মানুষের আদি ধারা

খুলির ছবি

৩ মার্চ ১৮৪৮ সাল,জিব্রালটার ‘সায়েন্টিফিক সােসাইটি ’,মূলত(যদিও পুরােপুরি নয়) সৈনিকদের প্রতিষ্ঠান;তাদের মিটিং-এর খাতায় লিখেছিলেন,“পেশ করা হলাে একটি মানুষের করােটি ফোর্বসের খনি অঞ্চল থেকে,উত্তর সীমান্ত,সম্পাদকের মাধ্যমে।”জিব্রালটার সমুদ্রপথ পাহারা দেবার সময়, পাথরের গায়ে পাওয়া গেছল এই মানব জীবাশ্ম।১৯৬৪ সালে করােটিটা দেওয়া হয় লন্ডনের রয়াল কলেজ অফ সাজ্বনকে।করােটিটাকে নিয়ে কাজ করে ঐ সংস্থার ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিউজ ফ্যালকনার দেখান যে,এই করােটিটার সঙ্গে ‘নিয়ানডার উপত্যকা’থেকে পাওয়া জীবাশ্মের মাথার ‘চাঁদির হাড়’ আর ‘হাতের হাড়ে’র মধ্যে মিল আছে।১৮৬৪ সালেই চার্লস ডারউইন তার বন্ধ জে.ডি.হুকারকে চিঠিতে লিখেছিলেন “লাইলি আর ফ্যালকনার দুজনেই আমাকে ডেকেছিলেন আর আমিও তাদের সঙ্গে দেখা করতেপরে খুব খুশি হয়েছি,ফ্যালকনার আমাকে বিস্ময়কর জিব্রালটার করােটিটা দেখালেন।”

১৮৭১ সালে ডারউইন,তার ‘মানবের গােত্র’( The Descent of Man )বইতে লিখেছিলেন,“প্রত্যেক অঞ্চলের জীবিত প্রাণীর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত সেই অঞ্চলের বিলুপ্ত প্রজাতিদের সঙ্গে।এটা,তাই,খুব সম্ভব যে আফ্রিকায় বাস করত কিছু বিলিপ্ত লেজহীন বানর,গােরিলা আর শিম্পাঞ্জিদের মতােই,এবং যেহেতু এই প্রজাতির প্রাণীরা আমাদের খুব কাছের,এটা সেজন্য খুব সম্ভব যে আমাদের আদি পূর্বপুরুষ বাস করত আফ্রিকাতেই।”তিনি বইটা শেষ করার আগে এই একটাই জীবাশ্ম দেখতে পেয়েছিলেন আদি মানবের।

সাধারণভাবে বলতে গেলে যাঁরা গবেষণা করেন প্রাচীন মানুষ নিয়ে,তাদের বলা হয় প্রত্ন-নৃতত্ত্ববিদ (palaeoanthropologist)।এই কাজের শুরু অবশ্যই হয়েছিল জীবাশ্ম খোঁজা থেকে,তবে আজকের দিনে এই খোঁজার শরিক হয়েছেন শারীরিক এবং জৈবিক নৃবিদ্যা-বিশারদ(Physical & Biological anthropologist),প্ৰত্ববিদ(Archaeologist),ভূবিদ্যা-বিশারদ(Geologist),প্রত্ন- আবহবিদ(Palaeoclimatologist),ভাষাবিদ(Linguists)এবং জিনতত্ত্ববিদরা(Genetists)।


আমাদের শরীর তৈরি ‘কেন্দ্রযুক্ত’(eukaiyotic)কোষ দিয়ে,এধরনের কোষে ডি-এন-এ(DNA) থাকে দু’জায়গায়:বেশিরভাগটা কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াসে,কিছুটা মাইটোকনড্রিয়ায়।এই মাইটোকনড্রিয়ার ডি-এড়-একে বলে mtDNA;আমরা বলব ‘ম’ ডি এন এ’।আমাদের ডি-এন-এর একটা কর্ম আছে;যখন কোন স্থায়ী উত্তরণ (mutation)হয়,সে ছাপ রেখে যায় ডি-এন-এর ক্রমে।এর মধ্যে আবার ‘ম’ ডিএনএ-র ব্যাপারটা আলাদা,যেহেতু আমাদের জন্ম হয় মায়ের শরীরের ডিম্বানু কোষ থেকে,পিতার শুক্রাণু তাকে নিষিক্ত করে নতুন কেন্দ্রে,নতুন মিলিত জিন তৈরি হয়;মাইটোকনড্রিয়া আর তার ‘ম’ডিএনএ থেকে যায় মায়েরই।যতক্ষণ পর্যন্ত এই ‘ম’ডিএনর কোন মিউটেশন হচ্ছে বা নতুন কোন মা তার বদলে যাওয়া অন্য মাইটোকনড্রিয়ার জিন নিয়ে আসরে নামছে,এই ডিএনএ-র ইতিহাস থাকে প্রায় অবিকৃত,প্রত্যেক প্রজন্মে ম’ডিএনএ অন্য ডি-এন-এ-র সঙ্গে মিশে যায় না।

এইভাবে হিসেব করার কিছু সমস্যা আছে,প্রথমত ধরে নেওয়া হয় প্রত্যেক মিউটেশনের গড় সময়ের ব্যবধান কত হবে;সেটা সবসময় ধরে নেওয়া হিসেবের সঙ্গে একেবারে মেলে না।তখন হিসেব করে পাওয়া সময়ের সঙ্গে কাছাকাছি সময়ের জীবাশ্মের বয়েস মিলিয়ে একটা ছক পাওয়া যায় এই দু ‘ ধরনের হিসেব মিলিয়ে বিজ্ঞানীরা বানর পরিবারের,যে পরিবারে আমরাও এক প্রজাতির সদস্য,একটা কুলুজি বা বংশধারা তৈরি করেছেন।

