সুতপা দত্ত দাশগুপ্ত
স্পিতি উপত্যকা— যার অর্থই হলো ‘মধ্যভূমি’, অর্থাৎ ভারত ও তিব্বতের মাঝের ভূমি। স্পিতি উপত্যকায় পৌঁছতে পৌঁছতে সূর্য্যটা পাহাড়ের ওপারে মুখ লুকোলো| রুক্ষ প্রকৃতি তবু মাঝে মাঝে পাথরের দেওয়াল ঘেরা আপেলবাগান আর পাথুরে ঘরবাড়ি | আমাদের থাকার জায়গাটি বেশ বাহারি| কাঠের একটি বাংলো যেটি কাঠের ভারী ভারী আসবাবে সাজানো আপাদমস্তক কার্পেট মোড়া | খুব ঠান্ডায় প্রায় জমে যাচ্ছিলাম| হোটেলের লোক এসে ফায়ার প্লেস এ আগুনটাগুন জ্বালিয়ে দিলো আর ব্লু ক্রকারিজে সাজিয়ে দিলো গরম গরম ধোঁয়া ওঠা মন চাও স্যুপ| পরদিন স্পিতির রাজধানী ও আধুনিকতার প্রাচীন দ্বার স্পিতির প্রশাসনিক কেন্দ্র কাজা শহরটি দেখতে বেরুলাম| একসময় প্রাচীন তিব্বতি রাজ্যের বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। উনবিংশ শতাব্দীতে যখন ব্রিটিশ অভিযাত্রীরা স্পিতির পথে যাত্রা শুরু করেন, কাজা ছিল তাঁদের বিশ্রামের মূল কেন্দ্র। এই শহর থেকেই শুরু হয় উচ্চহিমালয়ের নানা বৌদ্ধ মঠের পথে যাত্রা।
কাজার প্রাচীন বাজার আজও বহন করে তিব্বতি ঐতিহ্যের ছোঁয়া |রঙিন প্রার্থনার পতাকা, চা-ঘর, আর গুমফার ঘণ্টাধ্বনি যেন মনে করিয়ে দেয়,এই ভূমি একসময় বৌদ্ধ ধর্মের ট্রান্স-হিমালয়ান পথের প্রধান সংযোগস্থল ছিল।
চারদিকেই রুক্ষ পাহাড় আর মাঝের পাথুরে রাস্তায় চলতে চলতে গাড়ি ঢুকলো কি মনেস্ট্রিতে | কি মনাস্ট্রি হিমাচল প্রদেশের স্পিতি উপত্যকার অন্যতম প্রাচীন ও বিখ্যাত বৌদ্ধ মঠ। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪,১৬৬ মিটার (১৩,৬৬৮ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত, কি গ্রাম অঞ্চলে স্পিতি নদীর তীরে। এই মঠের প্রাচীন নাম ছিল কি লেখাঙ্গ বিশ্বাস করা হয়, এটি ১১শ শতাব্দীতে (প্রায় ১০৫০ খ্রিস্টাব্দে) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অতীশ দীপঙ্করের শিষ্য দ্রমতন দ্বারা। দেখতে তিব্বতের অন্যান্য মঠের মতোই কিন্তু এখানকার নিয়মকানুন একটু আলাদা | হলুদ বা খয়েরি জোব্বা পরা বিভিন্ন বয়সী লামারা নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল | ছোট বাচ্চা লামারা পড়াশুনো করতে মঠে এসেছে| সাধারণত পাঁচ বছর থেকেই এদের অ্যাডমিশন হয় আর দ্বিতীয় সন্তান ছেলে হলে তার দায়িত্ব মঠ নেয়| কথায় কথায় বেলা এগিয়ে যাচ্ছিলো| আমাদের জন্য এলো গরম গরম মাখন চা| আর সবাই প্রস্তুত হচ্ছিলো দুপুরের খাবার জন্য | একটি বিরাট প্রেসার কুকারে চাল ও ডাল সেদ্ধ করা হয় তাতে মেশানো হয় জোয়ারের আটা বা যবের ছাতু| এটিই মধ্যাহ্ন আহার| চারপাশের দেওয়াল পাথরের এমনকি উঁচু উঁচু পাথরের ধাপে পা দিয়ে কক্ষগুলোতে যেতে হবে| দেখলাম ওয়ান উইন্ডো মেডিটেশন রুম |
এটি গেলুগপা বা ইয়েলো হাট বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান মঠগুলির একটি। এখানে একসময় শতাধিক সন্ন্যাসী বসবাস করতেন, যাঁরা তিব্বতি বৌদ্ধ শিক্ষা, ধ্যান, ও ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করতেন।
মঠে এখনও বৌদ্ধ পাণ্ডুলিপি, প্রাচীন প্রার্থনা-চাকা, মূর্তি, ও দেওয়ালচিত্র (murals) সংরক্ষিত আছে।মঠটি পাহাড়ের ঢালে ধাপে ধাপে তৈরি, যেন একটি মিনিয়েচার শহর। এটি ‘কাসল মনাস্ট্রি’ নামেও পরিচিত। গম্বুজাকৃতি ছাদ, কাঠের জানালা, ও প্রাচীন চিত্রকলায় সজ্জিত প্রার্থনা কক্ষ এখানে প্রধান আকর্ষণ।
