নন্দিতা মিত্র
কন্যাকুমারীর পথে যত এগোনো যায়, রাস্তার দু’ধারে নারকেল গাছের সারি, বাতাসে হালকা নোনা গন্ধ, সমুদ্রের গর্জন সব মিলিয়ে সকালটা যেন নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কবিতার পাতার মতোই একের পর এক খুলে যাচ্ছিল। নীলরঙা সমুদ্রের ব্যাকগ্রাউন্ডের মধ্যে দিয়ে সিঁদুরের টিপের মতো ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছেন সূর্যদেব তাঁর রঙের বৈভব নিয়ে। মৃদুমন্দ সামুদ্রিক বাতাসের সঙ্গে দূরে চার্চ থেকে ভেসে আসা ঘণ্টাধ্বনি, ফজরের আজানের সুর আর সমুদ্রতটে প্রার্থনারত একদল সন্ন্যাসীর সমবেত প্রার্থনা-সব মিলে তৈরি হয় নতুন এক ভৈরবী। যোগ্যসঙ্গত বালুকাবেলায় একের পর এক সশব্দে আছড়ে পড়া সফেন তরঙ্গমালার সংগীতলহরী। এই নতুন রাগ-সংগীত শুনে মনের অন্দরে যে কী অনির্বচনীয় আনন্দধারা বয়ে চলেছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। ভ্রামণিক জীবনে বহু জায়গায় সূর্যোদয় দেখেছি। কিন্তু এখানে যে সূর্যোদয়ের সাক্ষী থাকলাম তা আর সারাজীবনেও কোথাও দেখতে পাব কী না জানি না! আলোর তীব্রতার সঙ্গে ধীরে ধীরে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান বিবেকানন্দ রক আর তারই পাশে তামিল সাহিত্যের দিকপাল কবি থিরুভাল্লুভারের স্ট্যাচু।
এক আশ্চর্য ভোরের সাক্ষী থেকে হোটেলে প্রবেশ করে মালপত্র রেখে স্নানাহার করার পর সারা রাত্রির ট্রেনযাত্রীর ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রওনা হলাম স্থানীয় জায়গাগুলো ঘুরে দেখার জন্য। বেশ কিছু জায়গা ঘুরে পৌঁছালাম এখানকার বিখ্যাত শুচীন্দ্রম মন্দির দেখতে। কন্যাকুমারী থেকে দূরত্ব প্রায় ১১ কিমি। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী এই মন্দিরের সৃষ্টি নিয়ে কন্যাকুমারী মন্দিরের সঙ্গে একটা যোগসূত্র আছে। ব্রহ্মার বর লাভ করে বাণাসুর তখন ত্রিলোকজয়ী হয়ে উঠেছে। তার অত্যাচারে দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে ব্রহ্মার কাছেই সমবেত প্রার্থনা জানান প্রতিকারের উপায় হিসেবে। কিন্তু অসুবিধা হল বর অনুযায়ী বাণাসুরকে কোনও পুরুষ বধ করতে পারবে না। উপায় হিসেবে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তখন এক রূপসী কন্যাকে জন্ম দেন। তাঁর হাতেই বাণাসুর বধ হবে। কিন্তু এখানেও শর্ত আরোপ করা হয় যে, কন্যাকে চিরদিন কুমারী অবস্থায় থাকতে হবে। পরিস্থিতি কঠিন হয়ে ওঠে যখন স্বয়ং মহাদেব এই কন্যাকে বিবাহ করতে উৎসুক হয়ে ওঠেন। বিবাহের নির্ধারিত দিনে মহাদেব যাত্রা করেন। দেবতারা প্রমাদ গুনতে থাকেন। কারণ এই বিবাহ হলে বাণাসুরের হাত থেকে তাঁরা মুক্তি পাবেন না। পৌরাণিক কাহিনিগুলোতে দেখা যায় এমন সংকটকালে নারদ তাঁর ভূমিকা অবলম্বন করেন চাতুর্যের মাধ্যমে। এখানেও তাঁর চালে ভেস্তে যায় বিবাহ।
