তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের পরই জামাতের দিকে ঝোঁক এনসিপির?

ফাইল চিত্র

ঢাকা, ২৬ ডিসেম্বর— তারেক রহমানের দেশে ফেরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে যে ঢেউ তুলেছে, তার অভিঘাত সবচেয়ে বেশি টের পাওয়া যাচ্ছে সদ্য গঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টির অন্দরে। ১৭ বছরের স্বেচ্ছানির্বাসন কাটিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের প্রত্যাবর্তনের ঠিক পরেই জুলাই আন্দোলনের ছাত্র-যুব নেতৃত্বাধীন এনসিপি এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির মধ্যে আসন সমঝোতার আলোচনা শুরু হওয়ায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে এনসিপির রাজনৈতিক অবস্থান ও আদর্শগত নীতি।

এই সমঝোতার খবরে এনসিপির ভিতরেই শুরু হয়েছে অস্বস্তি। দলের একাংশ প্রকাশ্যে আপত্তি তুলেছেন জামাতের সঙ্গে হাত মেলানো নিয়ে। ইতিমধ্যেই এক কেন্দ্রীয় নেতা দল ছাড়ার ঘোষণা করে দাবি করেছেন, নেতৃত্ব ভুল পথে হাঁটছে। দলীয় সূত্রের খবর, এই ইস্যুতে আরও কয়েকজন নেতা পদত্যাগ করতে পারেন বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে যে দলটি জুলাই আন্দোলনের পর ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’-এর স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সেই দলই এখন সবচেয়ে বড় আদর্শগত সংকটে ভুগছে।

জুলাই আন্দোলনের সময় এনসিপির স্পষ্ট বক্তব্য ছিল— তারা পুরনো রাজনীতির বাইরে গিয়ে বিকল্প শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার আত্মবিশ্বাস তখন তাদের কণ্ঠে স্পষ্ট ছিল। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সমীকরণের বাস্তব চিত্র বদলাতে শুরু করে। রাজনৈতিক মহলের মতে, এনসিপি বুঝে গিয়েছে, একক শক্তি নিয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছনো প্রায় অসম্ভব। সেই উপলব্ধি থেকেই জোট রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছে দলটিকে।


প্রথমে বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতার চেষ্টা হলেও তা ভেস্তে যায়। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের পর বিএনপি যে আরও সংগঠিত ও আক্রমণাত্মক হবে, সেই বার্তাও এনসিপির কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে বিএনপিকে টক্কর দিতে জামাতের সঙ্গে সমঝোতাই আপাতত সবচেয়ে কার্যকর পথ বলে মনে করছেন এনসিপির নেতৃত্বের একাংশ।

তবে এই সিদ্ধান্ত ঘিরেই সবচেয়ে বেশি বিতর্ক দানা বেঁধেছে। এনসিপি’র বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, তারা জুলাই আন্দোলনের সময় যে আদর্শগত রাজনীতির কথা বলেছিল, এখন সেখান থেকে সরে আসছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এনসিপির বর্তমান কৌশল আদর্শের চেয়ে ক্ষমতার অঙ্ককে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা ব্যর্থ হওয়ার পর জামাতকে বেছে নেওয়াকে অনেকেই রাজনৈতিক সুবিধাবাদের উদাহরণ হিসেবে দেখছেন।

এনসিপি নেতারা অবশ্য প্রকাশ্যে দাবি করছেন, জামাতের সঙ্গে চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তাঁদের বক্তব্য, একাধিক দলের সঙ্গেই আলোচনা চলছে। তবে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে জামাতের সঙ্গে অবস্থানগত মিল রয়েছে— এ কথাও তারা অস্বীকার করছেন না। এই মিলের ভিত্তিতেই আলোচনা এগোচ্ছে বলে দাবি করা হচ্ছে। যদিও দলের ভিতরেই এই ব্যাখ্যা মানতে নারাজ অনেকে।

অতীতে এনসিপি ও জামাতের সম্পর্কে যথেষ্ট টানাপোড়েন ছিল। গত বছরের ৫ অগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর কিছু ইস্যুতে দুই দলের অবস্থান কাছাকাছি এলেও, জুলাই সনদে সই করা নিয়ে বড় মতভেদ তৈরি হয়। এনসিপির একাংশ তখন প্রকাশ্যেই জামাতের সমালোচনা করেছিল। সেই কারণেই এখন ফের জামাতের দিকে ঝোঁকা এনসিপির রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের পর বিএনপির উত্থান আটকাতে দ্রুত শক্তিশালী জোট গড়া ছাড়া এনসিপির সামনে আর কোনও বিকল্প নেই। একই সঙ্গে জামাতও জানে, এনসিপির সঙ্গে জোট করলে আসন পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। এই পারস্পরিক স্বার্থই দুই দলকে কাছাকাছি আনছে।

তবে এনসিপির অতীত বক্তব্যই এখন তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। চলতি বছরের ১০ ডিসেম্বর ১২৫ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, ক্ষমতার জন্য নয়, রাজনীতির চরিত্র বদলাতেই তারা ভোটে নামছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান জোট-চেষ্টার সঙ্গে সেই বক্তব্যের ফারাকই এনসিপির সবচেয়ে বড় সংকট।

জুলাই আন্দোলনের পর যে ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’-এর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার স্পষ্ট রূপরেখা এখনও সাধারণ মানুষের সামনে আনতে পারেনি এনসিপি। তার উপর জামাতের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা অনেকের চোখে সেই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলেই ধরা পড়ছে। এই দ্বন্দ্বের রাজনীতিতেই এখন এনসিপির ভবিষ্যৎ যথেষ্ট দোলাচলে রয়েছে।