স্কুল জীবনে প্রথমবার যখন হিমালয়ে যাই, কী যে অসীম মুগ্ধতা,ভালোলাগায় ভরে গিয়েছিলাম বোঝাতে পারব না! গায়ের মধ্য দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘেদের একটু হাঁ করে গিলে ফেলা, সবুজ চির পাইনের বুনো গন্ধ গায়ে মেখে নেওয়া। হঠাৎ হঠাৎ মেঘ কুয়াশার মধ্যে দিয়ে অচেনা বাঁকে ভুঁইফোড় হয়ে হাজির হয়, নিঃশব্দে চোখ জ্বেলে আসা গাড়ি। মহা মহিম কাঞ্চনজঙ্ঘার সোনালি মুকুট ও তার বিপুল সৌন্দর্যে বিমোহিত আমি নিজেকে সমর্পিত করি ওই বিশালতার কাছে। অসম্ভব মাদকতার মুহূর্তগুলি কেবলই অনুভবের!
সেই ভালোলাগার অমোঘ টানেই বারে বারে ছুটে যাই হিমালয়ে। হিমেল হওয়ার স্পর্শ পেলেই উড়ু উড়ু মন ডানা ঝাপটায় ওড়ার অপেক্ষায়! সোশ্যাল মিডিয়ায় চেরি ব্লসমের ছবি দেখে মনের মধ্যে অচিন পাখির ডাক শুরু হয়ে গেল। রাস পূর্ণিমায় গুরু নানকের জন্মদিন শুক্রবার, ছুটি রয়েছে। শনিবার ও রবিবার জুড়ে নিয়ে, দার্জিলিং মেলের প্রিমিয়াম তৎকালে টিকিট কেটে বেরিয়ে পড়লাম।
৫ ঘন্টা লেট করে দার্জিলিং মেল ঢুকল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। দু’দিনের বেড়ানোর আধবেলা বিসর্জন গেল। ভেবেছিলাম কম খরচে শেয়ার গাড়িতে যাব, সে কি কপালে আছে! স্টেশন থেকে বেরতেই গাড়িওলার দল মৌমাছির মতো ছেঁকে ধরল। কেউ বলে ৫ হাজার তো কেউ হাঁকে সাড়ে ৪ হাজার। প্রচলিত পথে কালিম্পং হয়ে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে রিশপের দূরত্ব ১০৭ কিমি আর গরুবাথান হয়ে ১২০ কিমি। যাইহোক, পরিচিত ড্রাইভারকে পেলাম ন্যায্য ভাড়াতে, সেবক ব্রিজ পেরিয়ে ওদলাবাড়ি, ডামডিম হয়ে গরুবাথান চা বাগানের মধ্যে দিয়েই নিয়ে যাবে। এ পথের রং রূপ নিতে নিতে চেল নদী পেরিয়ে চড়াই উৎরাই পথে দেড়টায় শুরু করে, সে সাড়ে ৪টের মধ্যে পৌঁছে দিল রিশপ। মাঝে গাজলডোবায় আধ ঘন্টার বিরতি নিয়ে বোরলি ভোজন সেরে নিয়েছিলাম। গরুবাথানের পর থেকে গাড়ি যতই মেঘ ছোঁয়ার উদ্দেশ্যে উঠতে লাগল, সাদা মেঘ ততই এগিয়ে এসে ঘিরে ধরল। প্রায় সাড়ে আট হাজার ফুট উচ্চতায় বার্চ, জুনিপার, পাইনে ভরা জঙ্গলে পূর্ণ রিশপ- তখন পুরোপুরি মেঘের আড়ালে এবং প্রবল ঠান্ডার কবলে।
পরের দিন ভোর থেকেই অপেক্ষা করছিলাম সোনালি মুকুটে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখব বলে। চেয়ে রইলাম উপত্যকার ওপারে পাহাড়ের গভীর রহস্যময় সবুজ সংসারের দিকে। এরই মধ্যে মেঘেদের খেয়ালি আনাগোনা পাহাড়ের বুকে শুরু হয়ে গেছে। সারা সকাল মেঘের আড়ালেই থেকে গেল, বেলা বাড়ার পর রজতকান্তি কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মিললেও, মন ভরল না। বাকিরা বলল গতকাল সকালে সুবর্ণকান্তির দর্শন মিলেছিল। অবারিত উপত্যকায় দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল সামনের পেডং পাহাড়- আধুনিক সভ্যতার থাবায় ক্ষত বিক্ষত দেহখানি। মাত্র দেড় কিমি হাঁটলেই পৌঁছে যাওয়া যায় রিশপের সর্বোচ্চ বিন্দু টিফিনদাঁড়া। এখান থেকে সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ আজীবন স্মৃতির মনিকোঠায় চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। সকালে পায়ে পায়ে ঘুরে আসা যায় রিশপের সুন্দর ছোট গ্রামটিতে। ১৯৯৮ সালে শুরু হওয়া এই জনপদটি বাড়তে বাড়তে ২ কিমি ছাড়িয়ে গেছে, বর্তমানে এখানে রয়েছে নানা মানের প্রায় ৯০টি হোমস্টে।