শর্ত অনুযায়ী বিবাহ হওয়ার কথা ছিল রাতে। কিন্তু নারদের কূহকী ভূমিকায় জ্যোৎস্নারাতেই মোরগ ডেকে ওঠায় মহাদেব বিভ্রান্ত হয়ে ভোর হয়ে গেছে ভেবে দলবলসহ কৈলাসে ফিরে যান। ভ্রষ্টা কন্যার আর বিবাহ হয় না। বাণাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে দেবী তাকে হত্যা করেন, কিন্তু তিনি নিজে চিরকুমারী থেকে যান। নারদ মোরগের ডাক যে স্থানে ডেকেছিলেন সেখানে তিনি স্থাণু রূপ ধারণ করে চিরস্থায়ীভাবে থেকে গিয়েছিলেন। এই জায়গাই শুচীন্দ্রম্, যেখানে শিবের অবস্থান আর তার কিছু দূরেই কন্যাকুমারীর মন্দিরে দেবী পার্বতী চিরকুমারী রূপে মানুষের কল্যাণার্থে থেকে গেলেন। তাই ভক্তদের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস, কন্যাকুমারী মন্দিরের দেবীমূর্তি আর শুচীন্দ্রম্ মন্দিরে দেবাদিদেব মহাদেবকে দেখলে শিব-পার্বতীর দর্শন সম্পূর্ণ হয়। তবে মন্দিরের এমন নামকরণের পিছনেও রয়েছে একটি পৌরাণিক কাহিনি। দেবরাজ ইন্দ্র ঋষি গৌতমের স্ত্রী অহল্যাকে ছল করে ভোগ করায় ঋষি গৌতমের অভিশাপে অহল্যা পাষাণে পরিণত হন আর ইন্দ্রের সারা শরীরে সহস্রযোনিতে ভরে যায়। পরবর্তীকালে শ্রী রামচন্দ্রের দ্বারা অহল্যা অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভ করেন আর ইন্দ্র এই জায়গায় তপস্যা করার পর যোনি থেকে মুক্ত হয়ে ‘শুচী’ বা শুদ্ধ লাভ করেন। সেই সময় থেকে এই জায়গার নাম হয় ‘শুচীন্দ্রম্’।
দূর থেকে চোখে পড়ল সাদা রঙের ১৩৪ ফুট উঁচু গোপুরম সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। মনে হল সে যেন কোনও এক প্রাচীন নগরীর ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রহরী যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ভূমিতে প্রহরারত। ডানদিকে একটি বড় সরোবর আছে। মন্দিরে প্রবেশের পূর্বে একটু থমকে দাঁড়ালাম। এত বড় কাঠামো, খোদাই করা এত ভাস্কর্য— সেগুলো যেন পাথর নয়, জীবন্ত এক একটি গল্প।
প্রবেশদ্বারের সামনে দাঁড়িয়ে বর্তমান সময় পেরিয়ে কয়েকশো বছরের অতীতকে দেখতে পেলাম। পাথরে খোদাই করা আছে শ্রী বিষ্ণু, মহাদেব, দ্বারপাল, ক্ষেত্রপাল, লক্ষ্মী, গণেশ, সরস্বতী, কার্তিকসহ বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। দক্ষ ভাস্করদের শৈল্পিক ভাবনায় প্রতিটি নিষ্প্রাণ মূর্তিগুলোর মধ্যে প্রাণ ফুটে উঠেছে। