কেনিয়া সফর

এবারের গন্তব্য এক টুকরো আফ্রিকার কেনিয়া। যাবার আগেই দ্বিগুণ উৎসাহে ইন্টারনেট ঘাঁটা শুরু করলাম। একটু বিস্মিতই হলাম৷ জানলাম, কেনিয়া অত্যন্ত শুষ্ক, গাছহীন দেশ। কিছু অংশে বন জঙ্গল, যেখানে পশুপাখির রাজত্ব। খুব বড় আকারের জলাভূমি নেই বললেই চলে। পশ্চিমে আছে লেক ভিক্টোরিয়া আর দক্ষিণে লেক তুরানা। কেনিয়া পূর্ব আফ্রিকায় অবস্থিত। বেশিরভাগ কেনিয়ার উচ্চভূমিতে বাস করে। রাজধানী নাইরোবি ৫হাজার ৫০০ ফুট উঁচুতে। ৬০টির বেশি ভাষা আছে, ৪০টির বেশী জাতিগোষ্ঠী, ভাষা আফ্রিকান। কেনিয়ার নিম্নভূমিতে সবাই সাভানাগুলিতে ফোকাস করে। কিন্তু কেনিয়ার বাস্তুতন্ত্রে মরুভূমি, জলাভূমি, পর্বত এবং বন আছে। কেনিয়ার উচ্চভূমির বন অনেক প্রাণীর বসবাসের স্থান যা পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে দেখা মেলে না। কেনিয়া একটি খরা ও দুর্ভিক্ষের দেশও বটে। সংবিধানে ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা আছে। চার-পঞ্চমাংশেরও বেশি মানুষ খ্রিস্টান। মুসলিমরা একটি বিশাল সংখ্যালঘু এবং সুন্নি এবং শিয়া, দুই গোষ্ঠীই বিদ্যমান। ইহুদি, জৈন, শিখ এবং বাহাইদের ক্ষুদ্র জনসংখ্যা রয়েছে। কেনিয়ার অর্থনীতিতে কৃষিই প্রধান। এখানে হাজার হাজার বড় খামার এবং গাছপালা রয়েছে। বনভূমি একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধান ভাঙতে শিবের গীত হল।

গত বছর ৭ অক্টোবর একরাশ প্রত্যাশা নিয়ে কলকাতা-মুম্বই ফ্লাইটে দমদম এয়ারপোর্ট থেকে চারটের সময় রওনা হয়ে সকলে সাড়ে ৬টায় সন্ধ্যাবেলা মুম্বই পৌঁছলাম। মুম্বইয়ে সিকিউরিটি চেক করে অভিভাসন দপ্তরে সাড়ে ১০টায় গেলাম। কারণ ফ্লাইট ছাড়ার চার ঘন্টা আগে এটা করা যায়। সব সেরে রাত ২.২০-তে ফ্লাইটে চড়ে বসলাম। ফ্লাইটে খাবার দিল। রাতে ঘুম এল না। কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে ভোর সাড়ে ৫টায় পৌঁছলাম। কেনিয়ার সঙ্গে ভারতের সময়ের পার্থক্য আড়াই ঘন্টা। বিমানবন্দর থেকে বেরোতেই ওখানকার ট্রাভেল থেকে অভ্যর্থনা জানাল। ওখানে নেমে আবহাওয়া দারুণ পেলাম। কলকাতা থেকে জানতাম গরমই হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বেশ মনোরম আবহাওয়া, ২৩ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হবে। রাস্তার দু’ধারে কিছু অফিস। একটু পরেই প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতে Aberdare-এ পৌঁছে গেলাম। সাজানো গোছানো সুন্দর পরিকল্পিত শহর নাইরোবি। ঝকঝকে রাস্তার দু’ধারে ফুল ঢাকা গাছ। সুন্দর দালানকোঠা স্থাপত্য। তবে যানজট বিদ্যমান। রাস্তার পাশে দারিদ্র্যের ছবিও দেখলাম। দু’ধারে ছিন্নমূল মানুষ। Aberdare Country Club-এর হোটেলে উঠে চোখ জুড়িয়ে গেল। চাইলেই হোটেল কর্তৃপক্ষ এখানেও আধুনিক বহুতল ভবন গড়ে তুলতে পারেন। কিন্তু তা করেননি। বরং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। হোটেলে ঢুকতেই ওরা আপেল জুস দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল।