আজ এটি শুধু ধর্মীয় কেন্দ্র নয়, বরং স্পিতি উপত্যকার আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক প্রতীক। প্রতি বছর জুলাই মাসে ‘কি চাম’ নৃত্য উৎসব হয়, যেখানে ভিক্ষুরা মুখোশ পরে ঐতিহ্যবাহী নাচ পরিবেশন করেন। একটি ধর্মীয় কাহিনী অনুসারে একসময় মঠের উপর কালো মেঘ ছেয়ে আসে — আক্রমণ ও আগুনে সব নষ্ট হয়। তখন এক প্রবীণ ভিক্ষু পাহাড়ের চূড়ায় প্রার্থনায় বসেন| বলা হয়, তাঁর মন্ত্রোচ্চারণে প্রবল তুষারপাত হয় এবং আগুন নিভে যায়। সেই থেকেই এই মঠকে ‘অক্ষয় প্রার্থনার স্থান’ বলা হয় |
এরপর গেলাম নাকো পদ্ম-হ্রদ দেখতে | এখানে পদ্ম নেই, শুধু পান্না সবুজ টলটলে জলে আকাশের অমল ছায়া আর চারপাশের সবুজ চিকরিকাটা পাতার নাম না জানা গাছ| কাজা থেকে দক্ষিণে, কিন্নর জেলার সীমান্তে অবস্থিত নাকো গ্রাম,যা একসময় প্রাচীন তিব্বতের সাং রাজ্যের সঙ্গে সাংস্কৃতিকভাবে যুক্ত ছিল।
এই নাকো লেক— একটি প্রাকৃতিক উচ্চভূমির হ্রদ, যাকে স্থানীয়রা ‘স্বর্গের আয়না’ বলে। এখানেও একটি ছোট্ট মঠ দেখলাম| মূলত গ্রামের ছেলেদের পড়াশোনার উদ্দেশ্যে স্থাপিত |
নাকোর মঠগুলি নির্মিত হয়েছিল প্রায় ১১শ শতকে, তখনকার তিব্বতি রাজা রিংচেন সাংপো এর সময়। তাঁর উদ্যোগেই পশ্চিম হিমালয়ে একের পর এক মঠ ও বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে নাকো সেই ধারার অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন। মঠের দেয়ালে আজও দেখা যায় শতাব্দীপ্রাচীন থাংকা চিত্র ও মাটির ভাস্কর্য, যা প্রমাণ করে তিব্বতি শিল্প ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল সংমিশ্রণ এই ছোট্ট গ্রামে| মাঝে মাঝে শুকনো বরফ ঠান্ডা হাওয়া আর অনন্ত নীরবতা | লেকের গভীর সবুজ জল আর তাতে মুখ দেখে নীল আকাশ আর সাদা তুলোর মতো মেঘের পালক | মন হারানোর এই বেলায় নিজেকেই নতুন ভাবে আবিষ্কার করছিলাম |
এরপর আসে তাবো স্পিতি উপত্যকার প্রাচীনতম ও পবিত্রতম স্থানগুলির একটি।তাবো মঠের প্রতিষ্ঠা ৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে, তিব্বতি অনুবাদক ও ধর্মগুরু রিংচেন সাংপো-র নেতৃত্বে।
এই মঠকে বলা হয় ‘Ajanta of the Himalayas’, কারণ এখানকার দেয়ালচিত্র ও ভাস্কর্য আজও এক হাজার বছরের পুরনো শিল্পরীতির সাক্ষ্য বহন করে। তাবো মঠ কেবল ধর্মীয় স্থান নয়, এটি এক বৌদ্ধ শিক্ষা ও অনুবাদের কেন্দ্র ছিল, যেখান থেকে তিব্বতি ভাষায় বহু ধর্মগ্রন্থ অনূদিত হয়। ১৪ শতকে তিব্বতের সাকিয়া সম্প্রদায়ের প্রভাব এ অঞ্চলে বাড়ে,তবুও তাবো আজও তার মূল রূপ ধরে রেখেছে।
২০০৯ সালে দালাই লামা নিজে এখানে এসে বলেছিলেন— ‘তাবো হলো সেই স্থান, যেখানে আমি বার্ধক্যে এসে ধ্যান করতে চাই।’ স্পিতির আত্মা, কাজার আধুনিকতা, নাকোর প্রাচীন সৌন্দর্য, আর তাবোর আধ্যাত্মিক গভীরতা—এই তিনে মিলে স্পিতির আত্মা সম্পূর্ণ হয়।এখানে ইতিহাস, ধর্ম, প্রকৃতি ও মানবতা মিশে গেছে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে। তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিলো তাবোর পাহাড়ের পেছনে,প্রার্থনার ঘণ্টাধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো উপত্যকার বাতাসে, আর মনে হচ্ছিলো এই পাহাড়গুলো এখনো গেয়ে চলেছে হাজার বছরের পুরনো প্রার্থনার সুর,যা মানুষকে শেখায়— শান্তিই সবচেয়ে গভীর ইতিহাস।