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে সেই অনামী শিল্পীদের শিল্পকর্ম দেখে। মূল দরজা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই এক অদ্ভুত নীরবতা, কিন্তু তার মাঝেই ভক্তদের ভিড়, ঘণ্টা, শঙ্খধ্বনি, ধূপের গন্ধ— সব মিলিয়ে এক আধ্যাত্মিক আবহের সৃষ্টি হয়েছে। ধূপের ধোঁয়ার পাক খাওয়া দেখে মনে হয় ভক্তদের প্রার্থনা যেন আকাশের দিকে ভেসে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, ঠিক যেভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রংবেরঙের লুংদারের মাধ্যমে বাতাসে মন্ত্র ভেসে যায়। পাথরের দেওয়ালে খোদাই করা ভাস্কর্যগুলোকে দেখে মনে হয় তাদের চোখে অনেক গোপন ভাষা লুকিয়ে আছে, যা কেবল অনুভব করা যায়, শোনা যায় না।
মন্দিরের ভিতরে রাম, লক্ষণ, সীতা আর হনুমানজির চতুর্মূতি, কৈলাসনাথ, দেবগুরু বৃহস্পতি, নবগ্রহর মূর্তিও আছে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে বর্তমানের এই মন্দির পান্ড্যরাজারা নির্মাণ করেছিলেন। জনশ্রুতি একসময় এই অঞ্চলের নাম ছিল ‘জ্ঞানারণ্য’। এই নামকরণের ক্ষেত্রেও একটি পৌরাণিক কাহিনি জড়িয়ে রয়েছে। ঋষি অত্রির স্ত্রী অনুসূয়ার ‘মহাসতী’ খ্যাতিতে স্বর্গের অন্যান্য দেবীরা ক্রমেই হিংসাত্মক মনোভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন। তাঁরা অনুসূয়ার সতীত্বের পরীক্ষা নিতে রাজি করান ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে। এই পরীক্ষা নিতে তিন দেবতা ভিক্ষুকের বেশে ভিক্ষা গ্রহণ করার সময় তাঁরা অনুসূয়ার সতীত্বের চরম পরীক্ষা নেন। কিন্তু তিনি এক অলৌকিক উপায়ে ত্রিদেবকে শিশুতে পরিণত করেন। এরপর যখন অত্রি মুনি ফিরে আসেন, তখন স্বর্গের দেবীদের কাতর অনুগ্রহে তাঁর দয়ায় তিন দেবতা এমনভাবে স্বমহিমা ধারণ করেন যেন তাঁরা বিস্মৃত অবস্থা থেকে সদ্য জন্ম নিয়ে নতুন করে জ্ঞান লাভ করলেন। সেই সময় থেকেই এই জায়গার নাম হয় ‘জ্ঞানারণ্য’।
এই মন্দিরের বিখ্যাত বৈশিষ্ট্য উত্তর-দালানে অবস্থিত ১৮ ফুট সঙ্গীত স্তম্ভগুলো। পর্যটকদের কাছে ‘মিউজিকাল পিলার’ বলে খ্যাত। মন্দিরের এক সেবায়েত দেখালেন কীভাবে হাত দিয়ে আঘাত করলে সুর ওঠে। বিশ্বাস হল না। স্তম্ভের গায়ে কান পেতে শুনলাম খুব ক্ষীণ, কিন্তু যন্ত্রের আওয়াজ। সত্যিই আশ্চর্য হওয়ার মতো! বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এরপর এক একটি ঠান্ডা পাথরের থামের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর নির্দেশ মতো মৃদু আঘাত করতেই খুব ক্ষীণভাবে বাজতে থাকে সুর। মনে হল, মন্দিরের পাথরও মানুষের মতোই গান গাইতে চায়, যুগের পর যুগ সুরে সুরে আপন কথাও বলতে চায়। সঙ্গীত স্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে টাইম মেশিনে চলে যাই সেই সময়ে যখন রুদ্রবীণার তারের টানে মন্দিরপ্রাঙ্গণ সুরে সুরে ভেসে যেত। এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলাম কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, মন্দিরে নাকি কোনও সঙ্গীতসভার আসরে!