আমাদের বংশধারা উঠে এসেছিল বনমানুষদের দল থেকে লেমুর(lemur),লরিস(loris),গ্যালাগাে(galago),টারসিয়র,বানর(monkey)আর লেজহীন -বানর(ape)।মিওসিন কালে (Miocene Epoch-২.৩ কোটি থেকে ৫৩ লক্ষ বছর আগে) বনমানুষদের বিভিন্ন প্রজাতির বিকাশ হয়েছিল,তারা ছড়িয়ে গেছল সারা পৃথিবীতে।আফ্রিকা,ইউরােপ,এশিয়া,সব জায়গা থেকেই তাদের জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছে উত্তর আফ্রিকা থেকে পাওয়া ৫কোটি বছর আগের একটি করােটি,প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নাম Aegyptopithecus Zeuxis;মনে করা হচ্ছে মানব ধারার আদিমতম নিদর্শন|

বনমানুষদের চেনা যায় মুলত ছ ‘ টা শারীরিক বৈশিষ্ট দেখে :

১) এদের দুটো চোখই (মুখে চোখের মণির অবস্থান) সামনের দিকে।একই জিনিস দুচোখে একসঙ্গে দেখে,তাই বস্তুর তিন মাত্রার অবস্থানটা পরিষ্কার বুঝতে পারে,যদিও মাথা না ঘুরিয়ে পেছন দিকে দেখতে পায় না।

২) চোখদুটো বসে আছে শক্তপােক্ত আংটির মতাে হাড়ের কাঠামাের নিরাপত্তায়।

৩)বুড়ােআঙুল আছে,ফলে এরা কোনও কিছু ভালােভাবে মুঠোয় ধরতে পারে।

৪)প্রত্যেকটা আঙুলের ডগাকে আঘাত থেকে বাঁচানাের জন্যে নােখ আছে।

৫)এদের হাত বা পায়ের পাতায় লােম নেই এবং প্রত্যেক বনমানুষের নিজস্ব আঙুলের ছাপ আছে,যেটা একান্ত সেই বনমানুষেরই।

৬)অন্য স্তন্যপায়ীদের তুলনায় এদের মস্তিষ্ক অনেকটাই বড়,যার ফলে এরা কোনও আচরণ দেখে শিখতে আর সেই আচরণ নিজে করে দেখাতে পারে।অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের তুলনায় বুদ্ধি ও দুষ্টুবুদ্ধি ধরে অনেক বেশি।

তবে,এক কোটি বছরের কিছু আগে পরে বনমানুষরা হারতে শুরু করেছিল বানরদের কাছে,খুব সম্ভবত পৃথিবীতে হিমযুগের সূচনা হওয়ার ফলে।তখন,আবহাওয়া শুকনাে আর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল,সেই দলগুলােই টিকে থাকতে পেরেছিল,যারা বাস করত উষ্ণ আর জলীয় বাষ্পে ভরা এলাকায়।বানরদের খাদ্যের নমনীয়তা অনেক বেশি, তারা অনেক বেশি কঠোর আবহাওয়াও সহ্য করতে পারে।ফলে,আজ মাত্র ছয় প্রজাতির বনমানুষ টিকে আছে পৃথিবীতে গরিলা, ওরাংওটাংদের দুটো প্রজাতি, শিম্পাঞ্জিদের দুটো প্রজাতি আর মানুষ। শুকনাে আবহাওয়ায় বনমানুষদের যে দল মাটিতে, দু ‘ পায়ে চলাফেরা করা অভ্যেস করে নিয়েছিল, বিকাশ করেছিল দু ‘ পায়ে চলাফেরা করার উপযুক্ত শরীর সংস্থানের(anatomy), তারা টিকে গিয়েছিল, এই ধারা থেকেই উঠে এসেছে মানুষ।

 জীবাশ্ম ধারার বিভিন্ন নিদর্শনের মধ্যে ‘টোউমাই’ (Toumai) নাম দেওয়া একটি মানুষ বা মানুষের মতাে প্রাণীর করােটিকে এখনও পর্যন্ত আদিমতম মনে করা হয়।এই করােটিটা পাওয়া গিয়েছিল সাহারা মরুভূমিতে।করােটির ভ্রূর হাড় (brow bridge), মুখ ( face ), ছােট শ্বদন্ত ( canine teeth ) মানুষের মতাে , তবে মাথার পেছনের অংশটা শিম্পাঞ্জিদের মতাে। এই করােটির বয়স ৬৫ থেকে ৭০ লক্ষ বছর, যেটা শিম্পাঞ্জিদের সঙ্গে মানুষের বিবর্তনের ধারার বদলের সময়ের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। মানুষের বিবর্তনের এই ধারা লক্ষ্য করে আমেরিকার প্রত্ন- নৃতত্ত্ববিদ স্টিফেন জে গােল্ড বলেছিলেন, ‘…বিলুপ্ত হতে বসা এক প্রাণীকুল তখন নির্ভর করেছিল এক বিচিত্র আবিষ্কারের ওপর, যাকে আমরা চেতনা বলি। এই পথেই এসেছে মানুষ।