি করে৷ তাতে দিন চলে না৷ তবু…৷

হিলির ঠিক সামনে গিয়ে বাস থামায় মঙ্গল৷ একটা জলজ্যান্ত মানুষ৷ ভুত প্রেত নয়৷ বাসের ভদ্রলোকেদের আওয়াজ বদলে যায়৷
—এত রাতে বৃষ্টির মধ্যে… নির্ঘাত হাঁড়িয়া খেয়েছে৷ বাসে উঠতে দিও না কন্ডাক্টার৷ এখনও অনেকটা পথ৷ গন্ধে টেকা যাবে না কিন্ত্ত৷
কন্ডাক্টার রাজুকে থামায় মঙ্গল৷ উঠে এসে নিজে হাতে দরজা খোলে৷
—এত রাতে কোথায় যাবি হিলি?
—কুথায় আর যাব বাপ?
—তাহলে? শুধু শুধু এভাবে কেউ বাস থামায়?
—যাব বলে তো আসি লাই বাপ৷ তোর মনে লাই?
—কী মনে থাকবে রে? …যাত্রীদের উষ্মা বাড়তে থাকে৷
—সকালবেলা তোর গাড়িতেই তো গেলাম রে৷ আজ শনিবারের হাট ছিল না!
—তাতে কী?
—শরীর খারাপ হয়ে গেলক লাই? মনে লাই তোর?
—কেন সময় নষ্ট করছিস হিলি? সব বোলপুরের প্যাসেঞ্জার৷ একেই গাড়ি এত লেট৷
—সে তো জানিই রে বাপ৷ তাই তো এক ঘণ্টা ধরে দাঁড়াই দাঁড়াই ভিজছি৷
—কেন ভিজছিস? বুখার হবে তো! ঠিক আছে, এবার বাড়ি যা৷
—সব ধামা, ঝুড়ি লক্ষ্মীকে দিয়ে ফিরে আসলাম তো৷ আমার ভুঁড়ি দুখাইছিল না! একটা মালও তো বিক্রি হয় লাই রে বাপ৷
—আচ্ছা হলো, এবার তুই বাড়ি যা৷
—ফিরে আসলাম যে তোদের বাসে? ফেরার ভাড়াটা দিতে পারি লাই তো৷ ট্যাকা ছিল না যে! বিক্রী হয় লাই আজ৷ তুই তো বললি ছয়টার সময় বাস দাঁড়াবে৷ এই সরপুকুরডাঙ্গায়৷ তাই তো আসলাম৷ আবার যাব তো সেই পরের শনিবার৷ হাটের দিন৷ সাত দিন দেরি হয়ে যাবে না? আমার ভাড়ার টাকাটা লিয়ে লে বাপ৷ …আঁচলের গিঁট খুলে চুপচুপে ভেজা একটা দশ টাকার নোট বার করেন বৃদ্ধা৷
বাস জুড়ে একটা অস্বস্তিকর দমবন্ধ নীরবতা৷ অনুপের নাগরিক ভদ্রলোকসুলভ বদ্ধমূল চিন্তা ভাবনারা আছড়ে পড়ে তছনছ হয়ে যায়৷ ওলটপালট হয়ে যায় সৌন্দর্যের মানদণ্ড, মূল্যবোধের সংজ্ঞা, ভালবাসার অর্থ৷ জাসিন্তা বুড়ির কথা যাতায়াতের পথে মঙ্গলের কাছে অনেকবার শুনেছে৷ মঙ্গলের বৌদি হয়৷ মহল্লাতুতো৷ নিজের দিদির বাড়া৷ দেখা হলেই মঙ্গলের কাছে সুপাইয়ের কুশল জানতে চায়৷ বলে, ‘তোর দাদা রাজনগরে আছে রে৷ তুই তো রোজ সিউড়ি যাস৷ লোকটা কেমন আছে একটু জেনে আসিস না রে বাপ৷’
নিজের মনের ভিতরে তাকাবার দৃষ্টি সৃষ্টিকর্তা দেননি মানুষকে৷ সে ঐশ্বর্য অনুপকে দিয়ে যান বৃদ্ধা৷ তাকায় অনুপ৷ অনেক ভালবাসা বেঁচে আছে তার জন্য৷ ভাল আছে তো সে? মনে মনে ক্ষমা করে দেয় তাকে! শহরের চকমকি থেকে অনেক দূরে থাকা একজন মানুষের মন আলো ঢেলে দেয় এক আদ্যন্ত শহুরে মানুষের জীবনবোধে৷
বাস ছেড়ে দিয়েছে অনেকক্ষণ৷ প্রায় কোপাই নদীর ব্রিজ৷ ঝড় থেমে গেছে৷ কেটে গেছে মেঘ৷ হেডলাইটের আলোটা অনেক জোরালো মনে হয়৷ অনেক দূর অব্দি দেখা যায়…৷