পরদিন আবার পাহাড়ি পথে ছুটে চললো আমাদের স্করপিও | এবার যাবো প্রায় পনেরো হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত পৃথিবীর সর্বোচ্চ ডাকঘরের গ্রামটিতে যার নাম হিকিম| এখানকার বাড়িগুলো প্রায় একরকম দেখতে| ন্যাড়া ছাদের সাদা রঙ আর বাদামি জানালা | সকালে সূর্যের প্রথম আলো যখন বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ের চূড়োয় পড়ল, তখন মনে হলো যেন স্বর্গদ্বার খুলে গেছে। সরু পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে যখন গাড়ি ধীরে ধীরে ওপরে উঠছিল, বাতাসের ঘ্রাণও যেন বদলে যাচ্ছিল— পাতার নয়, পাথরের গন্ধ মিশে আছে তাতে।প্রায় ১৪,৪০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই ছোট্ট গ্রামটি যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে গোনা কয়েকটি বাড়ি, মাটির দেয়াল, কাঠের জানলা, আর দূরে মেঘের মতো ধোঁয়া তুলে জ্বলছে রান্নার চুলা। নীরবতার এমন ঘনত্ব আগে কখনও অনুভব করিনি।
গ্রামের মাঝখানে লাল রঙের একটি ছোট্ট ঘর—তার দরজায় লেখা ‘HIKKIM POST OFFICE’। হ্যাঁ, এটাই সেই বিখ্যাত ডাকঘর—বিশ্বের সর্বোচ্চ ডাকঘর। ভেতরে ঢুকে দেখি, এক বৃদ্ধ পোস্টমাস্টার ধীরে ধীরে চিঠি গুছিয়ে রাখছেন। তাকিয়ে হাসলেন—
‘চিঠি পাঠাবেন?’
হ্যাঁ, পাঠাব। বহুদিন পর কাগজে কলম ছুঁয়ে চিঠি লিখলাম—নিজেকে। বাইরে দাঁড়িয়ে সেই চিঠি যখন ডাকবাক্সে ফেললাম, মনে হলো সময় যেন থেমে গেল এই নীরব পাহাড়ের কোলে।
‘এখানে নীরব অপেক্ষায় ডাকবাক্সেরা হিমেল’৷ হিকিমে সূর্যাস্ত হয় খুব দ্রুত। আকাশে তখন রঙিন তুলির আঁচড়ের মতো আলো। ঠান্ডা হাওয়া বইছে, তবুও বুকের ভেতর এক অদ্ভুত উষ্ণতা। মনে হলো, পৃথিবীর যত ব্যস্ততা, যত দৌড়ঝাঁপ— সব এখান থেকে কত নিচে পড়ে রইল!
রাতের হিকিমে তারাভরা আকাশ যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। মিল্কিওয়ে নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে মাথার ওপর। আর সামনের ন্যাড়া পাহাড়টায় জ্বলজ্বল করছে সেই অক্ষয় স্তুতি বাণীটি… ওম মনিপদ্মে হুম…৷ ফিরতি পথে গাড়ির জানলা খুলে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা চোখে মুখে মেখে নিচ্ছিলাম| ওই দূরের পাহাড়টা, ছোট গ্রাম আর লাল পোস্টবাক্সটা পড়ে রইলো…৷ শুধু এই নিঃস্তব্ধ পাহাড় থেকে লেখা চিঠি পাড়ি দিচ্ছে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে—তবু এই গ্রাম, এই ডাকঘর, এই নীরবতা চিরকাল একই থেকে যাবে।
আশ্রয়স্থল।
কুঞ্জুম পাস (Kunzum Pass)
উচ্চতা: 4,551 মিটার।
এই পাসের ওপর একটি ছোট মন্দির আছে — কুঞ্জুম দেবীর মন্দির।
এখান থেকেই স্পিতি উপত্যকায় নামা শুরু হয়।
লোসার (Losar)
স্পিতি অঞ্চলের প্রথম বড় গ্রাম।
এখান থেকে রাস্তা তুলনামূলক ভালো।
কাজা (Kaza)
স্পিতি উপত্যকার কেন্দ্র ও প্রশাসনিক শহর।
এখান থেকে হিকিম, লাংজা, কিব্বার, কী মঠ ইত্যাদি জায়গায় ঘোরা যায়।
যাত্রার পরামর্শ:
মে থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে যাত্রা করুন।
4×4 গাড়ি বা ভালো গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্সওয়ালা SUV সবচেয়ে উপযোগী।
রাস্তায় নেটওয়ার্ক খুব কম, তাই আগে থেকেই হোটেল বা হোমস্টে বুক
করা ভালো।
উচ্চতাজনিত অসুস্থতার (AMS) জন্য প্রস্তুত থাকুন।