হোটেলের মধ্যেই এক টুকরো অরণ্য খুঁজে পেলাম। হোটেলের চারপাশে হরিণ, সম্বর, বুনো শুয়োর, জেব্রা চরে বেড়াচ্ছে যা দেখে মুগ্ধ হতে হয়। দুপুরের খাবার সেরে বিকেলে পায়ে হেঁটে জঙ্গল ঘুরে এলাম। ইচ্ছে হলে ঘোড়ায় চড়েও দেখতে যেতে পারেন। তার জন্য বাড়তি কেনিয়ান সিলিং দিতে হবে। কেনিয়ার মানুষকে মনে হল খুব হাসিখুশি, বন্ধুত্বপূর্ণ। সারাক্ষণ তাদের মুখে হাসি। Hallow অর্থাৎ দেখা হলেই ‘জাম্বো’ কথাটি বলেন। ঘুরে এসে চা-কফি খেলাম। কফি খুব উন্নত মানের। রাতের খাবার সেরে নিশ্চ্ছিদ্র ঘুম। পরের দিন সকালে প্রাত:রাশ করে সাড়ে ৮টায় সরকারি গাড়ি করে ‘নাইভাসা’ লেকের উদ্দেশ্যে বেরোলাম। এটা নাকি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম Fresh Water Lake৷ পৌঁছলাম নাইভাসাতে। বেশ মনোরম আবহাওয়া। সাড়ে তিন ঘণ্টার মত সময় লাগল। নেমেই চোখ জুড়িয়ে গেল। নাইভাসা Country Club-এর প্রবেশপথে বড় বড় গাছ। সামনে প্রশস্ত লন। তাতে চেয়ার টেবিল পাতা। তারপরেই জলভর্তি লেক নাইভাসা। হোটেলে ঢোকার পথে অজস্র জেব্রা, হরিণ, সম্বর। মনে হল এখানে গ্রামবাসীরা এই পশুগুলো পোষে।


এরা আমের জুস দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল। এখানে ভয়ঙ্কর অথচ মজার সতর্কীবার্তা লেখা আছে। অন্ধকার হয়ে গেলে একা একা লনে ঘোরা যাবে না। পেটে ছুঁচো ডন মারছে। ব্যাগপত্তর ঘরে রেখে খাবার খেয়ে নিলাম। এই সুযোগে বলে নিই কেনিয়ার মানুষের প্রধান খাবার কিন্তু ভাত। সঙ্গে সিদ্ধ সবজী, মাছ, বিভিন্ন রকমের মাংস, ছাগল, মুরগি, গরু, শুয়োর থাকে। এছাড়া প্রচুর ফল। ওরাই কেটে দেবে, নিতে হবে। সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের কেক জাতীয় খাবার। নাইভাসা লেক হোটেলের সঙ্গেই লাগানো। বিকেল সাড়ে ৪টের সময় হাঁটতে হাঁটতে লেকের দিকে এগোতেই একটা শব্দ শুনতে পেয়ে এগোতে লাগলাম। অবাক হলাম গোটা দশেক জলহস্তী লেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেশ কিছু ছবিও তুলে নিলাম। বুঝলাম লেকের জলে প্রচুর জলহস্তীর বাস। তারা রাতের অন্ধকারে হোটেলের লনে পায়চারি করতে আসে। ফিরে এসে কফি খেলাম। আসলে সারাদিন জলে থেকে ক্লান্ত হয়ে রাতের বেলা লনে আসে, ঘাস খায়। বিরক্ত করলে তেড়ে আসে।

এখানে নিরাপত্তারক্ষীরা থাকে যাতে কোনও বিপদ না ঘটে। ওরা মন ভরে সবুজ ঘাস খেতে লাগল। আমরাও ছবি তুলতে থাকলাম। নাইভাসা লেকের গায়ে পাহাড়ের ওপারে সূর্যাস্ত হল। সেই মায়াবী আলো দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে সকলে স্নান করে প্রাতঃরাশ সেরে ৮টা ৪৫ মিনিটে রওনা হলাম নাইভাসা ক্রিসেন্ট দ্বীপে যাওয়ার জন্য। গাড়ি থেকে নেমে উঠে বসলাম বোটে। যাবার পথেই বিভিন্ন অজানা পাখি। তাদের আওয়াজ, জলে প্রচুর জলহস্তী। ক্রিসেন্ট আইল্যান্ড নাইভাসার সেরা জায়গা।