সকাল ১০টায় বেরিয়ে পড়লাম যার জন্য এবার আসা সেই চেরি ব্লসমের খোঁজে। বসন্তে জাপানে পাতাহীন গোলাপি রঙের ফুলে ভরা গাছের দেখা মেলে। দেখলে মনে হবে পরী। ভারতের কয়েকটি জায়গায় অল্প কিছু গাছ দেখা যায়। শিলংয়ে সবচেয়ে বেশি, এছাড়া মণিপুর , মিজোরাম ও সিকিমের টেমি টি গার্ডেনেও দেখা যায়। এখানে চেরি ব্লসম নভেম্বর মাসেই ফোটে, হিমালয়ের দু-একটা স্থানে মার্চেও ফুটতে দেখা যায়। শিলংয়ে এবছর নভেম্বরের ১৫ ও ১৬ তারিখ হয়ে গেল চেরি ব্লসম উৎসব। বাংলায় চেরি ফুল কেবলমাত্র দেখা যায় সামাবিয়ং টি গার্ডেনে। বার্চ, জুনিপারের ঘন জঙ্গল ঘেরা পথ দিয়ে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লাভা। এখান থেকে যে-পথ চলে গেছে গরুবাথানের দিকে, মাত্র ৫ কিমি গেলেই পড়বে এই চা বাগান।
ড্রাইভার সুনীল শেরপা বলল,‘চলুন দাদা আগে কোলাখাম, ছাঙ্গে জলপ্রপাত দেখে তারপর ওখানে যাব। রাস্তা খুব খারাপ, সময় লাগবে।’
রাজি না হয়ে চেরির ঠিকানায় যেতে বললাম। রিশপ থেকে ৪০ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম চা বাগানে। ও বাবা! রোদ ঝলমলে আকাশ ছিল ৫ মিনিট আগে, কোথা থেকে পাগলা ষাঁড়ের মতো ছুটে এল সাদা মেঘের দল। বুঝলাম এবার ভাগ্য প্রসন্ন নয়। এর মধ্যেই আশ মিটিয়ে গোলাপি সুন্দরীকে দেখলাম, যতই সে মেঘের ঘোমটার আড়াল টানার চেষ্টা করুক। নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলে নিলাম স্মৃতি হিসাবে। সবুজ চা বাগানের উপর মেঘ আলোর খেলা, পাহাড়ের বুকে যেন এঁকে চলেছে নানা চিত্র।
এরপর লাভা ফিরে ঢুকলাম প্রায় ৬ কিমি দূরে গভীর নেওড়া ভ্যালির জঙ্গলে, কোলাখাম। নিবিড় জঙ্গলের নিরিবিলিতে ক’টা দিন কাটাতে চাইলে কোলাখামে আসতে পারেন। এখান থেকে চার কিমি ছাঙ্গে জলপ্রপাত। গাড়ির রাস্তা ছেড়ে ৯০০ মিটার ট্রেক করে পৌঁছলে দেখতে পাবেন ঝাঁপিয়ে পড়া বিপুল জলরাশি। একটু পরেই সে হারিয়ে গেছে সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধার মধ্যে। বেশ রহস্যময় তার প্রবাহ। ফেরার পথে লাভা মনাস্ট্রি দেখে সন্ধ্যায় ফিরলাম আমাদের হোমস্টেতে। পরের দিন সকালেও অভিমানী কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখ দেখা গেল না। বলল পরের বার আয় মন ভরে দেখবি!
আমি যে নিজেকে রবি ঠাকুরের তারাপদ ভাবতাম- ‘চির বন্ধন অসহিষ্ণু প্রকৃতির,উদাসীন নিরাসক্ত প্রকৃতির প্রতীক’, কিন্তু আমার অক্ষমতা আমাকে যেতে দেয় না। ক্ষুদ্র আমি। আমাকে ফিরে আসতে হয় জীবনের টানে, জীবিকার টানে।