দীর্ঘ এক যুগ পর পাকিস্তানের উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক সফরে ফের নতুন মাত্রা পেল ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক। শনিবারই তিন দিনের সফরে ঢাকায় পৌঁছন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী তথা বিদেশমন্ত্রী ইশাক দার। রবিবার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিদেশ উপদেষ্টা মহম্মদ তৌহিদ হাসানের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকে বসেন তিনি। বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ও সমঝোতাপত্র বা মউ স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন দিক উন্মোচন করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
পাঁচটি চুক্তির মধ্যে যা রয়েছে, সেগুলি হল–
১. ভিসা বিলোপ চুক্তি – সরকারি এবং কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা ছাড়ের ব্যবস্থা করা হবে, যাতে সরকারি পর্যায়ের সফর আরও সহজ হয়।
২. বাণিজ্য সম্প্রসারণে যৌথ কমিটি – দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য উন্নয়নের জন্য একটি স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে।
৩. সংস্কৃতি বিনিময় কর্মসূচি – ক্রীড়া, সাহিত্য, শিল্প ও শিক্ষায় যৌথ উদ্যোগ নেওয়া হবে।
৪. শিক্ষা ও গবেষণায় সহযোগিতা – বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যৌথ গবেষণা ও বিনিময় কর্মসূচি চালু করা হবে।
৫. স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা – চিকিৎসা প্রশিক্ষণ, ওষুধ উৎপাদন এবং স্বাস্থ্যসেবায় পারস্পরিক সহায়তার রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে।
জানা গিয়েছে, এই সফরের পর দ্রুত বাস্তবায়িত হবে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলি— এমন প্রত্যাশা করছে দুই দেশই। বিশেষত বাণিজ্য এবং শিক্ষা-গবেষণায় যৌথ কর্মসূচি আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
২০১২ সালের পর এই প্রথম পাকিস্তানের কোনও বিদেশমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এলেন। পূর্বে হিনা রব্বানি খারের সফর ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার। সেই থেকে শুরু হওয়া কূটনৈতিক প্রতিবন্ধকতা ভাঙতে এই সফরকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনার আমলে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক কার্যত ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দুই দেশের মধ্যে ফের ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ সফর করেন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নকভি এবং বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান।
বৈঠক শেষে সংবাদমাধ্যমে ইশাক দার বলেন, “১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের তিনটি অমীমাংসিত ইস্যু বহু আগেই নিষ্পত্তি হয়েছে। ১৯৭৪ সালে প্রথম চুক্তির মাধ্যমে সমাধান হয়েছিল। আর একবার জেনারেল পারভেজ মোশারফ ঢাকায় এসে খোলাখুলি বিষয়টি মীমাংসা করেন। আজ সেই ইতিহাস পেরিয়ে দুই দেশ এগোচ্ছে নতুন অধ্যায়ে।”
বাংলাদেশের কূটনৈতিক মহল অবশ্য বিষয়টি নিয়ে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, ১৯৭১-এর সংবেদনশীল অধ্যায় পুরোপুরি মুছে না গেলেও এই সফরের মাধ্যমে সহযোগিতার বার্তা দেওয়া হয়েছে।
রবিবার বিকেলে পাকিস্তানি বিদেশমন্ত্রী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন। রাজনৈতিক মহলের জল্পনা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়েও আলোচনা হয় সেই বৈঠকে। এছাড়া সন্ধ্যায় গুলশনে বিএনপি নেত্রী এবং বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গেও সাক্ষাত করেন ইশাক দার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সফর শুধুমাত্র সৌজন্য সাক্ষাৎ নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক কূটনীতিতে নতুন ভারসাম্য তৈরির ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশেষত বাণিজ্য সম্প্রসারণ, ভিসা নীতি শিথিলকরণ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় দুই দেশের সম্পর্ককে উন্নত করবে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের জন্য পাকিস্তানের বাজারে নতুন রপ্তানি সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
অন্যদিকে, পাকিস্তানও বাংলাদেশের উৎপাদন খাত থেকে সুবিধা নিতে পারবে। কূটনৈতিক মহল মনে করছে, এই সফর শুধু অতীতের দূরত্ব মেটানো নয়, বরং নতুন যুগে পারস্পরিক সহযোগিতার পথ খুলে দেবে, যা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক সমীকরণেও নতুন করে প্রভাব ফেলতে পারে।