নির্বাসন পর্ব শেষ। পাক্কা ১৭ বছর পর দেশে প্রত্যাবর্তন। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৩৯ মিনিটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী জুবাইদা এবং কন্যা জাইমা। বিমানবন্দরে তারেক এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের স্বাগত জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, মির্জা আব্বাস প্রমুখ। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। তার আগে তারেকের প্রত্যাবর্তনে উজ্জীবিত খালেদা জিয়ার দল বিএনপি।
বিমানবন্দরে নেমেই তিনি প্রথমে যান একটি ফুলের বাগানের দিকে। বুট খুলে কিছুক্ষণ দাঁড়ান সেই বাগানে। হাতে তুলে নেন একমুঠো মাটি। দীর্ঘদিন পর স্পর্শ করেন দেশের মাটি। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস উপলক্ষে ব্রিটেনে বিএনপির এক আলোচনাসভায় তারেক জানিয়েছিলেন, ২৫ ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশে ফিরবেন। সেই মতো বুধবার সন্ধ্যায় লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিমান ধরেন তিনি। বিমান থেকেই সমাজমাধ্যমে একাধিক পোস্টও করেন খালেদা পুত্র। একটি পোস্টে নিজের ছবি দিয়ে লেখেন ‘ফেরা’। আরও একটি ছবি পোস্ট করে তাতে লেখেন, ‘দীর্ঘ ৬ হাজার ৩১৪ দিন পর বাংলাদেশের আকাশে।‘
বুধবারই তারেকের তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়ার পাশাপাশি ওসমান হাদির সমাধিস্থলেও যাওয়ার কথা রয়েছে তারেকের। শুক্রবার পিতা তথা বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সমাধি এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করবেন তারেক। শনিবার হাদির সমাধিস্থলে যাওয়ার পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনে আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যাবেন তিনি। ওই দিনই তাঁর ভোটার হিসাবে আবেদন করার জন্য বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের দপ্তরে যাওয়ার কথা।
উল্লেখ্য, ২০০৭–এর ওয়ান-ইলেভেনের তদারকি সরকারের আমলে দুর্নীতির নানা অভিযোগে দেড় বছরের মতো আটক থাকতে হয়েছিল তারেক রহমানকে। সূত্রের খবর, ২০০৮-এর অক্টোবরে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে তিনি তৎকালীন সেনা সরকারকে একটি মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পেয়েছিলেন। তার পরে সপরিবারে ব্রিটেনে আশ্রয় নেন খালেদা-পুত্র। সেখানে গিয়ে ফের বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে দেশের বাইরে থেকেই দল চালিয়েছেন তিনি। এতদিন পর বিএনপি-র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়াকে স্বাগত জানাতে ঢাকার রাস্তায় মানুষের ঢল দেখা যায়।
এদিন দেশে ফিরেই ফোন করেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে। সূত্রের খবর অনুসারে, পরিবারের সদস্য এবং দলীয় নেতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পরেই তারেক ফোন করেন ইউনূসকে। সূত্র অনুসারে, খালেদা-পুত্র ফোনে প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁর দেশে প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইউনূসকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এর আগে গত ১৭ জুন লন্ডন সফরে গিয়ে তারেকের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন ইউনূস।
বিকেলে গণসংবর্ধনা মঞ্চ থেকে ‘স্বপ্নে দেখা বাংলাদেশ’ গড়ার ডাক দেন খালেদা পুত্র। রাজধানী ঢাকার পূর্বাচলে জুলাই ৩৬ এক্সপ্রেসওয়েতে আয়োজিত গণসংবর্ধনায় তারেক বলেন, ‘এমন বাংলাদেশ গড়ে তুলব, যা স্বপ্ন দেখেছি।’ তিনি তাঁর স্বপ্নের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন আমেরিকার বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের প্রয়াত নেতা মার্টিন লুথার কিং এবং সদ্যনিহত জুলাই আন্দোলনের মুখ শফিক ওসমান হাদির। লুথারের সেই বিখ্যাত বক্তৃতা ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে করে তারেক বলেন, ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান। দেশের মানুষের জন্য, দেশের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য আমার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে।’
পরিকল্পনা সফল করার জন্য তারেক আর্জি জানিয়ে বলেছেন, ‘শহিদ ওসমান হাদির প্রত্যাশার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সকলকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওসমান হাদি চেয়েছিলেন এই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক। তিনি চেয়েছিলেন, এই দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক। এই দেশের মানুষ নিজেদের গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক অধিকার ফিরে পাক। ওসমান হাদি-সহ এই আন্দোলনে যাঁরা শহিদ হয়েছেন, এই মানুষগুলির রক্তের ঋণ যদি শোধ করতে হয় তবে আসুন আমরা আমাদের সেই প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
যেখানে আমরা সকলে মিলে কাজ করব। যেখানে আমরা সকলে মিলে প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তুলব।’ বাংলাদেশ মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-হিন্দু-সহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস বলে তারেক আজকের বক্তৃতায় জানান। সকলকে নিয়ে বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জানান তিনি। একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেন খালেদা পুত্র তারেক। হাদির মৃত্যু ঘিরে বাংলাদেশ জুড়ে অশান্তির আবহে তারেকের এই ‘নিরাপদ’-বার্তা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মহল।