পুরো আইল্যান্ড গাইডের সঙ্গে ঘোরা শুরু হল। প্রচুর পেলিকান জলের ধারে। প্রথমেই জোড়ায় অস্ট্রিচ (উটপাখি) দেখলাম। গাইড একে একে বিভিন্ন ধরনের পাখি দেখাতে থাকল। দেখলাম জেব্রা, হরিণ, জিরাফ ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে। বুনো শুয়োর, ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে দেখলাম। ফেরার পথে মিউজিয়ামে রাখা বিভিন্ন প্রাণীর কঙ্কাল দেখলাম। জানলাম এই দ্বীপটি প্রাইভেট। ফিরে ​খাবার সেরে আবার সাড়ে ৩টে নাগাদ বেরোলাম। Hell’s Gate National Park. এই উদ্যানটি নাইভাসা লেকের কাছে অবস্থিত একটি জাতীয় উদ্যান। গাড়ির হুড খুলে দেখতে দেখতে যাবার পথেই প্রচুর হরিণ, সম্বর, ইমপালা দেখলাম। বন্যপ্রাণী মহিষ, প্রচুর জেব্রা, অনেক জিরাফ, বেশ কিছু বুনো শুয়োর। হরিণের পাল গাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা পার হল দৌড়ে দৌড়ে।

বুনো শুয়োরের দল এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়লে ড্রাইভার গাড়ি থামালে ওরা রাস্তা পার হল। এখানে বুনো কুকুরদের উপস্থিতি দেখলাম। তবে রাস্তাঘাটে সাধারণ কুকুরের দেখা মেলে না। সন্ধ্যে সাড়ে ৬টায় ফিরে কুকিজ, কফি খেয়ে হোটেল ঘরে কাটালাম।

আগামীকাল সকালে গন্তব্য বহু প্রত্যাশিত, আকাঙ্ক্ষিত মাসাইমারার জঙ্গল। সকাল ৮টায় বেরোনোর কথা, আমিও খুব উত্তেজিত। রওনা হলাম প্রাতঃরাশ সেরে। ঘণ্টা কয়েক বাদে পৌঁছানোর ফাঁকে একবার মিনিট কুড়ির জন্য চা-পানের বিরতি ছিল। সেখানেও ব্ল্যাক কফি খেলাম। এসে হাজির হলাম Country Club-এর হোটেলে। ওরা আপেল জুস দিল প্রবেশ পথেই। এর প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোরম এবং হোটেলটি open forest-এর মধ্যেই অর্থাৎ চারদিক খোলা। যে কোনও সময়ে বন্যপ্রাণী চলে আসতে পারে হোটেল চত্বরে। রাতে নিরাপত্তারক্ষীকে জানিয়ে তবেই সন্ধ্যার পর বেরোনো যায়। ফোন করলেই ওরা রক্ষী পাঠিয়ে দেয়, আবার রুমেও দিয়ে যায়। হোটেল জুড়ে মাসাই সংস্কৃতির স্বাক্ষর। লাঞ্চ করে খানিক বিশ্রাম। গাড়ির ধকল না থাকলেও ৪ ঘণ্টা সময়ের ধকল ছিল। দুপুরে সাফারি গাড়ি করে গেলাম। ভয়ানক সুন্দর এই মাসাইমারা।

মাসাইমারা কেনিয়ার একটি সবচেয়ে বড় সাফারি। শুধু কেনিয়ায় নয়, বিশ্বের বৃহত্তম সাফারি। আজ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। সাফারি করতে করতে অনেক পশুপাখি দেখতে পেলাম। হাজার হাজার বুনো মহিষ, কত হরিণ, বলে শেষ করা যাবে না। এছাড়া প্রচুর জেব্রা, ঈগল পাখি, দাঁতাল বুনো শুয়োর, ওয়াইল্ড বিস্ট। এরপর বনের রাজা সিংহের সাথে দেখা হল। রাজার মতই পুরো পরিবার নিয়ে দিবানিদ্রা দিচ্ছিল। খুব কাছেই গাড়ি নিয়ে গেল। মন ভরে দেখলাম। চোখ জুড়িয়ে গেল। ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। তেমনই ভীষণ ভাল লাগা কাজ করছিল। আজ জীবন সার্থক হল গ্রেট আফ্রিকান সিংহ দেখে। আবার কিছু সময় পরে আর একটি গাছের নীচে তিনটি সিংহ দেখলাম। এরপর আরও অবাক করা দৃশ্য। সদ্য হরিণ খেয়ে একটি লেপার্ড দেহাংশ নিয়ে দ্রুত গাছের ডালে উঠল। এরপর যেন pose দিচ্ছে এমনভাবে পা দোলাচ্ছিল।

