চব্বিশের ছবি আবারও ফিরে এল পদ্মাপারে। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই জ্বলছে বাংলাদেশের একাধিক এলাকা। পাথর ও আগুন নিয়ে দুষ্কৃতীরা হামলা চালায় কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের দপ্তরে। সেই হামলার রেশ কাটতে না কাটতেই খুলনায় গুলি করে খুন করা হয় এক সাংবাদিককে। নিহতের নাম ইমদাদ উল হক মিলন। ইমদাদ উল হক মিলন ‘বর্তমান সময়’ নামে একটি দৈনিকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাশাপাশি তিনি স্থানীয় একটি প্রেস ক্লাবের সভাপতির দায়িত্বও সামলাতেন। ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন দেবাশিস নামে এক হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক।
বৃহস্পতিবার রাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশের দুই জনপ্রিয় সংবাদপত্র ‘প্রথম আলো’ ও ‘ডেলি স্টার’-এর দপ্তর। ভিতরে আটকে পড়েন সাংবাদিকেরা। ইংরেজি দৈনিক ‘ডেলি স্টার’-এর প্রধান দপ্তরে অগ্নিসংযোগ জেরে ভিতরে আটকে পড়েন অন্তত ৩০ জন সাংবাদিক। প্রাণ বাঁচাতে সকলে বহুতলের ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছোয় দমকল। আগুন নেভানোর পর ক্রেন এনে আটকে পড়া সাংবাদিকদের নামানো হয়। সেই ঘটনার বিভিন্ন ভিডিও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে । তাতে দেখা যাচ্ছে, অগ্নিদগ্ধ বহুতলের সামনে বিশাল ক্রেন আনা হয়েছে। তার সাহায্যে ধীরে ধীরে নামানো হচ্ছে সাংবাদিকদের।
এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় অবস্থিত ওই দৈনিকের কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়। ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বহুতলে। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার কারওয়ান বাজারে ‘প্রথম আলো’-র অফিসেও। ভিতরে ঢুকে তছনছ করা হয় কাগজপত্র, কম্পিউটার। ‘ডেলি স্টার’-এর এক মহিলা সাংবাদিক জাইমা ইসলাম সমাজমাধ্যমে ভাঙচুরের বিষয়ে পোস্ট করে জানান।
তিনি লেখেন, ‘আমি ঠিক করে শ্বাস নিতে পারছি না। এখানে খুব বেশি ধোঁয়া। আমি ভিতরে রয়েছি। আপনারা আমাকে হত্যা করছেন।‘ রাত ২টো নাগাদ আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে সব সাংবাদিককে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়। শুক্রবার দুই সংবাদপত্রের কোনও মুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়নি। নিরাপত্তাজনিত কারণে শুক্রবার বেশির ভাগ সাংবাদিককে ছুটি দেওয়া হয়েছে।
সংবাদপত্রের দপ্তরে হামলার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান বাংলাদেশের ইংরেজি সংবাদপত্র ‘নিউ এজ’-এর সম্পাদক নুরুল কবির। তাঁকে হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে। চুলের মুঠি ধরে বেধড়ক মারধর করা হয় তাঁকে। সেই ঘটনারও একাধিক ভিডিও সমাজমাধ্যমে ঘুরছে। যার সত্যতা যাচাই করেনি দৈনিক স্টেটসম্যান।
এই অশান্তির মধ্যেই ময়মনসিংহ একটি নৃশংস ঘটনার অভিযোগ সামনে এসেছে। উত্তেজিত জনতা এক হিন্দু যুবককে পিটিয়ে ও পরে আগুন ধরিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ। নিহতের নাম দীপুচাঁদ দাস। পেশায় তিনি কারখানার শ্রমিক ছিলেন। প্রথমে বেধড়ক মারধর, তার পর জীবন্ত পুড়িয়ে মারার অভিযোগে শিউরে উঠেছে। শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূস। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেও জানান তিনি।
শুক্রবার সকালেও থামেনি সেই অশান্তি। ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। সকাল থেকে নতুন করে কোথাও ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা না ঘটলেও বিক্ষিপ্ত ভাবে বিক্ষোভ চলছেই। শাহবাগ চত্বরে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন বহু মানুষ। ঢাকায় সংবাদপত্র ‘দ্য ডেলি স্টার’-এর পুড়ে যাওয়া দপ্তরের সামনেও অনেকে জড়ো হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
শুক্রবার সকাল থেকে শাহবাগ-সহ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে যানচলাচল বন্ধ করে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গুলশানে বিভিন্ন দূতাবাসের আশপাশেও পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত। অশান্তি সামাল দিতে শহরে বহু পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদ জানাতে বেলা ১১টার পর ডেলি স্টার-এর দপ্তরের সামনে জড়ো হন একদল ছাত্রযুবক। তাঁদের ঘিরে কয়েক জন ব্যক্তি পাল্টা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। বেলা পর্যন্ত বাইরে দেখা গিয়েছে পুলিশ ও র্যাবের প্রহরা।
শুক্রবার সকালে শাহবাগে মোড়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে মিছিল করে স্লোগান দিতে দেখা যায় একদল বিক্ষোভকারীকে। সকলেরই দাবি, হাদি হত্যার বিচার চাই। একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিক্ষোভকারীরা বেশির ভাগই কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। জনরোষের সুযোগ নিয়ে যাতে কেউ কোথাও ভাঙচুর বা নাশকতামূলক কাজ না করতে পারে, সে নিয়েও জনগণকে সতর্ক থাকার বার্তা দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার জনপ্রিয় দৈনিক দুটের ওপর হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতের জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি গৌতম লাহিড়ী। তিনি বলেছেন সংবাদ মাধ্যমের ওপর এই ধরনের হামলা বরদাস্ত করা কঠিন। আমি আশা করি বাংলাদেশ সরকার এই ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ করবে।
এই পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারতের বিদেশমন্ত্রক।বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি নিয়ে চরমপন্থীদের ভুয়ো দাবি ভারত প্রত্যাখ্যান করছে। একই সঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করে জানানো হয়েছে, এখনও পর্যন্ত এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করেনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। এমনকী ভারত সরকারের সঙ্গে কোনও তথ্যপ্রমাণও ভাগ করে নেওয়া হয়নি বলেই দাবি করেছে বিদেশমন্ত্রক।