বিরাটাকার হনুমান মূর্তি এখানকার আরেকটি দ্রষ্টব্য। উচ্চতা নিয়ে মতভেদ থাকলেও একশিলা পাথরের প্রায় ২২ ফুট উঁচু সেই মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়। মনোলিথিক কারুকাজের মূর্তি, অথচ তাতে কত প্রাণশক্তিতে ভরপুর! ভক্তদের করজোড়ে প্রার্থনা, জপ করার দৃশ্য পুরো পরিবেশকে আরও পবিত্র করে তোলে। মূর্তির চোখ যেন অদৃশ্য শক্তিতে ভরা, মনে হল এক নিমিষে সব দুঃখ টেনে নিতে পারে! একটি বৃহদাকার নন্দী মূর্তিও রয়েছে, যা ভারতের বৃহত্তম নন্দী মূর্তিগুলির মধ্যে একটি। মন্দিরের বিভিন্ন স্তম্ভে রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন দৃশ্যও খোদাই করা রয়েছে। এই মন্দিরের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হল এখানে একসঙ্গে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের পুজো করা হয় যে কারণে এই মন্দির শৈব এবং বৈষ্ণব উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয়দের কাছে ‘স্থাণুমলয়ান’ মন্দির নামেও পরিচিত। ‘স্থাণুমলয়’ নামটি ত্রিমূর্তিকে বোঝায়-‘স্থাণু’-র অর্থ মহেশ, ‘মল’ বিষ্ণু এবং ‘অয়ন’ ব্রহ্মা। দক্ষিণ ভারতের আর কোথাও এই তিন দেবতার একসঙ্গে পুজো হয় কিনা জানি না। এঁদের একসঙ্গে থাকার অর্থ ব্রহ্মা–সৃষ্টি, বিষ্ণু–পালন, মহেশ্বর–লয়। তাঁদের পুজো হয় একস্থানে ঠিক যেভাবে তিন সমুদ্র এসে মিশে পরিণত হয়েছে এক অসীম শান্তির সাগরে। ত্রিশক্তির মিলিত আশীর্বাদ এই জনপদকে যেন এক অদৃশ্য সুরক্ষাবলয়ে ঘিরে রেখেছে। কারুকার্যময় সুন্দর এই মন্দিরে মহিলাদের জন্য বিশেষ পোশাকবিধি না থাকলেও পুরুষদের শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত করে প্রবেশ করতে হয়, এটাই নিয়ম। ভিতরে ফটো তোলা নিষিদ্ধ। প্রতি বছর ডিসেম্বরে উৎসব হয়। দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন। এপ্রিল- মে মাসেও আরেকটি উৎসব হয় জার নাম ‘টেপ্পাম’।
মন্দির চত্বরে অনেকক্ষণ ছিলাম। একসময় বিকেলের আলো ধীরে ধীরে নেমে আসতে থাকে তার আঙিনায়। অস্তগামী সূর্যের রঙিন ছায়া গোপুরমের গায়ে আঁকতে থাকে এক অদ্ভুত আলোকচিত্র। তখন সন্ধ্যারতির সময় হয়ে এসেছে। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে সন্ধ্যারতি দেখার মতো। ‘স্থাণুমলয়’-এ স্বর্ণালী সন্ধ্যায় অপূর্ব সুন্দর আরতি দেখার সুযোগ পেলাম। দ্যুতিময় গোপুরম থেকে বিদায় নেওয়ার সময় শেষবারের মতো মন্দিরের দিকে তাকিয়ে মনে হল, শুচীন্দ্রম মন্দির শুধুমাত্র একটি পুজোর স্থান নয়, এটি ইতিহাস, স্থাপত্য আর আধ্যাত্মিকতার এক সুরেলা মেলবন্ধনও। এই যাত্রা শুধু একটা মন্দির দর্শন নয়, বরং আমার ভিতরের নিঃশব্দ প্রার্থনার সঙ্গে মহাকালের এক সংযোগও ঘটিয়ে দেওয়া। মনে মনে আরও একবার বললাম, ‘হে সর্বশক্তিমান শুধু মানুষ হওয়ার শক্তি দাও’। আরতি শেষে ধীরে ধীরে ভক্তদের পদচারণার শব্দ তখন মিলিয়ে যাচ্ছে…৷