ফেরার পথে গাছে পাখি, হায়নার চলাফেরা দেখতে দেখতে ফিরে এলাম। আগামীকাল সকালে আবার মাসাইমারা জঙ্গল সাফারী হবে। হোটেলে ফিরে এসে হোটেলের পিছনে একটি Hippo বার আছে যেখানে জলে প্রায় ৪০-৫০টি জলহস্তী ভেসে বেড়াচ্ছে, সেখানে গেলাম। রাতে ডিনার করে শুয়ে পড়লাম। এখানে জঙ্গল সাফারিকে এরা game view বলে অর্থাৎ তুমি তাকে দেখতে পেলে তুমি জিতলে, না পেলে সে জিতল।

পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম ভোরটা সত্যি দারুণ চমৎকার। চোখের সামনে ধীরে ধীরে সূর্য উঠল। চমৎকার অনুভূতি। সাফারির শুরুতেই অনেক পশু দেখলাম। সকালেই পৃথিবীর দ্রুততম প্রাণী সদলবলে ৫টি চিতা শিকারে যাচ্ছে দেখলাম। আর সেই open forest-এ ওরা এগোচ্ছে দেখে জেব্রা, হরিণ পিছোচ্ছে। জিরাফ, হাতি, বুনো মোষ খুব কাছ থেকে দেখলাম আবার। ফিরে প্রাতঃরাশ করে স্নান করলাম। এখন যাব মাসাইদের গ্রামে। মাসাইমারা শুধু বন্যপ্রাণীর জন্যই নয়, মাসাই সম্প্রদায়ের জন্যও বিখ্যাত। গাড়ি করে সাড়ে ১০টা নাগাদ রওনা হলাম। দেখলাম এখনও অনেকটাই যাযাবর জীবন বজায় রেখেছে। মাসাইরা তাদের স্বতন্ত্র পোশাক, পুঁতির গয়না, ভূমি ও বন্যপ্রাণীর সঙ্গে তাদের সম্পর্কের জন্য পরিচিত। ওরা কাঠে কাঠ ঘষে আগুন জ্বালানো দেখাল। ওদের নাচ, আমিও নাচলাম। ওরা আজও একাধিক বিবাহ করে। প্রথম স্ত্রী দ্বিতীয় বিবাহ দেওয়ার অধিকারী। তবে বিয়ে কম হয়। কারণ ছেলেকে মেয়ের বাবাকে ১৬টি গরু দিলেই বিবাহ সম্ভব। অনেকাংশ কমলেও এখনও এঁরা কেউ কেউ গরুর রক্ত পান করেন। অধুনা নদীর কাছে ইংলিশ মিডিয়ম বিদ্যালয় তৈরি হয়েছে। এরাও ক্রমশ আধুনিক হচ্ছে। হয়ত একদিন হারিয়েও যাবে। এরপর ফিরে এসে game view-এ বেরোলাম।

এবার কিছুটা যাওয়ার পর যখন আশা-নিরাশায় দুলছি তখনই ৬টি গ্রেট আফ্রিকান সিংহ দেখলাম। এছাড়া আগের দেখা প্রাণীগুলো তো আছেই। তবে হ্যাঁ, সব প্রাণী দেখতে পেলেও আফশোস রইল, গণ্ডারের দেখা পেলাম না। এসে সন্ধ্যায় কড়া ব্ল্যাক কফি নিলাম। রাতে ডিনার করে শুয়ে রইলাম। কাল সকালে নাইরোবি ফিরে যাওয়া। সকালে প্রাতঃরাশ করে নাইরোবির উদ্দেশ্যে বেরোলাম। মাঝে গাড়ি থামিয়ে কফি। মাঝে দেখলাম raft valley৷ চোখ জুড়িয়ে দিল। সন্ধ্যার মুখে নাইরোবি বিমানবন্দরের কাছে Point Four হোটেলে রাত কাটল। ভোর ৬টা ৪০-এ ফ্লাইট৷ ৩টের সময় উঠে প্রাতঃরাশ প্যাক করে বিমান ধরার জন্য রওনা হলাম। আমার মনে হল এটা life time achievement৷